মনির আহমদ, সিঙ্গাপুর সিটি, সিঙ্গাপুর: গ্রেট বিক্রমপুরের একটি সম্ভ্রান্ত জনপদের নাম মূলফৎগঞ্জ। ইতিহাস সাক্ষী দেয় ১৮৪৫ সালে এই জনপদের আওতাধীন ছিল বর্তমান শরীয়তপুর জেলা ও মাদারীপুর জেলার কিয়দংশ।
এই মূলফৎগঞ্জ জনপদের কোল ঘেষেই বার ভূঁইয়ার অন্যতম বিপ্লবী কেদার রায় প্রাসাদ নির্মাণের কাজ শুরু করেছিলেন, ১৬০২ সালে কেদার রায় যুদ্ধে নিহত হওয়ায় তার কাজ আর সমাপ্ত হয়নি। বিখ্যাত মানচিত্রকর জেমস রেনেল এই জনপদের পাশ দিয়েই নৌকাভ্রমণ করেছিলেন ১৭৭০ দশকে। দক্ষিন বিক্রমপুরের সম্ভ্রান্ত চারটি জনপদের ৩টিই পদ্মানদীতে বিলীন হয়েছে বহু আগে। কেদার রায়ের জন্মভূমি আড়া ফুলবাড়িয়া গ্রাম, কেদার রায়ের রাজধানী শ্রীপুর, রাজা রাজবল্লভের রাজনগর এই তিনটি জনপদ পর্যায়ক্রমে নদীতে বিলীন হলেও পদ্মাপারেই টিকে ছিল মুলফৎগঞ্জ বাজার যার, অর্ধাংশ এখন চলে গেছে পদ্মায়। বাকি অংশটুকুও সপ্তাহখানেকের ভেতর বিলীন হয়ে যাবে।
এই জনপদকে দীর্ঘদিন লালনপালন করেছিলেন মরহুম আব্দুল করিম দেওয়ান ওরফে মনাই দেওয়ান। তার প্রচেষ্টায় এখানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে জেলার প্রথম স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। মনাই দেওয়ান ছিলেন বৃহত্তর ফরিদপুরের অন্যতম পরিচিত ব্যক্তিত্ব, তার বসতবাড়ি, তার বংশধরের সবাই আজ বাস্তুচ্যুত।
হাসপাতালকে কেন্দ্র করেই এই জনপদে গড়ে উঠেছিল জেলার বিখ্যাত চিকিৎসাকেন্দ্র।
ইতিমধ্যে বিলীন হয়ে গেছে ৩তলার দেওয়ান ক্লিনিক, অর্ধশত ঔষধের দোকান, লাইভ কেয়ার হসপিটালের এক তৃতীয়াংশ নদীগর্ভে চলে গেছে। কত মসজিদ, মন্দির শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবার পদ্মায় বিলীন হয়ে গেলো, ৮সেপ্টেম্বর আমি যখন লিখছি তার ঘন্টা তিনেক আগে নদীতে চলে গেছে সাধুর বাজারের রামঠাকুর মন্দির।
এই জনপদেই প্রায় দুইশত বছর আগে আরব থেকে কোলকাতা হয়ে আগমন করেন আলহাজ্ব শরীয়উল্লাহ্ মক্কী (ফরায়েজি আন্দোলনের নেতা হাজী শরীয়ত উল্লাহ্ নয়) তার বংশধর মরহুম আব্দুল আজিজ (র.) প্রতিষ্ঠা করেছেন মুলফৎগঞ্জ আজিজিয়া জ্বালালিয়া মাদ্রাসা যা বৃহত্তর ফরিদপুরের মাঝে অন্যতম এবং বাংলাদেশের হাফেজিয়া মাদ্রাসার মাঝে অন্যতম।
জুলাইয়ের মাঝামাঝি শুরু হওয়া এই ভাঙনে বিলীন হয়ে গেছে ঐতিহ্যবাহী কেদারপুর ইউনিয়ন থেকে চর জাজিরা, চর নড়িয়া, সাহেবের চর গ্রাম। মুলফৎগঞ্জের সাথে প্রধান সংযোগ সড়কও বিলীন হয়েছে আগস্টে, মুলফৎগঞ্জ বাজার যে এই ভাঙনে আর রক্ষা হবে না এটা নিশ্চিত হয়ে গেছে জনগণ।
এতো দুর্যোগ নামলো বাংলাদেশে, সাইক্লোন হয়, সুনামি হয়, ৭১ এর ভয়াবহতা মোকাবেলা করলো এই দেশ। আমার নড়িয়া কখনো এতো বড় দুর্যোগ মোকাবেলা করে নাই, এতো কান্দন কখনো কান্দে নাই আমার মানুষ।
আগস্টের প্রথম সপ্তাহে সাধুর বাজার ডুবে গেলো অসংখ্য মানুষ, দোকানপাট ও যানবাহন নিয়ে যাদের আর খুঁজে পাওয়া যাইনি। আমার মানুষেরা কী অপরাধ করেছিল জানি না, তবে মনে হয় তাদের বড় অপরাধ তারা মুজিবকে ভালোবেসেছিল।
মুজিব, মুজিব আহাজারি করা এই নড়িয়ার মানুষ মুজিব ও আওয়ামীলীগের জন্য কী করেনি?
