মোহন রায়হান: ১৪ ফেব্রুয়ারি বিশ্বের বহু দেশে ভ্যালেন্টাই ডে বা ভালবাসা দিবস উদযাপিত হচ্ছে। বাংলাদেশে একই দিন ১লা ফাগুন বা বসন্তের শুরু। দুটো বিষয় একাকার হয়ে দিনটি রঙিন হয়ে উঠবে ফুলে ফুলে, সাজ সজ্জায় বিশেষত তরুণ-তরুণীদের কাছে। কিন্তু এই দিনটি আমরা যারা এদেশের ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, রাজনীতি, অর্থনীতির সমৃদ্ধি বা পরিবর্তন চেয়ে লড়াই সংগ্রাম করেছি এবং যারা জীবন দিয়েছে তাদের স্বজনদের জন্য দিনটি কেমন?
একেতো ভাষার মাস তারপরে সেদিন স্বৈরাচার এরশাদ আমাদের মিছিলের উপর গুলি চালিয়ে এতগুলো ছেলে মেয়েকে হত্যা করল অথচ সেইদিন তথাকথিত ‘ভ্যালেন্টাইন ডে’ মেনে নেয়া যায় না। ভ্যালেন্টাইন আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতির কে? তার মৃত্যু দিবসকে কেন্দ্র করে কেন আমাদের দেশে ভ্যালেন্টাইন দিবস বা ভালবাসা দিবস পালন করা হবে? সেদিনতো আমাদের ছাত্র হত্যা দিবস। এদিন আমাদের প্রতিবাদ বা প্রতিরোধ দিবস পালন করা উচিত। ভালোবাসা দিবস অন্যদিন হতে পারে।
বাংলাদেশ আর পশ্চিম বাংলায় কি একই দিন ১লা বৈশাখ পালন করা হয়? ১৯৮৩’র ১৪ ফেব্রুয়ারি আমাদের চোখের সামনে আমাদের সহযোদ্ধারা জীবন দিয়েছে। সেই দৃশ্য, সেই স্মৃতি আজও চোখে ভাসে। মিছিলের সম্মুখ ভাগেই ছিলাম, নিজেও তো মারা যেতে পারতাম। সেদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকে পুলিশ যে তান্ডব চালিয়েছিল, যে নির্মম নিষ্ঠুর নির্যাতনের পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছিল, ছাত্র ছাত্রীদের উপর বিশেষত মেয়েদের যে পৈশাচিকভাবে হেনস্তা করা হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিপূর্বে তা আর কখনো ঘটেনি। সহস্রাধিক ছাত্র, নেতা, কর্মীকে গ্রেফতার করে, পিটিয়ে সারারাত শাহবাগ পুলিশ কন্ট্রোল রুমের খোলা মাঠে শীত রাতে অভুক্ত অনিদ্রায় ফেলে রেখে পরের দিন কারাগারে পাঠানো হয়। কী করে সেইদিন আমরা ভালবাসা দিবস পালন করি? রং বেরঙের জামাকাপড় পরে রং মেখে সং সেজে ফুলে ফুলে সজ্জিত হয়ে রোমান ভ্যালেন্টাইনের স্মরণে ভ্যালেন্টাইন দিবস পালন করি?
সেদিন তো আমাদের সহযোদ্ধা শহীদ জয়নাল, জাফর, মোজাম্মেল, কাঞ্চন, দীপালী সাহাসহ আরো অনেক নিখোঁজ সাথীদের বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দেয়া কালো দিবস। স্বৈরাচার পতন এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মাইল ফলক দিবস। সেদিন কী করে বাংলাদেশের ভালবাসা দিবস হতে পারে? বরং আমি সবাইকে বিশেষত নতুন প্রজন্মকে অনুরোধ করব প্রতিবছর ১৪ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্টে এবং শিক্ষা ভবনের সম্মুখে ১৯৮৩’র শহীদ স্মৃতি স্তম্ভে দলে দলে ফুল হাতে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ করতে।
বিশ্বে এখন প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো দিবস পালন করা হয়। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম অনুভূতি ভালবাসা দিবস অবশ্যই পালন করব আমরা। পরস্পরের জন্য ভালবাসার উজ্জ্বলতম অতুলনীয় উদাহরণ তৈরি করব। হিংসা, বিদ্বেষ, হানাহানি, খুন, ধর্ষণ, নিপীড়নের সংস্কৃতির বিপরীতে অসীম, অনন্ত, অকৃত্রিম ভালবাসার এক সুকোমল, সুরভিত, ফুল্ল, আকাশ বাতাস কাঁপানো উল্লাসমুখর ভালবাসার উৎসব দিবস উদযাপন করব আমরা।
তবে আমাদের রক্তক্ষরণের, শোকের, দুঃখের, কান্নার স্বজন হারানোর ব্যথিত বেদনার দিন ১৪ ফেব্রুয়ারি নয়। অন্য কোনো তারিখ। অন্য কোনোদিন। অন্য কোনো সময়। অন্য রকম ভালবাসাময়।