মনির হোসেন, মালে, মালদ্বীপ
মালদ্বীপ ভারত মহাসাগরে অবস্থিত দক্ষিণ এশীয় একটি দ্বীপ রাষ্ট্র। ভারত ও শ্রীলংকার চার’শ মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে এর অবস্থান। যার আয়তন ২৯৮ কিলোমিটার বা ১১৫ বর্গ মাইল। মালদ্বীভিয়ান (ধিভেহি) ভাষায় মালদ্বীপকে বলা হয় “ধিভেহি রাজ্যে জুমহুরিয়া” অর্থাৎ মালদ্বীপ প্রজাতন্ত্র। এর রাজধানী মালে সবচেয়ে জনবহুল নগরী, দেশের কেন্দ্রে অবস্থানের কারণে মালেকে রাজার দ্বীপ বলা হয়। মালদ্বীপে রয়েছে ২৬টি এ্যাটোল (লেগুন ঘেরা প্রবালদ্বীপ) আর ১১৯২টি ক্ষুদ্র দ্বীপ। এগুলোর মধ্যে মাত্র ২০০টি দ্বীপ বাসযোগ্য।
পর্যটনের জন্য বিখ্যাত এ দেশের ভূমির সর্বোচ্চ উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে মাত্র দুই দশমিক তিন মিটার এবং গড় উচ্চতা মাত্র এক দশমিক পাঁচ মিটার। মালদ্বীপ ইহাভানধিপ্পোলহু এ্যাটোল থেকে আদ্দু নগরী পর্যন্ত উত্তর দক্ষিণ বিস্তৃত। মালদ্বীপ ভৌগোলিকভাবে বিশ্বের সবচেয়ে ছড়ানো দেশ এবং ভূমির আয়তন ও জনসংখ্যা উভয় দিক দিয়ে এশিয়ার সবচেয়ে ছোট দেশ। মালদ্বীপের জনসংখ্যা ৪ লাখ ৪৪ হাজার ৫০০ জন এর প্রায় শতভাগই মুসলমান, বিদেশিসহ এখানে প্রায় ৫ লাখ ৯৫ হাজার লোক বসবাস করেন। যার মধ্যে বাংলাদেশি প্রবাসী রয়েছে প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার। যাদের অধিকাংশই তরুণ ও যুবক।
বাসযোগ্য প্রতিটি দ্বীপেই বাংলাদেশি শ্রমিকেরা রয়েছে। কাজের ক্ষেত্রে প্রধানত মেশিন অপারেটর, রংমিস্ত্রী, কার্পেন্টার, কনস্ট্রাকশন শ্রমিক, ইলেকট্রিক্যাল টেকনিশিয়ান, টেইলার, ওয়েল্ডার, পেইন্টার, পরিচ্ছন্ন কর্মী, ড্রাইভার, কৃষি কাজ, লেবার, ওয়েটার, মাছ ধরা, ঘরবাড়ি , রাস্তাঘাট মেরামতসহ অবকাঠামো উন্নয়ন, অফিস আদালত, দোকান, বাসা-বাড়িতে কাজ, ধোনি (নৌকা) চালনা ছাড়াও হোটেল, রেস্তোরা ও রিসোর্টে কাজ করেন প্রবাসী বাংলাদেশিরা। বাংলাদেশি শ্রমিকরাই মূলত মালদ্বীপের দ্বীপগুলোতে প্রথম কৃষি কাজ শুরু করেন।
নৈসর্গিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি, স্বর্গের দ্বীপ, প্রকৃতির কন্যা, সৌন্দর্যের রানী, পৃথিবীর অন্যতম নয়নাভিরাম ও অপরূপ দেশ ইত্যাদি নানা অভিধায় আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে মালদ্বীপকে। মহান আল্লাহ এখানকার প্রকৃতিকে যেন কল্পনাতীতভাবে সাজিয়েছেন। যা দুনিয়াজোড়া মানুষকে মুগ্ধ করে ও টানে। এখানে পৃথিবীর সবচেয়ে উন্নতমানের টুনা মাছ পাওয়া যায়। প্রাচীনকাল থেকেই সামুদ্রিক