তানিজা খানম জেরিন, নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র: আজ ছাব্বিশে মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতার পাঁচ দশক পূর্ণ হবে। বাংলাদেশসহ বিশ্বের যেখানেই বাংলাদেশিদের বসবাস অর্থাৎবিশ্বের সর্বত্রই বাংলাদেশের জাতীয় দিবস ও স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী মহাসাড়ম্বরে পালন করছে। বিশ্বের মানচিত্রে কোন জাতির স্বাধীনতার ঘোষণা ও সশস্ত্র যুদ্ধ জয়ের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জনকারী দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম।
গত পাঁচ দশকে হাঁটি হাঁটি পা পা করে বাংলাদেশ অনেক দূর এগিয়েছে, বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশ অনেক ক্ষেত্রেই সুনাম অর্জন করেছে এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিশ্বে অনেক ক্ষেত্রেই অনুকরণীয় মডেল হিসেবে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। অন্যদিকে সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ার মত সর্বক্ষেত্রেই উন্নয়নের চূড়ান্ত শিখরে উঠতে পারেনি আবার অপরদিকে গত সাত দশক আগে স্বাধীনতা প্রাপ্ত ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে কিছু কিছু ক্ষেত্রে এগিয়ে আছে বাংলাদেশ। নয় মাসের সশস্ত্র যুদ্ধে বিভিন্ন দল মত ও আদর্শের লোক অংশ গ্রহণ করেছিল সকলেরই লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল দেশকে স্বাধীন করা; কিন্তু চরম সত্য হলো দুই যুগের পশ্চিমা শাষক গোষ্ঠির বর্ণ-বিদ্ধেষ, অত্যাচার, অন্যায়, কুশাসন, লাঞ্ছিত, বঞ্চিত, নিপীড়িত ও অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করার যে লক্ষ্যে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল গত পাঁচ দশক পর অর্থাৎ আজকের এই সুবর্ণ জয়ন্তীতিতেও বলতে দ্বিধা নেই স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে উপরোক্ত কারণগুলি বর্তমানেও অনেক ক্ষেত্রে বিদ্যমান। অবশ্য পাঁচ দশকেই সবকিছু পেয়ে যাবো এমনটা ভাবনার অবকাশ নেই; হয়তো হীরক জয়ন্তীতে আরো কিছু অর্জিত হবে, প্লাটিনাম জুবিলীতে হয়তো অনেক ক্ষেত্রে আরো সাফল্য আসবে, স্বাধীনতার শতবর্ষ পালনের সময় হয়তো সুদৃঢ় মজবুত টেকসই অপার সম্বাবনাময় আলোকিত উজ্জ্বল সর্বক্ষেত্রে সাফল্যমণ্ডিত বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হবে।
শোষণমুক্ত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রত্যয়ে অর্জিত এক সাগর রক্তের বিনিময়ে আমাদের মহান স্বাধীনতা অর্জন। আমরা একটি লাল সবুজের পতাকা পেয়েছি; স্বাধীন সার্বভৌম একটি ভূখণ্ড পেয়েছি। যুদ্ধের বছর বাদ দিয়ে গত উনপঞ্চাশ বছর ধরে দেশের উন্নয়ন কার্যক্রম অব্যাহত আছে। লক্ষণীয় প্রতিটি বাজেটেই প্রায় এক তৃতীয়াংশ উন্নয়ন কাজের জন্য অর্থ বরাদ্দ থাকে, গতানুগতিকভাবে বিভিন্ন অব্যবস্থার জন্য কোন বছরই চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ ভাগ উন্নয়ন কার্যক্রম সম্পন্ন হয়নি। আশ্চর্যের বিষয় হলো গত উনপঞ্চাশ বছরে বাজেটে উন্নয়ন কার্যক্রমের যে অর্থ বরাদ্দ ছিল সে পরিমাণ অর্থ বা তারচেয়ে একটু বেশী অর্থাৎ গত উনপঞ্চাশ বছরে প্রায় আট লাখ হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়েছে, পাচারকৃত অর্থ দিয়ে বর্তমান সময়ের দেড় বছরের সমগ্র বাংলাদেশের বাজেট প্রণয়ন করা যেতো। গত উনপঞ্চাশ বছরে পাচারকৃত অর্থ দিয়ে দুই ডজন পদ্মা সেতু নির্মাণ করা যেতো। মানব উন্নয়ন সূচক ও মাথাপিছু আয়ের কল্যাণে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের কাতারে চলমান অব্যাহত আছে। অপরদিকে প্রতিজনের মাথায় আশি হাজার টাকা ঋণের বোঝা রয়েছে অর্থাৎ গত উনপঞ্চাশ বছরে বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ সাড়ে তের লাখ হাজার কোটি টাকা বা জিডিপির পঞ্চাশ শতাংশ। স্বাধীনতার সূবর্ণ জয়ন্তী উৎসবের প্রাক্কালে বাংলাদেশ বাংকের রিজার্ভের পরিমাণ সর্বকালের রেকর্ড ৪৩ বিলিয়ন ডলার জমা আছে। যদিও এই পঞ্চাশ বছরের ইতিহাসে এই প্রথম রিজার্ভের পাঁচ হাজার কোটি টাকা উন্নয়ন খাতে ব্যয়ের জন্য মন্ত্রী পরিষদ অনুমোদন দিয়েছে; বিষয়টি খুবই ভাবনার! চরম সত্য হলো দেড়/দু’কোটি প্রবাসী, অভিবাসীর অর্থানুকুল্যই রিজার্ভের কিছুটা ঝকঝকে অবস্হা বা গত পাঁচ দশকে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ভিত অনেকটা শক্ত অস্থানে রয়েছে। স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী পালনের বছরেও বলতে হচ্ছে রেলওয়ে, বিমান, সার, পাটকলসহ অনেক প্রতিষ্ঠান গত উনপঞ্চাশ বছরেও লাভজনক করা সম্ভব হয়নি। খুবই দু:খ হয় গত পঞ্চাশ বছরেও দেশের জনগণের চাহিদা মতো পিঁয়াজ আলু, অনেক মশলাপাতি উৎপাদনে বাংলাদেশ স্বনির্ভরতা অর্জন করতে পারেনি। সর্ব উৎপাদনের ক্ষেত্রেই স্বনির্ভরতার কোন শ্লোগান বাংলাদেশে আজ অনুচ্চারিত। স্বাধীনতার অর্ধশতকেও সকল জনগণের জন্য বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা সুপেয় পানি, বিদুৎসেবা পরিপূর্ণভাবে পৌঁছে দিতে বাংলাদেশ সক্ষম হয়নি।
স্বাধীনতার পাঁচ দশক পর বর্তমান সরকার “মুজিব শতবর্ষে” ঘোষণা করেছেন অসহায় বীর মুক্তিযাদ্ধের জন্য চৌদ্দ হাজার বীর নিবাস নির্মাণ করে দিবেন। মাসিক ভাতার পরিমাণও বাড়ানো হয়েছে। পঞ্চাশ বছর আগে ছাপান্ন হাজার বর্গমাইলের ভূখণ্ডটি নয়মাসের সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে প্রায় দুইলাখ অকুতোভয় মুক্তিযাদ্ধা প্রিয় মাতৃভূমির জন্য প্রাণ উৎসর্গিত জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানেরা যখনই বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে ঠিক তখনই মাত্র চৌদ্দ দিনের জন্য যুদ্ধটা হয়ে গেলো ত্রিপক্ষীয় যার ফলশ্রুতিতে যৌথভাবে বিজয়ী হলো দুটি দেশ বাংলাদেশ ও ভারত; এটা অনস্বীকার্য বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্রটির অফুরন্ত আশ্রয়, সহায়তা ও সহযোগিতা না পেলে বাংলাদেশের অভ্যুদয় বা স্বাধীন ভাবে বিজয়ী হতে আরো সময় লাগতো; দু:খ হলো ত্রিদেশীয় যুদ্ধের ফলে এবং পাকবাহিনী যৌথবাহিনীর কাছে নি:শর্ত আত্মসমর্পণ করায় বাংলদেশ ঐতিহাসিক বিজয়ের কালজয়ী নজীর সৃষ্টিকারী আইকন হতে পারলো না। ফরাসী বিপ্লব বা আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধের যে মাইলফলক ইতিহাস রয়েছে সদ্য স্বাধীনতা প্রাপ্ত বাংলাদেশ ঠিক অনুরূপ বিশ্বের ইতিহাসে ঐতিহাসিক মাইলফলক হয়ে স্থান এবং নজীর স্থাপন করতে পারে নাই। আফসোস গত পঞ্চাশ বছরেও দেশের জন্য প্রাণ বিসর্জনকারী এবং বাংলাদেশ স্বাধীন করার জন্য জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানেরা সশস্ত্র যুদ্ধ করেছিল তাদের সঠিক সংখ্যা ও সঠিক পূর্ণাঙ্গ তালিকা সুবর্ণ জয়ন্তীতেও করতে পারেনি। আরো দু:খের বিষয় যুদ্ধে অংশগ্রহণ না করেও ভূয়া সার্টিফিকেট সংগ্রহ করে অনেকেই বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় পদসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন হয়েছেন। পঞ্চাশ বছর পরও শুনতে হয় যাদের বয়স পঞ্চাশের কম তেমন দুই হাজার ভূয়া মুক্তিযোদ্ধা নিয়মিত ভাতা পাচ্ছেন।
বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে বিরোধীতাকারী অনেকের বিচার হয়েছে তবুও আক্ষেপ গত পঞ্চাশ বছরেও পাকবাহিনীর দোসর যারা বাংলদেশ সহ বিভিন্ন দেশে বসবাস করে তাদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা; অর্ধশতকেও সবাইকে আনতে পারেনি বিচারের আওতায়। পাঁচ দশক আগে জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র ভোটাধিকার সাম্য ও ধর্মনিরপেক্ষতা, ন্যায়বিচার রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে শোষণমুক্ত, লাঞ্ছনা বঞ্চনা নির্মূলকরার জন্য যে স্বাধীনতার যুদ্ধটা শুরু-হয়েছিল এবং নয় মাস পরে বাংলাদেশের ভূখণ্ডটি মুক্ত হয়েছিল বাস্তবে গত পঞ্চাশ বছরেও এ ভূখণ্ডটি নিজের জনগণ দ্বারা শুধু শাসিত হয়েছে বিরাট কোন আদর্শিক মৌলিক পরিবর্তন হয়নি।
পঞ্চাশ বছর আগে বাংলাদেশ ভূখণ্ডটি মুক্তকরে স্বাধীনতা পরবর্তীতে রাষ্ট্রীয় মূলনীতি গুলি বাহাত্তরের সংবিধানে সন্নিবেশিত ছিল- গত পঞ্চাশ বছরে দেড়ডজন কাটাকুটির পর মৌলিক নীতিমালা থেকে রাষ্ট্র কিছুটা সরে এসেছে। বাংলাদেশে জাতি, ধর্ম, বর্ণ, নির্বিশেষে সবাই বসবাস করবে কিন্তু দেশের ললাটে সেঁটে দেওয়া হয়েছে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম। বাংলাদেশ স্বাধীন সার্বভৌম লাল সবুজের পতাকাবাহী একটি ভূখণ্ড দেশতো সকল ধর্মের বা যারা ধর্ম পালন না করে সবারই আবাসস্থল, রাষ্ট্রের গায়ে কেন ধর্মীয় লেবাস লাগানো হলো? গত পঞ্চাশ বছরে বাংলাদেশে দুই/তিন রকমের সরকার পদ্ধতি পরিবর্তন হয়েছে; বস্তুত সব সরকারই ছিল এককেন্দ্রিক এবং জবাবদিহীতার বাইরে। দেশে জনগণের ভোটাধিকার। আজ মূল্যহীন