ক ম জামাল উদ্দীন, আবহা, সৌদিআরব:
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার বিজয় নগর উপজেলার লক্ষীপুর, পত্তন গ্রামের ছাবেরা যার পাসপোর্ট নং (BP 0843267) । সৌদি আরবে নিয়োগকর্তা (কপিল) কর্তৃক অমানুষিক নির্যাতনের স্বীকার হয়ে দেশটির আসির প্রদেশের আবহা থেকে দেশে যাচ্ছেন আজ ১২ ডিসেম্বর ।
ঘটনার বিবরণে জানা যায়, তিনি গত দেড় বছর আগে দালালের মাধ্যমে ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় সৌদি আরব আসেন । ঢাকার একটি ট্রাভেল এজেন্সী তাকে হাসপাতলের ক্লিনারের ভিসা দেয়ার কথা বলে তার কাছ থেকে এক লক্ষ টাকা নেন এবং মাসিক এক হাজার দুইশত সৌদি রিয়াল বেতনের চুক্তি করেন ।
কিন্তু তিনি সৌদি আরবে এসে দেখেন, দালালদের কথার সাথে কাজের মিল নাই, বিমান বন্দর থেকে তাকে গ্রহণ করেন এক সৌদি নাগরিক (তার নিয়োগকর্তা)। তখন তার আর বুঝার বাকি ছিলনা যে, তার ভিসা ছিল গৃহকর্মীর (খাদ্দামার) । যদিও এক লক্ষ টাকা পরিশোধ করেছিলেন তিনি হাসপাতালের ক্লিনার এর ভিসার জন্য ।
উল্লেখ্য যে, গৃহকর্মীর ভিসাগুলোতে কোন টাকা দিতে হয় না সবগুলো নিয়োগকর্তা বহন করে। তিনি নিরুপায় হয়ে নিয়োগকর্তার সাথে তার বাসায় চলে যান এবং কাজ করতে থাকেন । হঠাৎ আচমকা একদিন তার নিয়োগ কর্তা তাকে কাচের বোতল থেকে কী খেয়ে (তার ভাষায় সম্ভবত মদ্য জাতীয় কিছু) কু-প্রস্তাব দেন । এবং তাকে বিভিন্ন রকমের টাকা পয়সা ধন সম্পদের লোভ দেখান। তিনি প্রস্তাবে রাজি না হলে তার উপর নেমে আসে অমানবিক নির্যাতন ।
নির্যাতনের বর্ণনা দিতে কান্না ধরে রাখতে পারেননি ছাবেরা। কান্না অবস্থায় বলেন, যখন আমি তার কু-প্রস্তাবে সাড়া দিতে অসম্মতি জানাই তখন আমাকে আমার পড়নের সম্পূর্ণ কাপড় খুলে আমাকে বিবস্ত্র করে একটি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে আবদ্ধ করে রাখে। আমার মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নেন যাতে কারো সাথে যোগাযোগ করতে না পারি । এভাবে প্রায় ২/৩ দিন অতিবাহিত হওয়ার পর আমাকে পুনরায় কু-প্রস্তাব দিতে থাকে অসম্মতি জানানোর পর আমার গায়ে ক্লোরক্স (কাপড় কাচার এক ধরণের কেমিক্যাল) ঢেলে দেয় এবং আমাকে ইলেকট্রিক আয়রন গরম করে আমার পুরো শরীরে সেকা দিতে খাকে, বুকের উপর জোড়ে জোড়ে লাথি এবং কিল ঘুষি মারতে থাকে । এভাবে কয়েকদিন অতিবাহিত আমাকে বিবস্ত্র অবস্থায় নির্জন একটি পাহাড়ের উপর নিয়ে যায় এবং ওখান থেকে ফেলে দেওয়ার ভয় দেখায় আমাকে তার প্রস্তাবে রাজি করানোর জন্য ।
এমতাবস্থায় আমি তাকে বলি আমি এই পাহাড় থেকে লাফ দিয়ে মরে যাব তবুও আমার ইজ্জত দিবনা । এ অবস্থায় পাহাড় থেকে নেমে বাসায় যাওয়ার পথে এক সৌদি মহিলা আমাকে পুরাতন ম্যাক্সি (কাপড়) দিলে আমি আমার লজ্জা নিবারণ করি । পথিমধ্যে পুলিশের গাড়ি দেখে চিৎকার দিলে পুলিশ আমাকে উদ্ধার করে হাসপাতলে নিয়ে যায় এবং আমার কপিলকে গ্রেফতার করে । এরপর আমি আর কিছু মনে করতে পারছিনা । প্রায় ২২ দিন পর আমি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসলে আমাকে জেল খানায় নিয়ে যায় । আমি জানতে পারি যে, আমার নামে বিভিন্ন অজুহাতের ৩টা মিথ্যা মামলা দায়ের করে রাখছে । আমি আরবি ভাষায় পারদর্শি না হওয়ায় এবং আত্মপক্ষ সমর্থন দিতে না পারায় মিথ্যা মামলাগুলোর অজুহাতে আমাকে প্রায় ১১ মাস জেল খানা এবং সেফ হোমে কাটাতে হয় ।