মাছ দেশটির অর্থনীতির মূল ভিত্তি। তবে বর্তমানে দেশটির পর্যটন শিল্পেও যথেষ্ট উন্নতি করেছে। বলা যায় দেশটির সবচেয়ে বড় শিল্প এখন পর্যটন। মোট আয়ের ২৮ শতাংশ এবং মোট বৈদেশিক আয়ের ৬০ শতাংশই আসে পর্যটন শিল্প থেকে। মালদ্বীপের মূল আকর্ষণ হলো এর সরল, শান্ত ও মনোরম পরিবেশ, আদিম সমুদ্র সৈকত ও ক্রান্তীয় প্রবাল প্রাচীর। এখানকার সমুদ্রের রঙ অতি পরিষ্কার, পানির রঙ কোথাও সবুজাভাব আবার কোথাও নীলাভ, বালির রঙ সাদা। ছোট ছোট দ্বীপগুলো যেন নানান রঙের মাছে সাজিয়ে আছে। জলরাশির দিগন্তজোড়া সমুদ্রবক্ষ, সমুদ্র গর্জন, বায়ুপ্রবাহ যেন তাদের নিজস্ব কণ্ঠস্বর ক্ষণে ক্ষণে পরিবর্তন করে। পর্যটকদের অশান্ত মনকে শান্ত করে। হতাশা দূর করে উচ্ছলতা ফিরিয়ে দেয় আর মুগ্ধতায় ভরিয়ে দেয় মনপ্রাণ। যারা সমুদ্র পছন্দ করেন নির্জনতায় হারিয়ে যেতে চান, সমুদ্র অবগাহনে নিজেকে পরিচ্ছন্ন করতে চান, প্রকৃতির সুশোভিত ও অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করতে চান, তাদের জন্য মালদ্বীপ আকর্ষণীয়, প্রিয় ও আদর্শ স্থান।
মালদ্বীপের ইতিহাস ও ঐতিহ্য খুবই প্রাচীন। মালদ্বীপে রয়েছে রাজধানী মালের সাথে হুলহুলে এয়ারপোর্টের সংযোগ ব্রীজ। ব্রীজটির নাম চীনামালে, ব্রীজটির দৈর্ঘ্য ১.৩৯ কিলোমিটার এবং প্রস্থ ২০ মিটার বিস্তৃত। এখন ব্রীজটি হওয়াতে মালদ্বীপের রাজধানী মালে, এয়ারপোর্ট ও হুলহুমালে নিয়ে মালদ্বীপ সিটিটি অনেক বড়য়ে রূপান্তরিত হয়েছে। মালদ্বীপ খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দী থেকে ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিকভাবে ভারতীয় উপমহাদেশের সাথে যুক্ত। মালদ্বীভিয়ান দ্বীপপুঞ্জে দ্বাদশ শতাব্দীতে ইসলাম আসে এবং একটি সালতানাত হিসেবে সংহত হয়। আর সেই সাথে এশিয়া ও আফ্রিকার সাথে শক্তিশালী বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক গড়ে তোলে। ১১৫৩-১৯৫৩ অবধি ৮০০ বছর ৯২ জন সুলতান নিরবচ্ছিন্নভাবে দ্বীপটি শাসন করেন। বিভিন্ন সময়ে পর্তুগিজ ও ব্রিটিশরা পর্যটক হিসেবে, কখনো কখনো বাণিজ্য কুঠি স্থাপন এবং কখনো ব্রিটিশ সামরিক ঘাঁটি স্থাপনের জন্য এখানে আসে। ষোড়শ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে এই অঞ্চল ঔপনিবেশিক শক্তিগুলোর ক্রমবর্ধমান প্রভাবাধীন আসে এবং মালদ্বীপ ১৮৮৭ সালে একটি ব্রিটিশ আশ্রিত রাজ্যে পরিণত হয়। ১৯৬৫ সালের ২৬ জুলাই মালদ্বীপ ব্রিটিশদের কাছ থেকে পূর্ণ স্বাধীনতা লাভ করে এবং ১৯৬৮ সালে সালতানাতে মালদ্বীপ থেকে প্রজাতন্ত্র মালদ্বীপ পরিণত হয়।
