১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকান্ড কোনো সাধারণ অভ্যুত্থানের ঘটনা ছিল না। এটি ছিল জাতীয় চেতনাকে ধ্বংস করা বা দেশকে পুনরায় পিছিয়ে দেবার একটি সুপরিকল্পিত চক্রান্তের অংশ। এই একই চক্রান্তের ধারাবাহিকতায় সংগঠিত হয় ৩ নভেম্বরের জেল হত্যাকান্ড। এসব হত্যাকান্ড কোনো বিচ্ছিন্ন বা কাকতালীয় ঘটনা ছিল না। পরাজিত শক্তি বাঙ্গালি জাতির মূল্যবোধকে ধ্বংস করে দেবার সুগভীর চক্রান্তের অংশ হিসেবেই এসব হত্যাকান্ড ঘটায়। পরাজিত শক্তি বলতে আমি শুধু ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের যারা সরাসরি বিরোধিতা করেছিল বা পাকিস্তানের পক্ষাবলম্বন করেছিল তাদের বুঝাচ্ছি না। ১৯৪৮ সালেই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অনুধাবন করতে পেরেছিলেন যে, পাকিস্তান নামক অদ্ভূত রাষ্ট্র কাঠামোর মধ্যে বাঙ্গালি জাতীয়তাবাদের বিকাশ বা বাঙ্গালির অধিকার অর্জন করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠি প্রথমেই আমাদের মাতৃভাষার উপর আঘাত হানে। পাকিস্তানের সংখ্যাগুরু বাঙ্গালিদের ভাষা বাদ দিয়ে তারা উর্দুকে রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দানের উদ্যোগ গ্রহণ করে। তখন বাঙ্গালিরা তীব্র প্রতিবাদে ফেটে পড়ে। একে একে অর্থনৈতিক, সামাজিক বৈষম্যগুলো সাধারণ মানুষের নিকট স্পষ্ট হয়ে উঠতে থাকে। ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, পরবর্তীতে ৬ দফা আন্দোলন, ১৯৭০ সালের জাতীয় নির্বাচন এবং তারই ধারাবাহিকতায় পরবর্তীতে মুক্তিযুদ্ধ এই ঘটনাগুলো ধারাবাহিকভাবে ঘটে যেতে থাকে।
বাঙ্গালির প্রতিটি আন্দোলনেই কিছু বাঙ্গালি বিরোধিতা করেছে। বাঙ্গালিরা যাতে কখনোই তাদের ন্যায্য অধিকার ভোগ করতে না পারে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠি সেই চেষ্টাই করেছে। বলা হয়, মুক্তিযুদ্ধের সময় সমগ্র জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। কিন্তু আমি এটা বিশ্বাস করি না। মুক্তিযুদ্ধ বলি বা অন্য যে কোনো আন্দোলনের কথাই বলি না কেনো আমরা কখনোই শতভাগ ঐক্যবদ্ধ ছিলাম না। মুক্তিযুদ্ধের সময়ও কিছু মানুষ এর বিরোধিতা করেছে। বঙ্গবন্ধু যখন ঐতিহাসিক ৬ দফা ঘোষণা করেন তখন অনেকেই এর বিরোধিতা করেছে। ছয় দফার ভিত্তিতে অনুষ্ঠিত ‘৭০-এর নির্বাচনে ২৩.৭৪ শতাংশ বাঙ্গালি ভোটার নৌকা মার্কার বিপক্ষে ভোট দিয়েছিল। যখন রেডিও-টিভিতে রবীন্দ্র সঙ্গীত নিষিদ্ধ করা হয় তখনও বেশ কিছু বুদ্ধিজীবী রবীন্দ্র সঙ্গীত নিষিদ্ধ করার পক্ষে ছিল। তখন ১০ জন বুদ্ধিজীবী এর বিরুদ্ধে বিবৃতিও দিয়েছেন এবং ৪০ জন বুদ্ধিজীবী এর পক্ষে বিবৃতি দিয়েছেন। ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনের সময় থেকেই যারা এই অঞ্চলের মানুষের মুক্তবুদ্ধির কথা বলতেন। যারা প্রগতির কথা বলতেন বা অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতার স্বপ্ন দেখতেন তাদের ভারতের চর বা দালাল বলা হতো। অপবাদ দেয়া হতো যে, ভারতীয় চরেরা এ দেশে ইসলামকে ধ্বংস করার চক্রান্ত করছে। তারা পাকিস্তানি শাসকদের যে কোনো কাজকেই ইসলামের সঙ্গে যুক্ত করে বৈধতা দেবার চেষ্টা করতো। পুরো পাকিস্তান আমল জুড়ে এই অবস্থা বিরাজ করে। তারা শুধু