তানিজা খানম জেরিন, নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র থেকে: বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবসের পঞ্চাশ বছর পূর্তি বা স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উৎসব মহাধুমধামে বাংলদেশ সহ বিশ্বের যেখানেই বাংলাদেশিদের বসবাস সর্বত্রই ২৬ মার্চ পালিত হচ্ছে। স্বাধীনতা অর্জন, স্বাধীনতা টিকিয়ে রাখা, সর্বাপরি স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী পালন বাংলাদেশ ও বাংলাদেশিদের জন্য গৌরবের একটি মাইলফলক অর্জন। গত পাঁচ দশক আগে জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র ভোটাধিকার সাম্য ও ধর্মনিরপেক্ষতা, ন্যায়বিচার রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে শোষণমুক্ত, লাঞ্ছনা-বঞ্চনা নির্মূলকরার জন্য যে স্বাধীনতার যুদ্ধটা শুরু হয়েছিল এবং নয়মাস পরে ভূখণ্ডটি মুক্ত হয়েছিল এটা অনস্বীকার্য বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্রটির অফুরন্ত আশ্রয়, সহায়তা ও সহযোগিতা না পেলে বাংলাদেশের অভ্যুদয় বা স্বাধীনভাবে বিজয়ী হতে আরো সময় লাগতো; অনেক বিজ্ঞ রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর মতে গত অর্ধশতক ধরেই বাংলাদেশ বন্ধু রাষ্ট্রটির ইশারা, ইঙ্গিত, সমর্থন ও প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী বাংলদেশ সীমিত স্বাধীনতা ভোগ করেছে; এমনকি ভোটার বিহীন নির্বাচনে তাদের সমর্থন থাকায় সরকার টিকে রয়েছে। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ উন্নয়নের অনেক ক্ষেত্রে বিশ্বে রোল মডেলের আসনে অধিষ্ঠিত অপরদিকে ঘুষ-দুর্নীতি, নির্বাচনী ব্যবস্থা, আইনের শাসন, অর্থ ও মানব পাচার, বায়ু দূষণ, শিক্ষায় দুর্নীতি ও বর্তমান দু’দশকে ব্যাংকিংখাতে হরিলুট দেশকে প্রায় বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। গত পঞ্চাশ বছরেও দেশে একটি সার্বজনীন গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশন ও নির্বাচনী ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি; এমনকি বিনাভোটের নির্বাচন বা রাতের ভোটের নির্বাচনের জন্য বাংলাদেশের সুনাম আজ বিশ্বব্যাপী প্রশ্নের মুখে।
বিশ্বে বাংলাদেশের সম্প্রীতির যে নজীর রয়েছে তা প্রতি বছরই তিন/চার বার ধাক্কা খায়; সংখ্যালঘুদের উপর মধ্যযুগীয় বর্বর হামলা পাঁচ দশক ধরেই অব্যাহত আছে; সঠিক তদন্ত ও অনুসন্ধান ছাড়াই প্রথমে মৌলবাদীদের ঘাড়ে, পরবর্তীতে বিরোধীদলের উপর দায় চাপানো হয়।