সুলতানা বেগম রত্না:
হিমালয়ের পীর পাঞ্জাল অঞ্চলে অবস্থিত ভারতের উত্তরে কাশ্মীরের অবস্থান। যার পশ্চিমে পাকিস্তান, উত্তরে আফগানিস্তান, পূর্বে চীন, দক্ষিনে হিমাচল। অবস্থানগত ও ভূ-বৈচিত্রের দিক থেকে এটি ভূস্বর্গ (Heaven of the Earth)। কাশ্মীরের গ্রীষ্মকালীন রাজধানী হলো শ্রীনগর যা ঝিলম নদীর তীরে অবস্থিত। তুষারপাত আর সবুজের মিষ্টতা যেনো বিমোহিত করে আপনাকে তৃপ্ত করে তুলবে বিস্তৃত মুঘল যুগের বাগানগুলো শালিমার বাগ, নিশাত বাগ, চশমে শাহী, পরিমহল আর র্ডাল লেক, নাগিন লেক আর শিকারা রাইড আপনাকে করবে প্রাণবন্ত, উজ্জীবিত, অবিশ্বাস্য সৌন্দর্য না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। একদিকে ঝিলম নদীর প্রবাহ দ্বারা অন্যদিকে মোহময়ী ডাল লেক শ্রীনগরকে জড়িয়ে রেখেছে। যেখানে আলো আধারির খেলা চলছে আপন খেয়ালে।
শালিমার উদ্যান, মুঘল শাসনামলের অন্যতম স্থাপনা যা সম্রাট জাহাঙ্গীরের স্ত্রী নুরজাহান বেগমকে উৎসর্গ করা হয়েছিল। যেখানে এর আত্মিক সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য সম্রাজ্ঞী গ্রীষ্মের সময়ে তার লাট বহর নিয়ে পীর পাঞ্জাল গিরিপথ পাড়ি দিয়ে ছুটে আসতেন বরাফাচ্ছাদিত রাজকীয় আবাসন আর পাখির কলতান, রাতে সেতারা, বীণার সুরে, নুপুরের ছন্দে মুখরিত উদ্যানে। এখনও এই ধারায় পানি প্রবাহে রয়েছে সেই শাহী নহর এবং জলাবর্তনের যান্ত্রিক কিন্তু নান্দনিক কলাকৌশল।
পাকিস্তান সীমান্ত থেকে মাত্র ৮ কি.মি. দূরে অবস্থিত বরফের রাণী, ফুলের উপত্যকা, আকর্ষনীয় তৃণভূমি এবং পর্বত বেষ্টিত শৈল শহর গুলমার্গ। গুলমার্গের রাজকীয় এবং মার্জিত চাল মুগ্ধ করার মতো। শ্রীনগর থেকে প্রায় ৫২ কি.মি. দূরে ৮৮২৫ ফুট উচ্চতায় রয়েছে গন্ডেলা রাইড যা আপনাকে নিয়ে যাবে বরফের রাজ্যে। এখানে স্কেটিং ও প্যারাগ্লাইডিং এর দারুন সুযোগ রয়েছে। পাইন আর দেবদারুর সাথে মিতালী করতে করতে আপনি দেখা পাবেন রঙীন বনফুল যা মনে করিয়ে দেবে ‘এ যেন স্বর্গের পরিজাত মর্ত্যে নেমে এসেছে’।
এশিয়ার সুইজারল্যান্ড খ্যাত পেহেলগাম, যার দূরত্ব শ্রীনগর থেকে প্রায় ৯৬ কি.