এম এ খালেক
বেশ কিছু দিন ধরেই পরিকল্পনা করছিলাম সীমান্ত শহর পঞ্চগড় যাবার জন্য। কিন্তু ব্যাটে বলে এক হচ্ছিল না, তাই যাত্রা শুরু করতে পারছিলাম না। অবশেষে গত ফেব্রুয়ারি মাসের ২৪ তারিখ পঞ্চগড় যাবার পরিকল্পনা চূড়ান্ত করা হলো। ‘কাছে এসো’ পরিবারের ৫ সদস্য প্রফেসর জহিরুল হক ভূইয়া, হাবিবুল্লাহ কলেজের অবসরপ্রাপ্ত প্রিন্সিপাল আবদুল বাতেন, বিশিষ্ট ব্যবসায়ি হেলাল উদ্দিন, বিশিষ্ট সাহিত্যিক কাজী এনায়েত হোসেন এবং আমি এই যাত্রায় সামিল হলাম।
পঞ্চগড় ভ্রমণের পরিকল্পনা করি মূলত সেখানকার সমতল ভূমিতে চা বাগান পরিদর্শন করা এবং সম্ভব হলে কাঞ্চনজঙ্গা পাহাড়ের চূড়া দেখার জন্য। যাত্রা শুরুর বেশ কয়েক দিন আগেই আমরা ট্রেনের টিকিট ক্রয় করি। আমরা নির্ধারিত দিনে অর্থাৎ ২৪ ফেব্রুয়ারি সকালে কমলাপুর রেল স্টেশনে গেলাম। আমরা সকাল ১০টায় কমলাপুর রেল স্টেশনে গিয়ে জানতে পারলাম পঞ্চগড়গামী ট্রেন ইতোমধ্যেই স্টেশন ছেড়ে গেছে। এখানে একটু ভুল বুঝাবুঝি হয়েছিল। ট্রেনের টিকিট কমলাপুর থেকে ইস্যু করা হলেও তাতে বিমানবন্দর থেকে যাত্রা শুরুর কথা উল্লেখ ছিল। ফলে আমরা নির্ধারিত সময়ে স্টেশনে উপস্থিত হওয়া সত্ত্বেও ট্রেন মিস করি। একজন প্রস্তাব করলেন, আজ যাত্রা স্থগিত করে অন্য একদিন যাই। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম যেভাবেই হোক আজই আমরা পঞ্চগড় যাবো।
পরবর্তীতে স্টেশন ম্যানেজারের নিকট গিয়ে আমাদের সমস্যার কথা জানিয়ে তার সহযোগিতা কামনা করি। তিনি বললেন, আপনারা যদি রাজি থাকেন তাহলে আমি একই টিকিটে পরবর্তী নীলসাগর ট্রেনে যাবার ব্যবস্থা করে দিতে পারি। তবে নীলসাগর ট্রেন সরাসরি পঞ্চগড় যাবে না এটা চিলাহাঁটি পর্যন্ত যাবে। সেখান থেকে বিকল্প ব্যবস্থায় পঞ্চগড় যাওয়া যাবে। আমরা তাতেই রাজি হলাম। প্রায় দেড় ঘন্টা স্টেশনে অপেক্ষা করার পর দুপুর সাড়ে ১২টায় নীলসাগর ট্রেন স্টেশন ছেড়ে গেলো। আমরা ৫ জনই একটি কামরায় আসন গ্রহণ করি। আশে পাশের চমৎকার সব দৃশ্যাবলী দেখতে দেখতে আমরা চিলাহাঁটির দিকে যেতে থাকলাম। বিশেষ করে গ্রামের মধ্য দিয়ে ট্রেন এগিয়ে চলছিল আর আমরা প্রাণ ভরে গ্রামীণ সৌন্দর্য। বর্তমান সরকারের একটি বিশেষ নির্বাচনী অঙ্গিকার হচ্ছে শহরের সুবিধাকে গ্রামে সম্প্রসারিত করা। আমার যেটা মনে হয়, সরকারের এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য তেমন কোনো কিছু করতে হবে না। কারণ ইতোমধ্যেই দেশের প্রায় প্রত্যেকটি গ্রাম শহরের মতো হয়ে উঠেছে। গ্রাম আর আগের সেই অজ পাড়াগাঁ নেই। অধিকাংশ গ্রামে শহরের সুবিধা এবং কালচার সম্প্রসারিত হয়েছে। এখন শুধু অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য সরকার সহায়তা করলেই চলবে।