সর্বশেষ দেখা যায় সর্ব আমলেই ক্ষমতাসীন দলের নেতা/পাতিনেতা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে জড়িত। সুনামগঞ্জের শাল্লার ঘটনা; রামুর ঘটনা বা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ঘটনায় কোন ব্যতিক্রম নেই। শুধুই দু:খ এই ভূখণ্ডের মানুষকে অনেক ভালোবাসা সামাজিক নিরাপত্তা দিয়ে লালন পালন করার পরও বিদেশে টাকা পাচার করে দেশান্তরী হয়ে যায়। অবশ্য বিভিন্ন কারণে গত পঞ্চাশ বছরে দেশ ত্যাগের জন্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের পরিমাণ উনিশ থেকে নয় এ নেমে এসেছে। চরম সত্য হলো গত পঞ্চাশ বছর যাবতই সর্বক্ষমতাসীন দল বাকস্বাধীনতা ষোলআনা ভোগ করেছে শুধু ভিন্নমত বা বিরোধীদল চারআনা বলতে পেরেছে এর বেশি বললেই দুদকের খড়গ বা হামলা মামলা হয়রানির শিকার হয়েছেন। সম্প্রতি ডিজিটাল নিরপত্তা আইনে খড়গের বলি হয়েছেন লেখক মুশতাক, অবর্ণনীয় নির্যাতনের শিকার হয়েছেন কার্টুনিষ্ট কিশোর। গত অর্ধশতকে বাংলাদেশ দুর্নীতিতে কয়েকবার চ্যাম্পিয়ন এবং বিভিন্ন বছরে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় সর্বনিম্ন দশের কোটায় স্থান ছিল। মানব পাচার ও অর্থ পাচারে বাংলাদেশ গত পাঁচ দশকে দক্ষিণ এশিয়ায় সবসময়ই দৌড়ে এগিয়ে রয়েছে; গত পঞ্চাশ বছরে আট লাখ হাজার কোটি টাকা পাচার করতে সক্ষম হয়েছে। পাচারকৃত টাকা দিয়ে চব্বিশটি পদ্মা সেতু নির্মাণ করা যেতো।
গত পাঁচ দশকে বাংলাদেশে ঈর্ষণীয় অগ্রগতি ও উন্নয়ন হয়েছে; কথিত তলাবিহীন ঝুড়িঁ থেকে অনেক আগেই উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় স্থান করে নিয়েছে। যদিও বিশ্বব্যাংক এবং আইএমএফের মান সূচকে একটু তারতম্য রয়েছে তবুও জাতিসংঘের আওতাধীন দেশের তালিকায় বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশ। স্মর্তব্য দেশ যখন কোন সাহায্য, প্রাকৃতিক দুর্যোগে, অনুদান বা ট্যাক্স ফ্রি সুবিধা পেতে চায় তখন অনুন্নত আবার যখন কোন ঋণ প্রাপ্তি বা বৃহৎ কোন প্রকল্পের অর্থায়নের দরকার পড়ে তখন বাংলাদেশ সবসময়ই উন্নয়নশীল দেশের কাতারে চলে যায়। স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে গর্ব করে বলা যায়- নারীর ক্ষমতায়ন, নারী শিক্ষা, জাতীয় রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি, মাথাপিছু জাতীয় আয়, মানবের গড় আয়ু বৃদ্ধি, বিদুৎতায়ন, যোগাযোগ ব্যবস্থা, স্যাটেলাইট সহ নেটওয়ার্ক পরিধি, জাতীয় প্রবৃদ্ধির হার, দারিদ্র বিমোচন, শিশু মৃত্যু হার, পোষাক সহ অন্যান্য রপ্তানি বৃদ্ধি, স্বাধীনতার চেতনা পূণ:প্রতিষ্ঠা সহ স্বাধীনতার সঠিক ইতিহাস চর্চায় ঈর্ষনীয় সাফল্য এসেছে। আশা করা যায় আগামী হীরক জয়ন্তী উৎসবে অর্থাৎ আগামী দশকে সুপেয় পানি, পয়:নিষ্কাশন ব্যবস্থা, সহজলভ্য কৃষি উপকরণ, স্বাস্হ্য সেবা, জন্মনিয়ন্ত্রণ হার রোধ, খাদ্যপণ্যে ভেজালরোধ, অপুষ্টি দূর:করণ, বাল্যবিবাহ রোধ, সমুদ্র ও নৌবন্দরের সঠিক ব্যবস্হপনা, ভূর্তকি প্রাপ্ত দু/তিনটি শিল্প প্রতিষ্ঠান লাভজনকের দ্বার প্রান্তে পৌঁছাবে।