বুদ্ধিবৃত্তিক বিরোধিতা করেই ক্ষান্ত হয়নি। ১৯৭১ সালে এসে তারা সরাসরি পাকিস্তানি দখলদার সামরিক জান্তার পক্ষে অস্ত্র হাতে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। রাজাকার-আলবদর বাহিনী তৈরি করে তারা পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীকে সহায়তা করে। এদের অনেকেই পরবর্তীতে যুদ্ধাপরাধি হিসেবে মানবতা বিরোধি অপরাধের অভিযোগে বিচারের মুখোমুখি হয়েছে। স্বাধীনতা অর্জনের পর মনে করা হয়েছিল এই পরাজিত গোষ্ঠি হয়তো তাদের ভুল বুঝতে পেরে দেশ গঠনে অংশ নেবে। কিন্তু তারা তা না করে স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশেও তাদের অপকর্ম চালিয়ে যেতে থাকে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বপরিবারে নির্মমভাবে হত্যার মাধ্যমে এই গোষ্ঠিটি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। ১৯৪৮ সাল থেকে আমাদের এই দেশে যে সব প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠি ছিল, যারা বাঙ্গালি অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে ধ্বংস করার জন্য সব সময় সচেষ্ট ছিল তারা ক্ষমতাসীন হয়। ১৯৭১ সালে ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে আমরা স্বাধীনতা অর্জনের মাধ্যমে বাঙ্গালির হাজার বছরের ঐতিহ্য, সাংস্কৃতিক চেতনা এবং মূল্যবোধের প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি লাভ করি। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠি ক্ষমতাসীন হয়ে পুরো চিত্রটি পাল্টে দেয়। তারা আবারো পাকিস্তানি ভাবধারায় দেশ পরিচালনা করতে শুরু করে। রাতারাতি ‘বাংলাদেশ বেতার’ হয়ে যায় ‘রেডিও বাংলাদেশ’। ‘জয় বাংলার’ বদলে চলে আসে ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’। সাবেক পূর্ব পাকিস্তানের মূখ্য সচিব রাজাকার বাহিনীর সৃষ্টিকর্তা রাওফরমান আলীর ঘনিষ্ট সহচর শফিউল আলম হন কেবিনেট সচিব। আইয়ুব ইয়াহিয়ার প্রিয় ব্যক্তি কাজী আনোয়ারুল হক হলেন খুনি মোস্তাকের উপদেষ্টা। জেনারেল ওসমানী হলেন উপদেষ্টা, মাওলানা ভাসানীও খোন্দকার মোশতাককে অভিনন্দন জানালেন। ‘৭০ এর দশকে পুরো দুনিয়ায় বিভিন্ন দেশে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটেছিল। তখন বিশ্বব্যাপী সমাজতান্ত্রিক ব্লক এবং পুঁজিবাদি শক্তির মধ্যে দ্বন্দ্ব চলছিল। যে কারণে বিভিন্ন দেশে প্রায়শই সামারিক অভ্যুত্থান ঘটতো। কিন্তু সেসব সামরিক অভ্যুত্থানের মূল উদ্দেশ্য ছিল রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করা। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট স্বপরিবারে জাতির জনককে হত্যার মাধ্যমে শুধু রাষ্ট্র ক্ষমতায় পরিবর্তন আসেনি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং মূল্যবোধের মূলে কুঠারাঘাত করা হয়। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে যে নবীণ দেশটি আমরা লাভ করেছিলাম তাকে আবারো পিছিয়ে দেবার চেষ্টা করা হয়। তারা বাংলাদেশের ছদ্মাবরণে পূর্ব পাকিস্তান কায়েম করে। পাকিস্তানি চেতনা, মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে যার কবর রচিত হয়েছিল তা আবারো ফিরিয়ে আনা হলো। জামাত নেতা গোলাম আজম জেদ্দা থেকে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকান্ডে উল্লসিত হয়ে নতুন সরকারকে স্বীকৃতি দেয়ার জন্য মুসলিম দেশগুলোর প্রতি আহবান জানান। প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠি প্রকাশ্যে মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। তারা এই দেশটিকে মুসলিম বাংলা করার চেষ্টায় রত হয়। তারা বাংলাদেশকে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ঘোষণার দাবি উত্থাপন করতে থাকে। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় বিভিন্ন ধরণের প্রতিক্রিয়াশীল রাজনৈতিক পার্টি গড়ে তোলা হলো। যারা মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত হয়ে রাজনীতি থেকে কার্যত নির্বাসিত হয়েছিল তাদের পুণরায় রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠা করা হলো। বঙ্গবন্ধু যুদ্ধাপরাধিদের বিচারের কাজ শুরু করেছিলেন। যারা মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনীর সমর্থনে খুন, ধর্ষণ বা অন্যান্য মানবতা বিরোধি অপরাধে নিজেদের যুক্ত করেছিল তাদের বিচারের কাজ শুরু করা হয়েছিল। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর সেই বিচার প্রক্রিয়া বন্ধ করে দেয়া হয়। যারা শুধু বিরোধিতার জন্য মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছে, কোনো ধরণের মানবতা বিরোধি অপরাধ করেনি তাদের মাফ করে দেয়া হয়। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন অত্যন্ত উদার মনের একজন মানুষ। তিনি ভেবেছিলেন, এদের ক্ষমা করে দিলে তারা নিজেদের ভুল বুঝতে পারবে এবং দেশের উন্নয়নে নিজেদের আত্মনিয়োগ করতে পারবে। কিন্তু কথায় বলে, ‘কয়লা ধুইলে ময়লা যায় না।’ বঙ্গবন্ধুর উদারতাকে এরা মূল্যায়ন না করে বরং তার বিরোধিতা করতে থাকে। দেশে বহুমুখি ষড়যন্ত্র শুরু হয়। মুক্তিযুদ্ধে বাঙ্গালি সেনা বাহিনীর অফিসারদের মধ্য অনধিক একশত জন অংশগ্রহণ করেন। আর পাকিস্তানি বন্দীশালা থেকে ফিরে আসে প্রায় এগারশ বাঙ্গালি সেনা অফিসার। পাকিস্তান থেকে যে সব বাঙ্গালি সেনা অফিসার ফিরে আসেন আমি বলি না তাদের সবাই মুক্তিযুদ্ধের বিরোধি ছিলেন কিন্তু তারা বাংলাদেশে পাকিস্তানি সেনা বাহিনী যে বর্বরতা চালিয়েছে তা প্রত্যক্ষ করতে পারেন নি। ফলে তারা সেই ভয়াবহতা সম্পর্কে সম্যক অবহিত ছিলেন না। ফলে তারা বুঝতে পারেনি স্বাধীনতার জন্য আমরা কি মূল্যটাই না দিয়েছি। সেনাবাহিনীর ভেতরেও পাকিস্তান ফেরৎ এবং মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারি সেনা কর্মকর্তাদের মাঝে এক ধরণের দ্বন্দ্ব শুরু হয়। স্থানীয়ভাবে কিছু রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটও তৈরি হলো। জাসদ নামক একটি উগ্রপন্থি রাজনৈতিক দল তৈরি হলো। তারা বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথা বলতে শুরু করে। কিন্তু বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের লেশমাত্র তাদের মধ্যে ছিল না। জাসদের সভাপতি অবসরপ্রাপ্ত মেজর জলিলের পরিণতি দিয়ে প্রমাণিত হয় যে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র বলে তাদের মাঝে কিছুই ছিল না। মেজর জলিল (অব:) মৃত্যুর আগে খেলাফৎ মজলিশে যোগদান