গ্রাম বাংলার নয়ন জুড়ানো সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে এক সময় সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো। আমরা রাজশাহী পেরিয়ে গেলাম। ট্রেন অত্যন্ত ধীর গতিতে চলছিল বলে বেশ সময় লাগছিল। মাঝে মাঝে বিভিন্ন স্টেশনে ট্রেন যাত্রা বিরতি করছিল। রাজশাহী এলাকা পেরোনোর সময় আম এবং লিচু বাগান চোখে পড়ছিল। দিগন্ত প্রসারী এসব আম বাগান দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়। ইতোমধ্যেই আম গাছে মুকুল ধরেছে। মনে হচ্ছে চলতি মৌসুমে আমের ভালো ফলন হবে। ট্রেনে আমরা কফি সহযোগে হাল্কা নাস্তা খেলাম। আমরা ট্রেনের যে কামড়ায় ছিলাম সেখানে আরো অনেক যাত্রী ছিলেন। বিভিন্ন শ্রেণি পেশার যাত্রীদের সঙ্গে আমাদের আলাপ জমতে সময় লাগেনি। সারা রাস্তা আমরা নানা ধরনের গল্প করতে করতে বেশ আনন্দেই চলতে থাকলাম। যাত্রীদের অনেকেই আগ্রহ নিয়ে আমাদের সঙ্গে আলাপ করলেন। আমাদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে অবহিত হয়ে তারা বেশ অবাক হলেন। বিশেষ করে ৫জন সিনিয়র সিটিজেন এভাবে ভ্রমণে বেরোতে পারে এটা যেনো তাদের কল্পনারও বাইরে। তাই তারা আমাদের সঙ্গে বেশ খাতির জমানোর চেষ্টা করেন।
দু’ব্যক্তি আমাদের নিকট জানতে চাইলেন, আমরা কিভাবে চিলাহাটি থেকে পঞ্চগড় যাবো? কারণ চিলাহাটি থেকে পঞ্চগড় বেশ দূরে অবস্থিত। তারা আমাদের মাইক্রোবাস ভাড়া করে দেবার আগ্রহ প্রকাশ করলেন। আমরা তাদের মধ্যে একজনের সঙ্গে মাইক্রো বাস ভাড়া করা নিয়ে দর দাম ঠিক করলাম। তিনি তুলনামূলক কম মূল্যে তার পরিচিত এক ভদ্রলোককে অনুরোধ করলেন আমাদের চিলাহাটি থেকে পঞ্চগড় নিয়ে যাবার জন্য। আমরা চিলাহাটি স্টেশনে নামার পর ভদ্রলোক আমাদের নিয়ে একজন মাইক্রোবাস চালকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। তিনি আমাদের চিলাহাটি থেকে পঞ্চগড় নিয়ে যাবেন। মাইক্রোবাস চালক বেশ আন্তরিকতার সঙ্গে আমাদের চিলাহাটি থেকে পঞ্চগড় নিয়ে গেলেন। আমরা যখন চিলাহাটি রেল স্টেশনে নামি তখন রাত প্রায় ১১টা বাজে। তাই আমরা সেখানে নেমেই রাতের খাবার খেয়ে নিলাম। কারণ গভীর রাতে হোটেল বন্ধ হয়ে যাবার আশঙ্কা ছিল। এরপর আমরা পঞ্চগড়ের দিকে রওনা দিলাম। রাস্তায় তেমন কিছুই দেখা যাচ্ছিল না নিকস কালো ঘন অন্ধকার ছাড়া।