পূর্বেই বলেছি স্বাধীনতা প্রাপ্তির পাঁচ দশকেও দেশে আইনের শাসন সঠিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়নি, বিচার বিভাগ সরকারীভাবে স্বাধীন- বেসরকারীভারে পরাধীন এই নীতি বিদ্যমান জন্ম থেকেই, আমাদের নির্বাচনী ব্যবস্থা ও ভোটাধিকার প্রয়োগ বিশ্ববাসী কখনই বাহবা দেয়নি, আমাদের গণতান্ত্রিক চর্চায় বিশ্ব দরবারে সুনাম কুঁড়াতে পারিনি, অর্ধশতকেও দুর্নীতির রাহুগ্রাস থেকে মুক্ত হয়নি, বিনাবিচারে আটক নির্যাতন ও হত্যার জন্য মানবধিকার সংস্থা সহ অনেক দেশ প্রায়ই উদ্বেগ ও নিন্দা জানিয়েছে। বাস পুড়ানো মানুষ পুড়ানো, বিক্ষোভ, হরতাল, ভাংচুর এই দশকে একটু কম থাকলেও বাংলাদেশ জন্মথেকেই জ্বলছে। পঞ্চাশ বছরেও নদী খাল বিল অবৈধ দখলমুক্ত করা যায়নি। সরকারী পতিত জমি, হাট মাঠ জলাশয় দখলের মহাৎসব চলছে, ব্যাংকিং ও শেয়ার বাজারে হরিলুট অব্যাহত আছে, মাদকের ছোবল হ্রাস-বৃদ্ধির মধোই পাঁচ দশক অতিক্রান্ত হয়েছে, আমরা চার যুগে সুন্দরবন কিঞ্চিৎ ধ্বংসসহ অনেক পাহাড় ও বন উজার করেছি; বাদ যায়নি অবৈধভাবে নদী বালু খনন, বিলুপ্ত করেছি অনেক জীবজন্তু ও প্রাণি সম্পদ, অবৈধ কারেন্ট জালের বদৌলতে রেহাই পায়নি মৎস্য সম্পদ, এই দশকে নির্মাণ কাজে যুক্ত হয়েছে রডের বদলে বাঁশ সংস্কৃতি, ভূমি দস্যুদের উৎপাত দেশের সর্বত্রই, তদ্বীর ও বদলী বাণিজ্য অব্যাহত আছে পুরোদমে, দলীয় নিয়োগ ভূয়া মুক্তিযাদ্ধার সার্টিফিকেট কোনকালেই কম ছিলনা।পাঁচ দশকেও চুড়ান্ত করতে পারিনি সঠিক তালিকা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান মুক্তিযাদ্ধাদের। যাদের কল্যাণে আমরা পেয়েছি মহান স্বাধীনতা। স্বাধীনতা বিরোধীদের বিচার প্রক্রিয়া এখনো অসমাপ্ত রয়েছে।নতজানু পররাষ্ট্রনীতির কারণে রোহিঙ্গা সমস্যার আশু কোন সমাধান দৃষ্টিগোচর হচ্ছেনা। ভিন্ন মত প্রকাশে কণ্ঠরোধ, সংবাদপত্রের অলিখিত সেন্সর ব্যবস্থা চালু, বিজ্ঞাপন বন্টন নীতিমালা অষ্পষ্ট ছিল সব আমলেই।
স্বাধীনতা দিবস শুধু ঝাঁকজমকভাবে পালনের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে আগামী হীরক জয়ন্তী অর্থাৎ আগত দশকের উন্নয়ন রূপরেখা দ্রুত প্রণয়ন করে কিভাবে সুচারুরূপে বাস্তবায়ন করা যায় সেদিকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের নজর দিতে হবে। স্বনির্ভর সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠায় শতবার্ষিকী পালনের মহাপরিকল্পনা- মাতৃভূমির সর্বাঙ্গীণ উন্নয়ন, বিনির্মাণে একাত্তরের ন্যায় নতুন করে এই দেশের মাটির সন্তানেরা হানাহানি ও বৈরিতা-বিদ্বেষ ভুলে শপথ নিবে সুশাসন প্রতিষ্ঠা, মানবাধিকার নিশ্চিত করা, দুর্নীতি প্রতিরোধ, অসাম্প্রদায়িক, ক্ষুধা ও দারিদ্রমুক্ত. লাঞ্ছনাবঞ্চনা নিরোধ, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা, বাক-স্বাধীনতা, নারীর পরিপূর্ণ ক্ষমতায়ন, ভিন্নমতের লালন, বৈষম্যহীন সমতাভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা, সম-অধিকার বাস্তবায়নসহ নতুন প্রত্যয়ে নতুন শপথে বাংলাদেশের সার্বিক উন্নয়ন। ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য মানবিক ও কল্যাণকর রাষ্ট্রের প্রয়োজনে স্বাধীনতার চেতনায় সুশিক্ষিত ও আদর্শবাদী জাতি গঠনে সবাইকে মনোনিবেশ করতে হবে।