মি.। স্থানীয়রা একে ইসলামাবাদ বলে। আওরঙ্গজেব ১৭০০ সালে এর নাম রাখেন ইসলামাবাদ। পরে মহারাজা গোলাব সিং ১৮৫০ সালে এর নাম রাখেন অনন্তনাগ যার অর্থ কাশ্মীরি ভাষায় অসংখ্য ঝর্ণা। মানে নাগ অর্থ ঝর্ণা, অনন্ত মানে অসংখ্য। হাইওয়ে সংলগ্ন লিডার নদী ধরে এগিয়ে যাবে আঁকা বাঁকা গন্তব্যে পেহেলগাম। যেতে যেতে এর মনোমুগ্ধকর রূপ, আপেল বাগান, জাফরান বাগান, ল্যাভেন্ডারের মতো মূল্যবান কাশ্বীরের অর্থকরী ফসল চোখ ভুলিয়ে নিয়ে যাবে অন্য এক স্বপ্নের জগতে। ঘোর না কাটতেই ঘন পাইন বনের মাঝে পাখির শব্দে শব্দে আপনি পৌছে যাবেন পেহেলগামের বেতাবভ্যালী নয়তো আরুভ্যালী অথবা চন্দনওয়ারীতে। স্বপ্নীল পাহাড়ী পথ ধরে একপাশে লিডার নদীর পাথুরে খরস্রোতা তোলা মাদকতামতয় ছন্দ অন্যপাশে পাহাড়ের বুক জুড়ে সারি সারি পাইন গাছের সারির মাঝে উপভোগ্য হয়ে ওঠে আপনার ভ্রমণ।
শ্রীনগর থেকে ৮২ কি.মি. উত্তর পূর্বে কাশ্মীরের রূপের রাণী সোনামার্গ যেতে যেতেই চোখে পড়বে সোনালী ঝলমলে আলোর পাহাড়ি জনপদ আর পুরো পথ জুড়েই থাকবে দামাল সিন্ধু নদ। পাইন, ফার আর পর্বত শ্রেণির পাহাড়ী শোভা দেখতে দেখতে স্বর্ণময় সৌন্ধর্য অবলোকন করতে করতে হিমালয়ান হিমবাহ, কাশ্মীর উপত্যাকা এর মাঝেই দেখা মেলবে অমরনাথের পিক যা হিন্দু সম্প্রদায়ের তীর্থস্থান। এখানকার পাহাড়ের গঠন ভিন্ন রকম আঁকাবাকা কাঠিন্য ভাব রয়েছে। এতটাই উচ্চতা ও ভয়ংকর রাস্তা যে ভয়েরও কমতি থাকবে না। সোনমার্গ থেকে পায়ে হেঁটে অথবা ঘোড়ায় চেপে যাওয়া যায় হিমবাহ যেখানে বরফে বরফে মেতে উঠার এক অসাধারণ অনুভূতিতে আপনি হয়ে উঠবেন মাতোয়ারা, যেতে যেতে আপনার চোখে পড়বে হিমালয়ের বিভিন্ন রোমাঞ্চকর পিকে ওঠার বেস ক্যাম্প যা দিবে দারুণ এক বাস্তব অভিজ্ঞতা, রিভার রাফটিং এর সুযোগও পাবেন এই সোনমার্গে। তারই মাঝে বরফ গলা পাহাড়ী নদীর মিষ্টি মধুর ঝংকৃত শব্দ কবিত্বকে জাগিয়ে তুলতেই পারে। এভাবেই জোজিলা পাস অতিক্রম করে প্রায় পৌছে যাবেন লাদাখ সিমান্তের জিরো পয়েন্টে।
তবে বলে রাখছি, ঋতুভেদে এর সৌন্দর্যেরও রয়েছে ভিন্নতা। হিমালয় পর্বত মালার স্বতন্ত্র সৌন্দর্য বিশ্বের বৃহত্তম পবর্তশ্রেণি ও বিশ্বের সর্বোচ্চ পর্বত চূড়ার অধিকারী জম্মু ও কাশ্মীর থেকে সুষ্পষ্টভাবে দেখা যায়। চমৎকার তূষারাবৃত হিমালয় পর্বতমালায় সম্মোহিত সৌন্দর্য এক প্রেমমূলক আহ্বান বার বার আপনাকে নিয়ে যাবে কাশ্মীরে। যা কিনা পর্যটকদের স্বপ্নের নিকেতন। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় এর মতে সমর্থন জানিয়ে বলছি, ‘একটি সূর্য ডোবার রং তার সব সৌন্দর্য কি লেখায় আসে’।
লেখক: প্রধান শিক্ষক, বেগম রোকেয়া খন্দকার পৌর উচ্চ বিদ্যালয়, নারায়ণগঞ্জ।