গভীর রাতে আমরা পঞ্চগড় শহরে প্রবেশ করি। সেখানে পূর্ব থেকেই অপেক্ষমান দু’জন ছাত্র আমাদের নির্ধারিত হোটেলে পৌঁছে দিয়ে চলে গেলো। যেহেতু রাত গভীর হয়ে গিয়েছিল তাই সে দিনের মতো আমরা ঘুমিয়ে পড়লাম। পরদিন সকালে স্থানীয় একটি রেস্টুরেন্টে সকালের নাস্তা করি। এই সময় স্থানীয় একজন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে আলাপ হলো। তিনি বেশ আগ্রহ সহকারে আমাদের নানাভাবে আমাদের সহযোগিতা করতে থকালেন। তিনি আমাদের একটি অটোরিক্সা ঠিক করে দিলেন সারা দিনের জন্য। আমরা সেই অটোরিক্সা নিয়ে প্রথমেই বাংলাবান্ধা গেলাম। বাংলাবান্ধা বাংলাদেশ এবং ভারতের মধ্যে যে সীমান্ত রেখা আছে অর্থাৎ জিরো পয়েন্ট সেখানে আমরা ঘুরে ঘুরে দেখলাম। অনেকেই সেখানে ছবি তুলছিল।
এরপর আমরা তেতুলিয়া গেলাম। সেখানে মহানন্দা নদীর তীরে কিছুক্ষণ অবস্থান করি। এই নদীর তীরে দাঁড়িয়ে আমরা অপর পাড়ে ভারতীয় ভূখন্ড দেখতে পেলাম। বাংলাদেশি শ্রমিকরা নদীতে নেমে পাথর তুলছে। অনেক দিন নদীর তীরে এভাবে দাঁড়ানো হয়নি। তাই বেশ ভালোই লাগছিল। এরপর আমরা অধুনালুপ্ত ভারতীয় ছিট মহল ‘গাবাতি’ পরিদর্শন করি। এ সময় আমরা বীর মুক্তিযোদ্ধা নূরুল ইসলাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গমণ করি। সেখানে আমরা বেশ কিছুক্ষণ অবস্থান করি। এই এলাকায় সবচেয়ে ভালো লাগলো চা বাগানগুলো। আমাদের দেশে সাধারণ ধারণা প্রচলিত আছে যে,পাহাড়ি এলাকা ছাড়া চা বাগান করা যায় না। কিন্তু পঞ্চগড়বাসী প্রমাণ করেছেন সমতল ভূমিতেও চা বাগান গড়ে তোলা সম্ভব। এই অনেক দিন আগে থেকেই বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী ভারতীয় এলাকায় চা আবাদ হচ্ছিল। কিন্তু বাংলাদেশে কেনো যেনো চা চাষের উদ্যোগ নেয়া হয় নি। এটাই বিস্ময়ের ব্যাপার।
২০০০ সাল থেকে পঞ্চগড়ে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে চা আবাদ শুরু হয়। প্রচুর পরিমাণ জমিতে এখন বাণিজ্যিক ভিত্তিতে চা চাষ হচ্ছে। এই এলাকার মাটি চা চাষের জন্য খুবই অনুকূল। একই সঙ্গে এখানে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে কমলার চাষ হচ্ছে। সারা দিনের ভ্রমণ শেষে আমরা সন্ধ্যায় পঞ্চগড় শহরে ফিরে আসি। কিন্তু আকাশ বিরূপ থাকার কারণে কাঞ্চনজঙ্গা পাহাড় দেখা সম্ভব হয় নি।
রাতে হোটেলে অবস্থান করে পরদিন সকাল বেলা আমরা ফিরতি ট্রেনে ঢাকায় চলে আসি। পঞ্চগড়ে আমরা মোট দুই রাত এক দিন ছিলাম। তবে এই সংক্ষিপ্ত সফরটি ছিল অত্যন্ত আনন্দদায়ক। আমরা সেখানে না গেলে বুঝতে পারতাম না পঞ্চগড় এবং তারা আশেপাশের এলাকায় কিভাবে অর্থনৈতিক কর্মকান্ড পরিচালিত হচ্ছে। বিশেস করে নদী থেকে উত্তোলিত পাথর কেন্দ্রিক ব্যবসায় অত্যন্ত গতিশীল ভাবে পরিচালিত হচ্ছে। বাংলাদেশের প্রত্যন্ত এলাকাও এখন অর্থনৈতিক কর্মকান্ড থেকে পিছিয়ে নেই।
(লেখক পরিচিতি: জেনারেল ম্যানেজার (অব:), বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেড)।