করেন এবং পাকিস্তানে গিয়ে মারা যান। মুক্তিযুদ্ধের সময় শুধু যে জামাত-আল বদররাই মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছে তা নয়, যারা চিনাপন্থি কমিউনিষ্ট পার্টির কোনো কোনোটি মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল। তাদের এই বিরোধিতা মুক্তিযুদ্ধের পরও অব্যাহত থাকে। ১৯৭৩ সালে দ্বিতীয় বিজয় দিবস পালনের সময় সিরাজ শিকদার এবং তার দল বিজয় দিবসকে ‘কালো দিবস’ ঘোষণা করে ঢাকা শহরে হরতালের ডাক দেয়। মওলানা ভাসানী তাদের সেই ঘোষণাকে সমর্থন জানায়। স্থানীয়ভাবে সৃষ্ট এই রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র সব মিলিয়ে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে হত্যার জন্য ক্ষেত্র প্রস্তুত করা হয়। সিরাজ সিকদারের সর্বহারা পার্টি ও জাসদের গণবাহিনী একের পর এক থানা লুট ও দখল করতে থাকে। রক্ষী বাহিনীর সাথে বিভিন্ন জায়গায় যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। হরতাল, ব্যাপক বোমা হামলা, রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করা, সরকারি স্থাপনায় হামলা, পাটের গুদামে আগুন ইত্যাদি তৎপরতা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর সারা দেশে এক ধরনের থমথমে অবস্থা বিরাজ করছিলো। সেনাবাহিনীর মধ্যে বিশৃঙ্খলা চলতে থাকে। কারণ জুনিয়র কয়েক জন অফিসার বঙ্গভবন দখল করে নেয়। তারা অবৈধভাবে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলকারি খোন্দকার মোস্তাককে দিয়ে নানা ধরনের অন্যায় কাজ করাচ্ছিল। সামরিক বাহিনীর মধ্য থেকে কিছু অফিসার যারা সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে তারা সামরিক বাহিনীতে চেইন অব কমান্ড ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তারা ক্রমশ শক্তিশালী হয়ে উঠতে থাকে। যারা অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করেছিল বা বঙ্গবন্ধুকে স্বপরিবারে হত্যা করেছিল তাদের মনে ভয় ঢুকে যায়, যদি সামরিক বাহিনীতে শৃঙ্খলা ফিরে আসে, মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষ শক্তি আবার যদি ক্ষমতাসীন হয় তাহলে তাদের বিপদ হতে পারে। বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর সেনা বাহিনীতে যদি শৃঙ্খলা ফিরে আসে, সংবিধান যদি পুন:স্থাপিত হয় এবং জাতীয় সংসদ কার্যকর হয় তাহলে সংসদের নেতৃত্বে কারা আসবে এসব প্রশ্ন দেখা দেয়। অভ্যুত্থানকারিরা বুঝতে পারে জেলখানায় বন্দি ৪ জাতীয় নেতা বেরিয়ে আসবে এবং তারাই জাতীয় সংসদ ও সরকারের নেতৃত্ব দেবে। এই ৪ জাতীয় নেতা সম্পর্কে তাদের মনে ভয়-ভীতি ছিল। কারণ নানাভাবে চেষ্টা করে, চাপ দিয়ে এমন কি প্রলোভন দেখিয়েও এই চার নেতাকে তারা সরকারে নিতে পারেননি। মুক্তিযুদ্ধের সময় বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে এই চার নেতা ৯ মাস যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। কাজেই তাদের নেতৃত্বের গুণাবলি এবং ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে অভ্যুত্থানকারিরা সচেতন ছিল। বঙ্গবন্ধুর কোনো কোনো অনুসারি অভ্যুত্থানকারিদের সঙ্গে হাত মেলালেও এই চার জাতীয় নেতা ছিলেন সম্পূর্ণ আলাদা। কাজেই অভ্যুত্থানকারিরা তাদের বাঁচিয়ে রাখার সাহস করেনি। তারা বুঝতে পেরেছিল এই চার নেতাকে বাঁচিয়ে রাখা হলে এক সময় এরা বিপদের কারণ হতে পারে। এ ছাড়া এদের জনপ্রিয়তাও ছিল আকাশচুম্বি। অভ্যুত্থানকারিরা বঙ্গভবনে বসেই এই চার নেতাকে হত্যার পরিকল্পনা করে। