কখনো সাহারা মরুভূমি, কখনো বিপদসঙ্কুল আফ্রিকান জঙ্গল, আবার কখনো বা সমুদ্রের তলদেশে গিয়েছেন। পৃথিবীর মানচিত্র একসময় যার অধ্যয়নে এবং স্বপ্নের মধ্যে ছিল, এখন তা তার হাতের মুঠোয়। ছোটবেলা থেকেই যে নারী স্বপ্ন দেখেছিলেন বাংলাদেশের পতাকা হাতে সারাবিশ্ব ঘুরবেন- আজ তার বিশ্বজয়ের স্বপ্ন পূরণ হতে চলছে। যার কথা বলছি তিনি নাজমুন নাহার। বাংলাদেশের এই গর্বিত নারী এখন পর্যন্ত লাল সবুজের পতাকা উড়িয়েছেন বিশ্বের ১২৫ টি দেশে। বাংলাদেশের কোনো মানুষের এই প্রথম এতগুলো দেশ ভ্রমণ। সম্প্রতি তিনি এসেছিলেন পাক্ষিক প্রবাস মেলা কার্যালয়ে। শুনিয়েছেন বিশ্বভ্রমণের কিছু গল্প। আলাপচারিতায় তার চুম্বক অংশ পাঠকদের জন্য তুলে ধরেছেন শহীদ রাজু।
বাংলাদেশের পতাকা হাতে তিনি বিশ্বশান্তির এক অনন্য দূত হিসাবেও কাজ করে যাচ্ছেন সারাবিশ্বে। ২০০০ সালে ইন্ডিয়া ইন্টারন্যাশনাল এডভেঞ্চার প্রোগ্রামে অংশ গ্রহণের মাধ্যমে তার প্রথম বিশ্বভ্রমণ শুরু হয়। সে সময় তিনি ভারতের ভুপালের পাঁচমারিতে যান। এটিই তাঁর জীবনের প্রথম বিদেশ ভ্রমণ। বিশ্বের ৮০টি দেশের ছেলেমেয়ের সামনে তখন তিনি প্রথম বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন। সেই থেকে বাংলাদেশের পতাকা হাতে তার বিশ্বযাত্রা শুরু। এরই ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি ২০১৮ সালের নভেম্বর থেকে ২০১৯ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত সড়কপথে ঘুরেছেন পশ্চিম আফ্রিকার ১৫টি দেশ। যাতে নাইজেরিয়ায় ১২৫তম দেশ হিসেবে ঘুরার রেকর্ড গড়েন। লাল সবুজের পতাকা হাতে বিশ্বপরিব্রাজক হিসেবে তিনি খ্যাতি লাভ করেন।
নাজমুন নাহার বলেন, ‘ছোটবেলায় বাড়ির পাশের মাঠে পাখি ধরতে চাইলেই পাখি উড়ে যেত আকাশে। তখন আমার মনে হতো আমিও যদি এভাবে উড়ে যেতে পারতাম সীমানাহীন দেশ থেকে দেশান্তরে। ছোট থেকেই আমি মানচিত্র দেখলে তাকিয়ে থাকতাম। কোন দেশের সঙ্গে কোন দেশ লেগে আছে তা দেখতাম, কোথাকার মুদ্রার নাম কি? রাজধানী কোথায়? এগুলো দেখে ভেতরে আকাংখা তৈরি হতো যে একদিন আমি বিশ্বভ্রমণে যাব। এভাবে আমার বিশ্বভ্রমণ করার স্বপ্ন জেগে উঠে। ছোটবেলায় স্বপ্নের মধ্যেও পাখিদের মতো উড়তাম। সেই ইচ্ছাই আজকে আমাকে এখানে নিয়ে এসেছে।’
স্বপ্ন তার পুরো বিশ্বভ্রমণ করার
জীবনের সব চাওয়া পাওয়াকে নাজমুন নাহার মিলিয়েছেন দেশ ভ্রমণ ও সেখানে বাংলাদেশের পতাকা উড়ানোর মধ্যে। আর জীবনের এই কঠিন ব্রতটিকে সঙ্গী করেই তিনি যেতে চান আরও অনেক দূর, ফেরি করতে চান লাল সবুজের পতাকাটিকে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তির মধ্যেই তিনি জাতিসংঘের সদস্য ১৯৩ টি দেশে ভ্রমণ শেষ করতে চান বলে জানান।
হৃদয়ে যার বাংলাদেশ
নাজমুন বলেন, ”যে দেশের মানুষ তার কাজের মাঝে, আবিষ্কারের মাঝে দেশের কথা ভেবে কাজ করবে, সে দেশ অনেক এগিয়ে যাবে; তাই আমাদের সবাইকে দেশের কথা ভেবেই নিজের কাজের মাঝে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে। আমি বিশ্ব দেখছি বাংলাদেশের লাল সবুজের পতাকা হাতে নিয়ে, এটা আমার দেশাত্ববোধ থেকে করছি, কারণ পতাকা ভাবনা আমার কাছে দেশ প্রেমের একটি চিহ্ন।” তিনি বলেন, বাংলাদেশের পতাকা হাতে যখনি আমি নতুন কোনো দেশের সীমান্তে পা দিয়েছি তখনই আমার সাথে যেন জেগে উঠেছে সতের কোটি বাঙালির প্রাণ। নারীশক্তির যে বহি:প্রকাশ, বাঙালিরা যে অনেক কিছু করতে পারে সেটা প্রমাণের জন্যও আমি দুর্গম এলাকাগুলোতে সড়ক পথে ভ্রমণ করি।
