প্রবাস মেলা ডেস্ক: সম্প্রতি ঢাকার কাটাবনস্থ দীপনপুরে সরলরেখা প্রকাশনা সংস্থার উদ্যোগে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ও কথাসাহিত্যিক আনোয়ারা সৈয়দ হক। সেখানে প্রবাস মেলা’র নির্বাহী সম্পাদক শহীদ রাজুও অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠান বিরতির এক ফাঁকে আনোয়ারা সৈয়দ হক এর সাথে তার সাহিত্য সাধনার বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলেন শহীদ রাজু এবং তার হাতে প্রবাস মেলা’র সৌজন্য কপি তুলে দেন। প্রবাস মেলা হাতে পেয়ে আনোয়ারা সৈয়দ হক এর ভূয়সী প্রশংসা করেন এবং প্রবাসীদের সমস্যা-সম্ভাবনা নিয়ে এরকম একটি পত্রিকা প্রকাশের জন্য প্রবাস মেলা’র কলা-কুশীলবদের আন্তরিক ধন্যবাদ জানান।
উল্লেখ্য, আনোয়ারা সৈয়দ হক একজন খ্যাতনামা মনোরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ও কথাসাহিত্যিক। তিনি বেশ কিছু গল্পগ্রন্থ, উপন্যাস, প্রবন্ধ, কাব্যগ্রন্থ ও শিশুসাহিত্য রচনা করেছেন। একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ হিসেবে তার রচনায় মানুষের মনস্তাত্ত্বিক দিকগুলো তিনি তার সুক্ষ্মবোধ দিয়ে তুলে ধরেছেন।

আনোয়ারা সৈয়দ হক পেশায় ডাক্তার হলেও কথাসাহিত্যিক হিসেবে তিনি ব্যাপকভাবে পরিচতি। তার প্রথম ছোটগল্প ‘পরিবর্তন’ ১৯৫৪ সালে দৈনিক সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। ১৯৫৫ সাল থেকে ১৯৫৭ সাল পর্যন্ত তিনি নিয়মিত দৈনিক ইত্তেফাকের কচি কাঁচার আসরে লিখতেন। মাইকেল মধুসূদন কলেজে পড়াকালীন দৈনিক আজাদ, মাসিক মোহাম্মদী ও গুলিস্তা পত্রিকায় তার লেখা গল্প, কবিতা প্রকাশিত হত। গুলিস্তা পত্রিকায় লিখে তিনি পুরষ্কৃতও হয়েছেন। ঢাকা মেডিকেল কলেজে পড়াকালীন লেখালেখির পাশাপাশি তিনি কলেজের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের সাথে জড়িয়ে পড়েন। এই সময়ে ঢাকা থেকে প্রকাশিত প্রথম শ্রেণীর পত্র-পত্রিকা ও বিভিন্ন মেডিকেল জার্নালে তার লেখা ছাপা হত। তার প্রথম উপন্যাস ১৯৬৮ সালে সচিত্র সন্ধানীতে প্রকাশিত হয়। তার সেই প্রেম সেই সময় ও বাজিকর উপন্যাসে সাধারণ মানুষের দুঃখ-দুর্দশা ও আশা-আকাঙ্ক্ষার কথা বর্ণিত হয়েছে। নরক ও ফুলের কাহিনী উপন্যাসে লিখেছেন তার ছেলেবেলার কথা। বাড়ি ও বণিতা উপন্যাসে চিত্রায়িত হয়েছে মধ্যবিত্ত পরিবারের সামাজিক সমস্যা। উপন্যাস ছাড়া তিনি শিশুদের জন্য সাহিত্য রচনা করেছেন। ১৯৭৭ সালে ছানার নানার বাড়ি, ১৯৮৬ সালে বাবার সাথে ছানা, ছানা এবং ১৯৮৭ সালে মুক্তিযুদ্ধ ১৯৯০ সালে তৃপ্তি, আবেদ হোসেনের জোৎস্না দেখা, ১৯৯২ সালে হাতছানি, আগুনের চমক এবং মুক্তিযোদ্ধার মা নামক শিশুতোষ গল্প ও উপন্যাসগুলি প্রকাশিত হয়।

সাহিত্য রচনায় অনন্য অবদানের জন্য তিনি অনেক পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন। তারমধ্যে রয়েছে ভাষা ও সাহিত্যে একুশে পদক (২০১৯), আনন্দ আলো শিশুসাহিত্য পুরস্কার (২০১৯), বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার (২০১০), কবীর চৌধুরী শিশুসাহিত্য পুরস্কার (২০০৭), ব্যাংক সাহিত্য পুরস্কার (২০০৬), অনন্যা সাহিত্য পুরস্কার, মাইকেল মধুসূদন পুরস্কার, শিশু একাডেমি পুরস্কার।
আনোয়ারা সৈয়দ হক এর ১৯৪০ সালের ৫ নভেম্বর তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের (বর্তমান বাংলাদেশ) যশোর জেলার চুড়িপট্টি গ্রামে এক মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। সেখানে তার শৈশব ও কৈশোর কাটে। তিনি যশোর জেলার চুড়িপট্টির মোহনগঞ্জ প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন করেন। মধুসূদন তারাপ্রসন্ন উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক ও ১৯৫৮ সালে মাইকেল মধুসূদন দত্ত স্কুল ও কলেজ থেকে আইএসসি পাস করেন। তিনি ইংরেজি সাহিত্যে পড়তে চাইলেও তার বাবার আগ্রহে তাকে মেডিকেলে ভর্তি হতে হয়। ১৯৫৯ সালে তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন এবং ১৯৬৫ সালে এমবিবিএস পাস করেন। পরে ১৯৭৩ সালে উচ্চ শিক্ষার জন্য লন্ডন যান। তিনি সেখান থেকে ১৯৮২ সালে মনোবিজ্ঞানে এমআরসি ডিগ্রী লাভ করে দেশে ফিরে আসেন এবং ১৯৮৪ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজে মনোরোগ বিভাগে সহকারী প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৮৯ সাল থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত তিনি জাতীয় মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রের পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। পরে ১৯৯৩ সাল থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত ছিলেন ঢাকার মানসিক স্বাস্থ ইন্সটিটিউটের পরিচালক ও প্রভাষক। ১৯৯৮ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে অবসর নেন। এরপর তিনি আবার যুক্তরাজ্য গমণ করেন। ১৯৯৯ সাল থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত তিনি যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন হাসপাতালে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

আনোয়ারা সৈয়দ হকের বাবা গোলাম রফিউদ্দিন চৌধুরী ছিলেন একজন ব্যবসায়ী ও মা আছিয়া খাতুন একজন গৃহিণী। ১৯৬৫ সালে তিনি সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হকের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। এই দম্পতির দুই সন্তান। মেয়ে বিদিতা সৈয়দ হক একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের শিক্ষক। ছেলে দ্বিতীয় সৈয়দ হক একজন আইটি বিশেষজ্ঞ, গল্পকার ও গীতিকার। তিনি যুক্তরাজ্যের রিচমন্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইন্টারন্যাশনাল ফিনান্সিয়াল ম্যানেজমেন্ট বিষয়ে এমবিএ পাস করেন।