দেশটিতে বর্তমানে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারব্যবস্থা বিদ্যমান। প্রেসিডেন্ট রাষ্ট্র ও সরকার প্রধান। এ দেশের পার্লামেন্টের নাম গণমজলিস। মালদ্বীপের বর্তমান প্রেসিডেন্ট ইব্রাহীম মোহাম্মদ সলিহ্ এবং ভাইস প্রেসিডেন্ট ফাইসাল নাসিম। প্রেসিডেন্ট পাঁচ বছরের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। দেশটিতে সর্বপ্রথম রাজনৈতিক দল গড়ে ওঠে ২০০৫ সালে। সাবেক প্রেসিডেন্ট মামুন আব্দুল গাইয়ুম কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত এ দলের নাম ‘দ্য মালদ্বীপিয়ান পিপলস পার্টি’ একই বছর আরেকটি রাজনৈতিক দলের উদ্ভব হয় ‘মালদ্বীপিয়ান ডেমোক্র্যাটিক পার্টি’ হিসেবে এভাবেই দেশটিতে বহুদলীয় রাজনীতির সূচনা হয়।
মালদ্বীপের প্রশাসনিক অঞ্চল বলতে বুঝানো হয় সরকার বিভিন্ন স্তরকে যাদের নিয়ে মালদ্বীপের স্থানীয় সরকারব্যবস্থা গঠিত। বিকেন্দ্রীকরণ প্রবিধান ২০১০ অনুসারে মালদ্বীপের প্রশাসনিক অঞ্চল অ্যাটোল, দ্বীপ এবং নগরে বিভক্ত, প্রতিটি প্রশাসনিক স্তর নিজস্ব পরিচালনা পরিষদ দ্বারা পরিচালিত হয়, যা স্বায়ত্তশাসন পদ্ধতির আওতাধীন। প্রশাসনিকভাবে মালদ্বীপে বর্তমানে ১৮৯টি দ্বীপ, ১৯টি অ্যাটোল এবং ২টি নগর রয়েছে। ক্ষুদ্র হলেও দেশটিতে আছে নিজস্ব প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। দ্য মালদ্বীপ ন্যাশনাল ডিফেন্স ফোর্স (এমএনডিএফ) নামে তাদের একটি নিজস্ব যৌথ প্রতিরক্ষা বাহিনী আছে। এই বাহিনীর মূল কাজ দেশের নিরাপত্তা এবং সার্বভৌমত্বকে রক্ষা করা। কোস্টগার্ড, ইনফেন্ট্রি সার্ভিস, ডিফেন্স ইনস্টিটিউট ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানগুলো এমএনডিএফ বাহিনী পরিচালনা করে থাকে। এ দেশে ধিভেহি বা মালদ্বীপীয় ভাষা মালদ্বীপের সরকারি ভাষা। এই দ্বীপপুঞ্জের প্রায় সবাই ধিভেহি ভাষার বিভিন্ন উপভাষায় কথা বলে। এছাড়াও এখানে সিংহলি, আরবি এবং বিভিন্ন ভারতীয় ভাষার প্রচলন আছে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও পর্যটন শিল্পে ইংরেজি ভাষা ব্যবহার করা হয়। ভেলেনা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর মালদ্বীপের প্রধান প্রবেশদ্বার। সরকারি মালিকানাধীন আইল্যান্ড এভিয়েশন সার্ভিসেস মালদ্বীভিয়ান ভারত ও বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক পরিবহন করে থাকে। মালদ্বীপ দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থার (সার্ক) প্রতিষ্ঠাতা সদস্য।