বাংলাদেশের পতাকা হাতে নাজমুন নাহার বিশ্বশান্তির এক অনন্য দূত হিসাবেও কাজ করে যাচ্ছেন সারাবিশ্বে। এ পর্যন্ত বিশ্বের বিভিন্ন মহাদেশে প্রায় লক্ষাধিক শিশু বা শিক্ষার্থীর সাথে বাংলাদেশের লাল সবুজের পতাকাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। পথে পথে তিনি স্কুল, কলেজ ও প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের কাছে বিশ্বশান্তির বার্তা পৌঁছিয়ে দেন।
সম্প্রতি ঘানা ইন্টারন্যাশনাল মিশন স্কুল, গাম্বিয়ার ‘সানায়াঙ আপার স্কুল সহ পশ্চিম আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের ১৭ টি স্কুলে প্রায় চল্লিশ হাজারেরও বেশি শিশুদের সাথে বাংলাদেশের ইতিহাস ও সংস্কৃতির কথা তুলে ধরেন এই মহীয়সী নারী।
আজকের এই অবস্থায় আসতে আপনি কাকে অনুপ্রেরণা হিসেবে পেয়েছেন জবাবে কৃতি এই প্রবাসী বলেন, বাবা আমায় সব কিছুতেই অনুপ্রেরণা দিতেন। ভালো কোনো কিছু করতে তার যেন না নেই। পরীক্ষায় খারাপ করলেও মাথা মুছে দিয়ে বলতেন পরেরবার ভালো করবে, মন খারাপ করো না। বাবা আদর দিয়ে পথ দেখাতেন। পরীক্ষার হলের সামনে চকলেট নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেন, একজন বাবা যে একটি সন্তানের নৈতিক ও সুস্থ চিন্তাশক্তি বিকাশে অনেক বড় ভূমিকা রাখতে পারে তা আমি দেখেছি।
তিনি বলেন, বাবার কাছে দেশ বিদেশের অনেক ভ্রমণ কাহিনী শুনতাম, এছাড়াও আমার দাদা আলহাজ¦ মৌলভী আহাম্মদ উল্লাহ একজন ভ্রমণপিয়াসু মানুষ ছিলেন। তিনি ১৯২৬ থেকে ১৯৩১ সময়কালে আরবের অনেক দেশেই ভ্রমণ করেছেন। এসব বিষয়গুলো আমাকে পৃথিবী ভ্রমণে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে। একদিন আমার মা আমার জন্য দোয়া করেছেন আল্লাহ যেন আমাকে সারা বিশ্বভ্রমণের সুযোগ করে দেন। তাছাড়াও পড়াশুনায় ভালো ছিলাম বলে শিক্ষকরাও আমায় খুব ভালোবাসতেন। সবাই আমাকে ভালো কাজে অনেক উৎসাহ দিতেন।
বই পড়াতেও কম যান না নাজমুন নাহার, তিনি বলেন, বইয়ের মাঝেও আমি খুঁজে বেড়াই পুরো পৃথিবীকে।
সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘দেশে বিদেশে’, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘ছবির দেশে’ কবিতার দেশে, জ্যাক কেরুয়াকের ‘অন দ্য রোড’, এরিক উইনারের ‘দ্য জিওগ্রাফি অব ব্লিস’ সুজানা রবার্টসের ‘অলমোস্ট সাম হয়্যার’, চেরিল স্টেরয়েডের ‘ওয়াইল্ড: ফ্রম লস্ট টু ফাউন্ড’ ‘অন দ্য প্যাসিফিক ক্রেস্ট ট্রেইল’ এবং মাসুদ রানা সিরিজের বই সহ বিভিন্ন ভ্রমণবিষয়ক বই আমাকে ভীষণভাবে বিশ্বভ্রমণে উৎসাহিত করেছে।
জন্ম ও শিক্ষা জীবন
