মুহাম্মদ আনোয়ার শাহাদাত হোসেন: মানব জীবনে জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সকল প্রয়োজনের সুন্দর ও সাবলীল সমাধান এবং পথ নির্দেশিকা রয়েছে ইসলামে। মানুষ সামাজিক জীব। তাই তাকে সমাজবদ্ধ হয়ে বাস করতে হয় এবং বিভিন্ন সামাজিক রীতিনীতি অনুসরণ করে চলতে হয়। পৃথিবীর আদিকাল থেকে আজ পর্যন্ত প্রত্যেকটি সমাজে কিংবা লোকালয়ে সভ্য মানুষগুলো একে অপরের সাথে পরিচিত হবার, মেলামেশা করার কিংবা ভাব বিনিময়ের বিভিন্ন পদ্ধতি বা অভিবাদন বাক্য ব্যবহার করে আসছে। আর এই অভিবাদন কী হওয়া চাই তার সার্বজনীন ও সর্বকালীন একটি সুন্দর পদ্ধতি ইসলাম আমাদেরকে উপহার দিয়েছে যা সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠায় এক বিশাল ও কার্যকর হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। ইসলামের অভিবাদন পদ্ধতি যেমনি চমৎকার তেমনি এর ভাষা শৈলীও অত্যন্ত মনোমুগ্ধকর। যার প্রভাবে শত্রু মুহূর্তের মধ্যে বন্ধুতে পরিণত হয়, রাগান্বিত ব্যক্তির মধ্যে ফুটে উঠে নমনীয়তা, অপরিচিত ব্যক্তি সহজেই হয়ে উঠে পরিচিত, ঝিমিয়ে পড়া আত্মীয়তার সম্পর্ক হয়ে উঠে সতেজ ও হৃদ্যতাপূর্ণ। যে অভিভাদনে মানুষ খুঁজে নির্মল শান্তির আহবান, নিরহংকার আর নির্মোহতার একক অনন্য দৃষ্টান্ত, দাম্ভিকতাকে চূর্ণ করে পরস্পরের মধ্যে সৃষ্টি করে অহিংসা আর বিনয়ের এক স্বর্গীয় স্রোতধারা। নিঃসন্দেহে সেই অভিবাদন হচ্ছে- আস্সালামু আলাইকুম অর্থ্যাৎ আপনার প্রতি শান্তি বর্ষিত হোক।
সালাম শব্দটি আরবি ‘সালামুন’ শব্দ থেকে উৎপত্তি যার অর্থ হলো- শান্তি, কল্যাণ ও নিরাপত্তা। প্রাক ইসলামি যুগে আরব সমাজে অভিভাদন হিসেবে আন ‘আমাল্লাহু বিকা আইনান অর্থ্যাৎ ‘আপনার দ্বারা আল্লাহ আপনার প্রিয়জনদের চক্ষু শীতল করুন’ এই অভিভাদন বাক্য প্রচলন ছিল। ইসলামের আবির্ভাবের পর মানবতার মুক্তির দূত বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাললাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম প্রাক ইসলামী যুগের অভিবাদন প্রক্রিয়া পরিবর্তন করে সর্বস্তরে সালামের নির্দেশ দেন। সালাম যে শুধু আখেরী নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাললাহু আলাইহে ওয়াসাল্লামের সময় থেকে শুরু হয় তা কিন্তু নয়। অন্যান্য নবীগণের সময়েও সালামের প্রচলন ছিল। যেমনটি আল কোরানের সূরা হূদ-এ বলা হয়েছে- ‘অবশ্যই আমার প্রেরিত ফেরেশতারা ইব্রাহীমের কাছে সুসংবাদ নিয়ে এসেছিলেন, তারা বললেন-সালাম, তিনিও বললেন, সালাম (আয়াত নং-৬৯)। বস্তুত সালাম দেয়ার বিধান মহান আল্লাহ প্রদত্ত। যেমন- আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন – রাসুলুল্লাহ সাল্লাললাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘আল্লাহ তা’আলা আদম (আ:) কে সৃষ্টি করে বললেন, যাও ফেরেশতাদের সালাম দাও এবং মন দিয়ে শোন তারা তোমার সালামের কী জবাব দেয়। এটাই হবে তোমার ও তোমার সন্তানদের সালাম। আদম (আ:) গিয়ে বললেন আস্সালামু আলাইকুম। ফেরেশতাগণ জবাব দিলেন, আস্সালামু আলাইকা ওয়া রাহমাতুল্লাহ। ফেরেশতাগণ ‘ওয়া রাহমাতুল্লাহ’ অংশটি বৃদ্ধি করলেন। (মিশকাত শরীফ, হাদিস-৪৬২৮) সালাম শব্দটি ছোট হলেও এর সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধ এবং কার্যকরীতা বিস্ময়কর। একজন মানুষের প্রতি অপর মানুষের ছয়টি হকের কথা হাদীস শরীফে বলা হয়েছে তারমধ্যে প্রথমটি হচ্ছে- পরস্পরের মধ্যে সাক্ষাত হলেই যেন বলে আস্সালামু আলাইকুম। কী সুন্দর ইসলামের নৈতিকতা! পরিচিত-অপরিচিত, আত্মীয়-অনাত্মীয়, ধনী-গরীব, ছোট-বড়, সাদা-কালো সে যেই হোক না কেন দেখা মাত্র তার শান্তি কামনা করা। আর তার উত্তরে অপর পক্ষ থেকেও যেন আরো একটু বাড়িয়ে শান্তি কামনা করা, পরস্পর পরস্পর থেকে নিরাপত্তার ঘোষণা দেয়া। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন পবিত্র কালামুল্লাহ শরীফে এরশাদ করেন- আর যখন তোমাদেরকে সালাম দেয়া হবে তখন তোমরা তার চেয়ে উত্তম সালাম দেবে। অথবা জবাবে তাই দেবে’- (সূরা নিসা, আয়াত:৮৬ ) ভাবুনতো একটু করে যদি আমরা সর্বস্তরে সালামের প্রচলন করি তাহলে আজকের বিরাজমান অশান্তির পরিবর্তে সমাজে শান্তির ফল্গুধারা বয়ে যাবে কিনা! সালামের কারণে ব্যক্তির অন্তরের কৃপণতা আর হীনমন্যতা দূর হয়ে হৃদয়কে করে প্রশস্ত। দাম্ভিকতার পরিবর্তে মানব হৃদয়ে উদ্রেক হয় নমনীয়তা, কারো প্রতি মনে যদি কোন ধরনের খারাপ চিন্তা থাকে সালামের কারণে তা বিদূরিত হয়ে হৃদয়ে বন্ধুত্বের বীজ উপ্ত হয়। একজন আরেক জনের সাথে সাক্ষাতেই যখন তার মঙ্গল কামনা করেন, পরস্পর পরস্পরের নিরাপত্তা কামনা করেন সেখানে তো আর কোন শত্রুতা জাগ্রত হতে পারেনা। সালামের কারণে শুধু ব্যক্তি বা সামাজিক জীবনে প্রভাব পড়ে তা নয়, সালামের মাহাত্ম এবং পরকালীন পুরস্কার হচ্ছে একজন মুমিন মুসলমানকে জান্নাত পর্যন্ত পৌঁছে দেয়া। তাইতো সালামের ব্যাপক প্রচলনের ব্যাপারে বিশ্ব মানবতার মুক্তির দূত আল্লাহর প্রিয় রাসুল সাল্লাললাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম বিশেষ গুরুত্বারোপ করেন। যেমন হযরত আবু হুরায়রা (রা:) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন- রাসুলুল্লাহ সাল্লাললাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না, যতক্ষণ না তোমরা ঈমান আনয়ন করবে। আর তোমরা ঈমানদার হিসেবে গণ্য হবে না যতক্ষণ না তোমরা পরস্পরকে ভালবাসবে। আমি কি তোমাদের এমন কথা বলে দিব না যা করলে তোমাদের পারস্পরিক ভালবাসা বৃদ্ধি পাবে? তোমরা পরস্পরের মাঝে সালামের প্রসার করবে’- (মুসলিম/মিশকাত শরীফ)। সালাম শুধু জাগতিক সম্ভাষণ নয় এটা জান্নাতেরও সম্ভাষণ। জান্নাতবাসীদেরকে ফিরিশতাগণ জান্নাতের প্রত্যেকটি দরজায় দাড়িয়ে সালাম বলে সম্ভাষণ জানাবে। স্বয়ং আল্লাহ রাব্বুল আলামীন জান্নাতবাসীদেরকে সালাম জানাবেন (সূরা ইয়াছিন দ্রষ্টব্য)। হাদীস শরীফে এসেছে একদা এক ব্যক্তি রাসুল সাল্লাললাহু আলাইহে ওয়াসাল্লামকে প্রশ্ন করল, হে আল্লাহর রাসূল! ইসলামে কোন আমলটি সর্বোত্তম? উত্তরে রাসুল সাল্লাললাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম বললেন, মানুষকে খানা খাওয়ানো এবং তুমি যাকে চিনো আর যাকে চিনো না সবাইকে সালাম দেয়া’-(বুখারি ও মুসলিম)। আমাদের সকলের উচিত মহান ইসলামের সর্বোত্তম এই আমলকে ব্যক্তি জীবনে প্রতিফলন ঘটিয়ে অনৈসলামিক সব সম্ভাষণ বাক্য এবং প্রক্রিয়া ছেড়ে দিয়ে ইহজাগতিক ও পরলৌকিক জীবনের জন্য কল্যাণকর সালামের প্রচলন জীবনের প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে আরো ব্যাপকতর করা। ঘরে, স্কুলে, কলেজে, দোকানে, অফিসে, রাস্তা-ঘাটে, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে প্রত্যেক জায়গায় যেখানে যার সাথে দেখা হয় আমরা যদি পরস্পর সালামের প্রচলনকে আরো ব্যাপকভাবে প্রসার ঘটাতে পারি তাহলে সমাজ ভরে উঠবে শান্তির সুনির্মল আভায়।
লেখক: কলামিস্ট, সৌদি আরব।