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন নির্মম হত্যাকাণ্ড বিরল। জেলখানার কোনো জাতীয় নেতাকে গুলি করে হত্যা করার ঘটনা বিশ্ব রাজনৈতিক ইতিহাসে নজীরবিহীন।
জেলখানায় ৪ জাতীয় নেতাকে হত্যার ঘটনার সঙ্গে আমি মুক্তিযুদ্ধকালিন সময়ের ১৪ ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ডের মিল খুঁজে পাই। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠি এবং তাদের স্থানীয় দোসররা যখন দেখলো বাংলাদেশের স্বাধীনতা কোনভাবেই ঠেকানো যাচ্ছে না তখন তারা জাতিকে মেধাশূণ্য করার জন্য দেশের শ্রেষ্ঠ বুদ্ধিজীবীদের নির্মমভাবে হত্যা করে। বঙ্গভবনে অবস্থানকারী বিপথগামী সেনা কর্মকর্তারা যখন দেখলো মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষ শক্তির পাল্টা অভ্যুত্থান ঠেকানো যাচ্ছে না যখন তারা জেলখানায় বন্দি ৪ জাতীয় নেতাকে হত্যা করার পরিকল্পনা করে এবং নির্মমভাবে তা বাস্তবায়ণ করে। এই হত্যাকাণ্ডের জন্য খোন্দকার মোস্তাকের অনুমোদন ছিল। হত্যাকারিরা জেলখানায় যাবার পর জেলার তাদের বাধা দিয়েছিলেন। পরে জেলার মোস্তাকের সঙ্গে কথা বললে তিনি (মোস্তাক) বলেন, ‘তারা যা করতে চায় তা করতে দিন। কোনো ধরনের বাধা দেবেন না।’ জেল হত্যাকাণ্ড কোনো কাকতালীয় ঘটনা ছিল না। এটি ছিল একটি সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা বা ষড়যন্ত্রেরই অংশ। উল্লেখ্য মেজর ফারুক ও রশিদ দুই মাস আগে পাল্টা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সরকার পুন:প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করা হলে কারাগারে বন্দী চার নেতাকে হত্যার পরিকল্পনা করে। এই পরিকল্পনায় খন্দকার মোশতাকের সম্মতি ছিল। তখন বঙ্গভবনেই থাকতো ফারুক, রশিদরা। এমনকি রশিদ রাষ্ট্রপতির মর্যাদার গাড়ীটিও ব্যবহার করতেন।
৩ নভেম্বর ভোর রাতে ডিআইজি প্রিজন বঙ্গভবনে ফোন করলে রশিদই ফোন ধরেন। রশিদ খন্দকার মোস্তাকের নিকট ফোনের রিসিভার হস্তান্তর করেন। মোস্তাক ফোন ধরে বেশ কিছুক্ষণ শান্তভাবে শুনে বললেন হ্যাঁ, হ্যাঁ, হ্যাঁ। উপায়ন্তর না দেখে ডিআইজি প্রিজন মোসলেউদ্দিন ও তার দলকে আর বাধা দেয়ার চেষ্টা করেননি। তাজউদ্দিন আহমদ ও সৈয়দ নজরুল ইসলাম এক সেলেই ছিলেন। পাশের অন্য সেলটিতে ছিলেন ক্যাপ্টেন মনসুর আলী ও এএইচএম কামরুজ্জামান। তাদের একটি সেলে জড়ো করে গুলি করে হত্যা করা হয়। তিন জন সঙ্গে সঙ্গে মারা যান। অবশেষে রক্তক্ষরণে মারা যান তাজউদ্দিন আহমেদ। অভ্যুত্থানকারিরা এই চার নেতাকে বাঁচিয়ে রাখাটাকে নিরাপদ মনে করেনি। তাই তাদের হত্যা করা হয়। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা আর জেল হত্যা একই সূত্রে গাঁথা। জেল হত্যাকান্ডের মাধ্যেমে হত্যার রাজনীতি শেষ হয়নি।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে স্বপরিবারে হত্যার অনিবার্য ধারাবাহিকতা হচ্ছে একই বছরের ৩ নভেম্বর জেল হত্যাকান্ড। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে যে হত্যা ও ষড়যন্ত্রের রাজনীতি শুরু হয়েছিল তা পরবর্তীতেও অব্যাহত রয়েছে। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে জননেত্রী শেখ হাসিনার উপর বোমা হামলাসহ বিভিন্ন সময় তাকে হত্যার যে সব চেষ্টা চালানো হয়েছে তা সেই ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ডের ধারাবাহিকতা বলেই আমি মনে করি। এমনকি এক এগারোর সময় দৃশ্যত দুই নেত্রীকে দেশ থেকে বের করে দেবার যে প্রচেষ্টা (আসলে শেখ হাসিনাকেই শেষ করে দেবার চেষ্টা হয়েছিল) আমরা লক্ষ্য করি তাও সেই একই হত্যা ষড়যন্ত্রেরই ধারাবাহিকতা। ১৫ আগস্ট যারা অভ্যুত্থান ঘটিয়েছিল তাদেরই আত্মীয়-স্বজন ব্রিগেডিয়ার বারি, বিগ্রেডিয়ার আমিন পুরো রাষ্ট্রযন্ত্র দখল করে নিয়েছিল এক এগারোর পর। এই মহলটি এখনো চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশকে পাকিস্তানি ভাবধারায় নিয়ে যাবার জন্য। আজকে আমরা যাদের জঙ্গি বলি এরা কারা? বলা যেতে পারে এদের তো ১৯৭১ সালে বা ১৯৭৫ সালে জন্ম হয়নি। কিন্তু আপনি বিশ্লেষণ করলে দেখবেন এরা সেই পাকিস্তানি ভাবধারা অনুসরণ করে কিছু একটা করার চেষ্টা করছে। আমি এটা জোর দিয়ে বলতে পারি, বাংলাদেশে পাকিস্তানি ভাবধারার মানুষের অভাব নেই। বর্তমানে যে জঙ্গিবাদের উত্থান লক্ষ্য করা যাচ্ছে এদের টার্গেটও কিন্তু প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হাজার বছরের শ্বাশত বাঙ্গালির চেতনা এবং মূল্যবোধ ধারণ করে চলেছেন। তিনি অসাম্প্রদায়িক চেতনা ধারক এবং গণতন্ত্রের মানস কন্যা। এসব কারণে জঙ্গিরা শেখ হাসিনাকেই বার বার টার্গেট করছে।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনার উপর বারবারই আঘাত এসেছে। এই আঘাত আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে আরো শাণিত করেছে। যে কোনো প্রতিবন্ধকতা এলেই জাতীয়তা বোধ এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা শাণিত হয়। কারণ সব কিছু স্বাভাবিকভাবে চললে সেখানে চেতনা ততটা কাজ করে না। কিন্তু প্রতিবন্ধকতা এলেই চেতনাবোধ জাগ্রত হয়। বারবার মুক্তিযুদ্ধের চেতনার উপর আঘাত এসেছে বলেই আমাদের দেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ক্রমশ শাণিত হচ্ছে। এর সাম্প্রতিক উদাহরণ হচ্ছে যুদ্ধাপরাধী ও মানবতা বিরোধিদের বিচারের প্রসঙ্গটি। এই বিচার কার্য শুরু হলে নানামুখি ষড়যন্ত্র আরম্ভ হয়। বিচার বাধাগ্রস্থ হবার শঙ্কা দেখা দিলে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ শক্তির উদ্যোগে সৃষ্টি হয় গণজাগরণ মঞ্চ। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা রক্ষা করার জন্যই গণ জাগরণ মঞ্চ সৃষ্টি হয়। এটা হঠাৎ করেই সৃষ্টি হয়নি। এভাবে যখনই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার উপর আঘাত এসেছে তখনই মানুষ নতুন করে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। কাজেই বলা যায়, যতবারই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার উপর আঘাত আসবে ততই এই চেতনা শাণিত হবে।
লেখক: অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান, উপাচার্য, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।