প্রতিটি সুষ্ঠু নির্বাচনে এখানে নৌকা মার্কা বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়েছে। আমার অঞ্চলের অতি সাধারণ বৃদ্ধেরা সবকিছু সহ্য করলেও শেখের (শেখ মুজিবের) নামে কিংবা শেখের বেটির(শেখ হাসিনা) নামে কুৎসা কখনো সহ্য করেনি, এখন এই এক কাপড়ে ঘরদোর নদীতে ভাসিয়েও সহ্য করে না।
মুজিবকে এমন স্পর্শকাতর জায়গায় ঠাই দিয়েছেন যে, কখনো আওয়ামীলীগ কিংবা নৌকার প্রশ্নে নিজের স্বার্থ খোঁজেননি।
এই বৃদ্ধেরা মুজিবকে ভালোবাসার প্রতিদানযে এভাবে পাবে তা কখনো কল্পনাও করেনি। এই বৃদ্ধদের মৃত্যুও হবে খুব কষ্টের, ভিটেমাটি নাই কবরটা কোথায় হবে তাও তো ঠিক নাই।
আহা!
প্রবাসীদের রক্তঘামের পয়সায় সমৃদ্ধ হয়েছে, উন্নত হয়েছে, নান্দনিক হয়েছে এই জনপদ।
এই প্রবাসীদের প্রায় হাজার খানেক বিল্ডিং বাড়ি এবার পদ্মায় চলে গেছে। কয়েক হাজার প্রবাসীদের পাসপোর্টে উল্লেখ করা স্থায়ী ঠিকানার গ্রামটা আর নাই।
মাটি না থাকলে, জন্মভূমি না থাকলে, নিজের গ্রাম না থাকলে
সেতো এক বেওয়ারিশ জীবন, তার কী মূল্য থাকে?
অথচ এখনো ইতালি, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশে যারা রাজপথে হাসু আপা, হাসু আপা বলে স্লোগান দেয় তার বেশিরভাগ এই নড়িয়া, শরীয়তপুরের মানুষ।
নদীর স্রোত কমলেই পদ্মার ডানতীর রক্ষা প্রকল্পের কাজ শুরু হবে, এজন্য সরকার থেকে এসেছে ১০৯৭ কোটি টাকা, কিন্তু এই অর্থের ভেতরে, এই প্রকল্পের ভেতরে নড়িয়ার মানুষ আর স্বপ্ন দেখে না। নড়িয়ার মানুষের সকল স্বপ্ন ভেসে গেছে পদ্মায়। শরীয়তপুরের পানি উন্নয়ন বোর্ড ২৫০কেজি বালির জিও ব্যাগ ফেলে ভাঙন রোধের চেষ্টা করে যাচ্ছে, অথচ নদী গবেষকরা জানিয়েছে এখানে স্রোতের বিপরীতে ২৫০কেজির জিও ব্যাগ কাজ হবে না এখানে প্রয়োজন হাজার কেজির জিও ব্যাগ।
বঙ্গবন্ধু ও নজরুল আমার স্পর্শকাতর জায়গায় বসবাস করে, বঙ্গবন্ধু আমাকে শিখিয়েছে সবকিছু আপন করে নিতে। তিনি কথার সময়ে বলতেন “ভাইয়েরা আমার” কিংবা “আমার বাঙালি” “আমার কৃষক” “আমার শ্রমিক”। আমিও নেতার মতোই বলি আমার জনগন, আমার পদ্মাপারের মানুষ, আমার নড়িয়া কেদারপুর, আহা এসবের কিছুই থাকবে না এবার।
বঙ্গবন্ধু প্রায়ই বলতেন “আমি বিদেশ থেকে ভিক্ষা করে আনি আমার বাঙালিদের জন্য, অথচ…”
আমি বিদেশে থেকে আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমার নড়িয়াকে ভিক্ষা চাই।
আমার দেশের নৌকার নমিনেশন প্রত্যাশী সীমন ভাই, শামীম ভাই, খালেদ ভাই এরা কি পারে না বঙ্গবন্ধুর এই আদর্শ অনুসরণ করতে?
প্রধানমন্ত্রীর সামনে তিনজন ছয়খানা হাত বাড়িয়ে কি বলতে পারে না
নেত্রী, নির্বাচনের টিকেট যাকে ইচ্ছে দেন, আগে আমাদের এই নড়িয়াকে ভিক্ষা দেন।
সর্বশক্তিমান আল্লাহ্ই বলেছেন সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে, আমাদের সেই চেষ্টাটি করতেই হবে।
প্রিয় প্রধানমন্ত্রী,
আমাদের দাবি হাজার কেজি বালির জিও ব্যাগ ফেলে মুলফৎগঞ্জ বাজার, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স রক্ষা করেন।
পদ্মার ডানতীর রক্ষা করার জন্য ২২ আগস্ট ঈদুল আযহার দিনে আমরা প্রবাসীরা আলোচনা সভা করেছিলাম সিঙ্গাপুরে।
২৪ আগস্ট স্মারকলিপি দিয়েছিলাম প্রধানমন্ত্রীর কাছে, যাতে করে নৌবাহিনী মোতায়েন করে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ক্ষমতা প্রয়োগ হলেও তিনি আমার নড়িয়াকে বাঁচান। সিঙ্গাপুরের বাংলাদেশ হাইকমিশন তা সাদরে গ্রহণ করে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে প্রেরণ করেছেন।
সারা বাংলাদেশে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স প্রবাহের মাঝে আমার নড়িয়ার অবস্থান চতুর্থ যা বিভিন্ন মিডিয়া প্রকাশ করেছে অথচ আমরা আজ আমরা এতোটাই অবহেলিত যে ‘উহু’ শব্দটিও করতে পারি না।
আহা! এই জনপদ আর দেখবো না ভাবতেই প্রবাসী মনটা কেমন আনচান করে, রাতে ঘুম হয় না, কাজে মন বহে না।