নাজমুন নাহারের জন্ম লক্ষীপুর জেলায়। ৫ বোন ও ৩ ভাইয়ের মধ্যে তিনি সবার ছোট। বাবা মোহাম্মদ আমিন ছিলেন একজন ব্যবসায়ী। মা তাহেরা আমিন ছিলেন বাবার অতন্দ্র সহযোগী। দালালবাজার সরকারি উচ্চবিদ্যালয় ও লক্ষীপুর সরকারি কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট শেষ করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে তিনি স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। ২০০৬ সালে শিক্ষা বৃত্তি নিয়ে সুইডেনের লুন্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। আবার আমেরিকা থেকে এশিয়ান স্টাডিজ বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রি লাভ করেন। এছাড়াও নাজমুন দক্ষিণ কোরিয়ার সিউল ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে ‘হিউমান রাইটস এন্ড এশিয়া’ বিষয়ে স্কলারশিপ পেয়ে আরেকটি ডিগ্রি অর্জন করেন।
ভ্রমণের সময় ও অর্থ কিভাবে সংগ্রহ করেন- এমন প্রশ্নে জবাবে নাজমুন নাহার জানান, ইচ্ছা, ধ্যান, প্রার্থনা আর সাধনাই হল মূলকথা। আমি নিজের উপার্জনের টাকা দিয়ে দেশ ভ্রমণ করি। বাবা মা’র টাকায় নয়। ঘুরতে খুব সামান্য টাকাই লাগে। আমি আমার প্রার্থনাতেও ভ্রমণের জন্য প্রার্থনা করি। এগুলোই আসলে আমাকে আজকে এখানে নিয়ে এসেছে। আমি সুইডেন থাকি। এমনও সময় গেছে আমি সামারের ৩ মাস প্রতিদিন ১৮ ঘন্টা করে কাজ করে টাকা জমিয়ে ভ্রমণ করেছি। তাছাড়া বাই রোডে আমি বেশি ভ্রমণ করি। এতে খরচ অনেক কম হয়। বাই রোডে ভ্রমণের অরেকটি সুবিধা হল প্রকৃতি, মানুষ সহ অনেক কিছুর সৌন্দর্য্য ভালোভাবে উপভোগ করা যায়। এছাড়াও ইউরোপে ১০/১২ ডলারে প্লেন টিকিটের বিভিন্ন অফার পাওয়া যায়। তখন ভ্রমণ করি। কম খরচে ভ্রমণ করার জন্য আমি বিভিন্ন দেশের স্থানীয় মানুষদের পরিবারের সঙ্গেই থাকার চেষ্টা করে থাকি।
নাজমুন নাহার তার মাকে নিয়েও ঘুরেছেন ইউরোপ ও আমেরিকার ১৪ টি দেশ। আল্পস পর্বতমালা থেকে শুরু করে বহু দর্শনীয় স্থানে ঘুরেছেন মাকে নিয়ে। ২০১১ সালে সুইজারল্যান্ডে আল্পস পর্বতমালায় সবচেয়ে উঁচু জায়গা ইয়াংপুতে মাকে নিয়ে ঘুরার মুহূর্তটি তার জীবনের অন্যতম স্মরণীয় দৃশ্য বলে জানান নাজমুন নাহার। এছাড়া তিনি মাকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের এমট্রাস্ট ট্রেনে চেপে শিকাগো থেকে ক্যান্সাস পর্যন্ত ভ্রমণ করেন।
ছোটবেলা থেকেই পড়াশুনার পাশাপাশি নাজমুন নাহার বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের মাধ্যমে সবসময় অবহেলিত মানুষদের জন্য কাজ করতেন। ২০১০ সালে সুইডিশ আন্তর্জাতিক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন সুয়েডওয়াচ এ কাজ করেন। বাংলাদেশ গার্লস গাইড এসোসিয়েশন, ইয়ুথ এন্ডিং হাঙ্গার, বাংলাদেশ ন্যাশনাল ক্যাডেট কোর সহ বিভিন্ন সংগঠনের এক্টিভ লিডারশীপের মাধ্যমে বহুবছর মানুষের জন্য কাজ করেছেন তিনি। তার সেই মানবতাবোধের চেতনা এখন ছড়িয়ে পড়ছে বিশ্বব্যাপী। একজন নারী হিসেবে একাই শতাধিক স্বাধীন দেশ ঘুরে বিশ্ববাসীকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন নাজমুন নাহার। তার এই মাইলফলককে সম্মাননা দিয়েছেন জাম্বিয়া সরকারের গভর্নর হ্যারিয়েট কায়েনা। জাম্বিয়া সরকারের গভর্নরের কাছ থেকে পেয়েছেন ফ্ল্যাগগার্ল উপাধি।
বাংলাদেশের লাল সবুজের পতাকা হাতে প্রথম বিশ্বজয়ী নারী পরিব্রাজক নাজমুন নাহারের জীবন, শিক্ষা আর এই বিশ্বভ্রমণ যাত্রার উদ্দীপনার পাশাপাশি দেশাত্ববোধের চেতনা এই দেশের প্রতিটি তরুণ-তরুণীকে জাগিয়ে তুলবে। ইতিহাসজয়ী এই নারী পরিব্রাজক কে যুগ যুগ ধরে মনে রাখবে বাংলাদেশের মানুষ।