আবহা সেফ হোমে থাকাকালীন একদিন বাংলাদেশ কনস্যুলেট জেনারেল জেদ্দার আসির প্রদেশ প্রতিনিধি আব্দুল হকের সাথে সাক্ষাৎ হলে আমি ওনাকে সব খুলে বলি । তখন আমি যেন ধু ধু মরভূমির তপ্তবালির মধ্য একটি মরুদ্যান খুজেঁ পাই এবং মহান আল্লাহর কাছে শোকরিয়া জ্ঞাপন করি।
আব্দুল হক ভাই জেদ্দা কনস্যুলেটের নিকট অবহিত করে এবং মামলার শুনানিতে তিনি সহ জেদ্দা কনস্যুলেটের কয়েকজন শ্রম কাউন্সিলর আমার পক্ষে অংশ নিয়ে আমাকে মামলা খালাস করতে সহযোগিতা করে এবং জেদ্দা কনস্যুলেটের আর্থিক সহায়তায় আমাকে আবহা -ঢাকার বিমান টিকেটের ব্যবস্থা করে দেয়।
ইতোমধ্যে জেল খানা থেকে ছাড়া পাওয়ার পর জেল কর্তৃপক্ষ আমাকে আমার কপিলের নিকট হস্তান্তর করলে আবার আমার উপর অমানুষিক নির্যাতন করতে থাকে। আমি আব্দুল হক ভাইকে এ ব্যাপারে অবহিত করালে, আব্দুল হক ভাইয়ের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা এবং জেদ্দা কনস্যুলেট জেনারেল সহায়তায় আমি জালেম কপিলের হাত মুক্ত হতে পেরেছি এবং বাংলাদেশ সরকারের সাহায্যের কথা শ্রদ্ধার সাথে অকপটে স্বীকার করছি এবং সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি ।
আমার বাংলাদেশি মা বোনদের উদ্দেশ্য করে বলছি তারা যেন এদেশে গৃহকর্মীর ভিসায় না আসে যদিও জীবিকার তাগিতে নিতান্তই আসতে হয় তাহলে সৌদি আরবে অবস্থানরত কোন আপনজনদের কাছ থেকে যাচায় করে এবং ভিসার পেশা সহ অন্যান্য ডকুমেন্টগুলো কোন শ্রম আইন জানা আইন বিশারদের নিকট গিয়ে পর্যালোচনা করে তারপর সৌদি আরবে আসে ।
এ ব্যাপারে জেদ্দা কনস্যুলেট প্রতিনিধি আব্দুল হকের নিকট জানতে চাইলে, তিনি প্রবাস মেলাকে বলেন, আমি প্র্রায় সময় আবহা সেফ হোমে যাই। একদিন নির্যাতিত ছাবেরা আমাকে ওখানে দেখলে তিনি আমাকে তার নির্যাতনের কথা সব খুলে বলে। আমি এ ব্যাপারে বাংলাদেশ কনস্যুলেট জেনারেল, জেদ্দা কর্তৃপক্ষের নিকট অবহিত করলে ওখান থেকে আমাকে নির্যাতিতার জন্য সবরকম সাহায্য করার আশ্বাস দেন ।
আমি জেলখানাস্থ তার ফাইল তালাস করে দেখতে পাই তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন অজুহাতের ৩টি মিথ্যা মামলা দায়ের করা হয় । এরপর থেকে আমি কোর্টের বিভিন্ন শুনানিতে অংশ নিতে থাকি এমনকি একটি শুনানিতে জেদ্দা কনস্যুলেটর মাননীয় শ্রম কাউন্সিলর আমিনুল ইসলাম, কাজী সালাউদ্দীন ও আলতাফ হোসেন স্যার ও সুদূর জেদ্দা থেকে আবহা এসে অংশ নেন । এভাবে দিনের দিনের পর দিন অপেক্ষা করে তাকে খালাস করে আনি এবং তার কপিলের কাছ থেকে পাসপোর্ট সংগ্রহ করি।
আজ ১২ ডিসেম্বর তাকে বাংলাদেশে পাঠানো ব্যবস্থা করি । জেদ্দা কনস্যুলেট কর্তৃক সম্পূর্ণ আর্থিক খরচ বহন করে আবহা-জেদ্দা বিমানের টিকেট প্রদান করে নির্যাতিতাকে।