অথচ দেশ স্বাধীন করার জন্য পাঁচদশক আগে সর্বপ্রথমই ছিল ভোটের লড়াই। গণপ্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্রে গণতান্ত্রিক রীতিনীতি অনুযায়ী সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে নির্বাচিত জন প্রতিনিধিরাই শুধু দেশ শাসনের অধিকার পায়। গত পাঁচ দশকে হয়তো অনেক ক্ষেত্রেই কিছুটা উন্নয়ন অগ্রগতি হয়েছে অনেক ক্ষেত্রেই তথৈবচ: ছাপান্ন হাজার বর্গমাইলের বাংলাদেশের ভূখণ্ডে সত্য বলার লোক খুবই কম রুচির দুর্ভিক্ষতো লেগেই আছে। দেশের এক শ্রেষ্ঠ সন্তান শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন দুর্ভিক্ষের ছবি এঁকে বিশ্বে বাহবা কুড়িয়েছিলেন তিনি বেঁচে থাকলে হয়তো “রুচির দুর্ভিক্ষের” ছবি এঁকে বিশ্বে আরো সুনাম অর্জন করতেন। আরেক পটুয়াশিল্পী কামরুল হাসান ‘জল্লাদ’ বা ‘বিশ্ববেহায়ার’ ছবি এঁকে যে সুনাম কুডিয়েছেন তারচেয়েও অধিক সুনাম কুঁড়াতেন ‘আমরা সবাই সত্য বলিনা’ বা ‘পদলেহী বুদ্ধিজীবির’ পোষ্টার এঁকে; স্বাধীন বাংলাদেশে বর্তমানে তেলমর্দন এবং জ্বী হুজুরে সয়লাব হয়ে গেছে।
সুবর্ণ জয়ন্তী উৎসবে দেশের ষোলকোটি জনগণকে দৃঢ প্রত্যয়ে শপথ নিতে হবে আগামী হীরক জয়ন্তীতে আমরা দেশকে একাত্তরের চেতনায় সমৃদ্ধশালী সোনার বাংলা গড়ে তুলবো। সময় হয়েছে সমাজবিজ্ঞানী, পরিকল্পনাবিদ, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও সুদক্ষ অর্থনীতিবিদদের সমন্বয়ে বাংলদেশের আগামী শতবর্ষ উদযাপনকল্পে আগত পাঁচ দশকের একটি উন্নয়ন রূপরেখার স্থায়ী ও টেকসই পঞ্চদশক পরিকল্পনা প্রণয়ন করা এবং দশক ভিত্তিক উন্নয়ন পরিকল্পনা সুচারুরূপে বাস্তবায়ন করা। আগামী প্রজন্মের প্রয়োজনে একটি মানবিক ও কল্যাণমুখী বাংলাদেশ বিনির্মাণের জন্য সকল জনগণকে স্ব-স্ব অবস্থান থেকে স্বাধীনতা যুদ্ধের চেতনায় দেশনির্মাণের যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। বাংলদেশ খুবই আশাবাদী সুজলা-সুফলা একটি ভূখণ্ড জনগণ সুশাসন, সুষম উন্নয়ন, সঠিক ন্যায়বিচার, সম-অধিকার প্রাপ্তিতে আরো সোচ্চার হবে। হত দরিদ্র উন্নয়নশীল অপার সম্ভাবনার বাংলাদেশ স্বাধীনতার পঞ্চাশতম বছরটি কাজে লাগাবে; গ্রহণ করবে সুদূর প্রসারী টেকসই দৃঢ় উন্নয়ন হীরক জয়ন্তী দশক মেগা পরিকল্পনা- স্বনির্ভর শতবার্ষিকী পালনের মহাপরিকল্পনা- মাতৃভূমির সর্বাঙ্গীণ উন্নয়ন, বিনির্মাণে একাত্তরের ন্যায় নতুন করে এই দেশের মাটির সন্তানেরা হানাহানি ও বৈরিতা-বিদ্বেষ ভুলে শপথ নিবে সুশাসন প্রতিষ্ঠা, মানবাধিকার নিশ্চিত করা, দুর্নীতি প্রতিরোধ, অসাম্প্রদায়িক, ক্ষুধা ও দারিদ্রমুক্ত, লাঞ্ছনা বঞ্চনা নিরোধ, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা, বাক-স্বাধীনতা, নারীর ক্ষমতায়ন, ভিন্নমতের লালন, বৈষম্যহীন সমতাভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা, সম-অধিকার বাস্তবায়নসহ নতুন প্রত্যয়ে নতুন শপথে বাংলাদেশের সার্বিক উন্নয়ন।