মকবুল হোসেন তালুকদার:
(মুজিব বর্ষে স্মৃতির পাতা থেকে) ১৯৭১ সালের অগ্নিঝরা ৭ মার্চ ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ দিন।এইদিন বিশ্বের মেহনতি মানুষের বিপ্লবী কন্ঠস্বর হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রেসকোর্স ময়দানে লক্ষ কোটি মুক্তিকামী বীর জনতার উদ্দেশ্যে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন। আমরা কৃষিবিশ্ববিদ্যালয়ের ছাএলীগের নেতা কর্মীরা ঐ জনসভায় যোগদান করবো বলে সিদ্ধান্ত হয়। সেই মতে ৬ই মার্চ আমাদের সোহরাওয়ার্দী হল থেকে আমি, সাইফুল, নিজাম, মতিন, গিয়াস, রফিক, চন্দ, আরেফিন, আফজাল, মুরাদ সহ ২০/২৫ জন দল বেঁধে রাএের ট্রেনে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেই। সারা রাস্তার প্রায় প্রত্যেক ষ্টেশন থেকেই হাজার হাজার বীর জনতা ট্রেনে উঠার ফলে ট্রেনে দাঁড়িয়ে থাকার মতোও স্থান ছিলনা। সংখ্যার চাপে ট্রেনও খুব ধীর গতিতে চলতে থাকে। সকাল ১০-১০:৩০ টার দিকে কমলাপুর ষ্টেশনে নেমে ওখানেই গোসল হাতমুখ ধুয়ে নাস্তা সেরে পায়ে হেটে রেসকোর্স ময়দানের দিকে রওনা দেই এবং সভাস্থলে হাজির হই বেলা আনুমানিক ১:০০-১:৩০ টার দিকে।
তখন রেসকোর্স ময়দান লোকে লোকারন্য। কোনভাবে এদিক সেদিক ধাক্কা দিয়ে জায়গা করে নিয়ে এক পর্যায়ে সভা মঞ্চের খুব কাছাকাছি চলে যাই। মাথার উপর হেলিক্পটার চক্কর দিচ্ছে। ধারনা করছিলাম সভায় আগত স্বাধীনতাকামী জনতাকে ভয় দেখানোর জন্যই পাকবাহিনী এধরনের তৎপরতা চালাচ্ছে। এরই মধ্যেই এলো সেই মহেন্দ্রক্ষণ। বীরদর্পে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব প্রথমে সামান্য হেঁটে এবং পরে সিঁড়ি বেয়ে মঞ্চে এসেই উপস্থিত লক্ষ জনতাকে অভিবাদন জানিয়ে তার চিরায়ত বজ্র কন্ঠে বলে উঠলেন,” ভায়েরা আমার, আজ ঢাকা, চট্টগ্রাম,……., কি অন্যায় করেছি আমরা,……… আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি, তোমাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করবা, মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দিবো, দেশকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনসাল্লাহ। প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল …., এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা”।

বঙ্গবন্ধু সেদিন ধরেই নিয়েছিলেন যে স্বাধীনতা ঘোষণা দেয়ার সাথে সাথেই পাকি হায়নারা সভাস্থলেই তাঁকে মেরে ফেলতে পারে এবং আমরাও শংকিত ছিলাম। তাইতো বঙ্গবন্ধু জীবনের মায়া ত্যাগ করে পৃথিবীর ইতিহাসের সর্ব শ্রেষ্ঠ ভাষণটি দিয়েছিলেন। সভায় আগত লক্ষ জনতার পিনপতন নিরবতার মধ্যে একাগ্রচিওে
বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনছিলাম এবং আমার প্রতিটি শিরা উপশিরায় রক্তের শিহরণ অনুভব করছিলাম; আমার কেবলি মনে হচ্ছিল এখনি যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ি। সভা শেষে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে গিয়ে বাঁশের লাঠি নিয়ে গেরিলা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ মহড়া শুরু করি এবং পরবর্তীতে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিই। পরিশেষে উল্লেখ করতে চাই যে, জাতির জনক
বঙ্গবন্ধুর বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ স্বাধীনতার ঘোষণা সম্বলিত ভাষণ প্রদানের মুহূর্তে ইতিহাসের প্রত্যক্ষ স্বাক্ষী হিসাবে উপস্থিত থাকতে পেরে এবং বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ মোতাবেক মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহন করতে পেরে আমি নিজেকে ভাগ্যবান মনে করি। গর্ব অনুভব করি এবং এটাই আমার জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন ও আমার অহংকার।
লেখক: মুক্তিযোদ্ধা ও কৃষিবিদ, আমেরিকা প্রবাসী।