এবিএম সালেহ উদ্দীন:
কবি শামসুর রাহমান (১৯২৯-২০০৪) বাংলা সাহিত্যাদর্শের স্থায়িত্বনির্ভর একটি অবিস্মরণীয় নাম। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে পৃথিবীর টলটলায়মান সময়ে ১৯২৯ সালের ২৪ অক্টোবর ঢাকার মাহুতটুলির ঐতিহ্যগাথা নানাবাড়িতে তাঁর জন্ম। বাবা মোখলেসুর রাহমান চৌধুরী ছিলেন তখনকার দিনের একজন সুশীলধারার সংস্কৃতিবান মানুষ। শিক্ষাদীক্ষায় আদি খান্দানি ব্যবসায়ী। তিনি কবিতা ও সাহিত্যের মানুষ না হলেও তাঁর ভেতর শিল্পবোধ ছিল। মা আমেনা বেগমের ১০ সন্তানের মধ্যে শামসুর রাহমান ছিলেন সবার বড়। ব্যক্তিগতভাবে সেই পুরান ঢাকার ঐতিহ্যের খান্দানিধারার মধ্য থেকে শামসুর রাহমান চৌধুরী বাচ্চু ক্রমে ক্রমে হয়ে ওঠেন পূর্ণায়ত ও পূর্ণাঙ্গ কবি শামসুর রাহমান।
পৃথিবীর প্রাণিকুলের মধ্যে মানুষ ব্যতিক্রম। এই ব্যতিক্রমের শীর্ষজুড়ে রয়েছে মানুষের সৃষ্টিশীলতা। সৃজন, মনন ও কর্মের বিশিষ্টতায় এ জন্য মানুষই সৃষ্টির সেরা। মানুষ গড়তে পারে, ভাঙতে পারে এবং মানুষই ইতিহাসের স্রষ্টা। সৃজন, স্বভাবগত মননশীলতা ও কর্মের মধ্য দিয়ে মানুষ অমর হয়ে থাকে। কৃষ্টি, সভ্যতার নিরিখে মানবীয় গুণাবলির ভিত্তিতে সমাজ ও জাতির উন্নতির পেছনেও মানুষই সক্রিয় ও শক্তিমান। মানুষের এসব গুণ মহান স্রষ্টার কাছ থেকে পাওয়া। মানুষই সবচেয়ে বেশি মনন ক্ষমতা ও গুরুমস্তিষ্কের অধিকারী। জ্ঞান-বিজ্ঞান, বুদ্ধি-বিবেচনাবোধ আর মেধা ও মননের ফলেই উদ্ভাবনার অমিত শক্তিতে মানুষের সমতুল্য কেউ নেই।

তবে অমর থাকার পেছনে সব মানুষের সাফল্যের দিকটি একরকম নয়। প্রত্যেকের ভিন্নরূপ ও ভিন্নতর আঙিকে তার পরিস্ফুটন ঘটে। কবি শামসুর রাহমানের অবস্থানটি বহুমাত্রিক বিত্তবৈভবে আকীর্ণ। কবিতার স্বর্ণচূড়ায় আরোহনের মাধ্যমে তিনি কৃতিমান হয়েছেন। তিনি বাংলা সাহিত্যে তথা আধুনিক বাংলা কবিতার স্রষ্টাদের অন্যতম। এ ব্যাপারে কোনো রাখঢাক না রেখেই উল্লেখ করতে হবে যে তিনি তাঁর কবিতা ও ঈর্ষণীয় আকাশচুম্বী কাব্যসৃষ্টির কারণেই সাহিত্যভুবনে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
শামসুর রাহমানের মানস ও বর্ণময় জীবনের কিছু টুকরো দিকের আলেখ্য ছাড়া তাঁর কবিতা নিয়ে আলোকপাত করার যোগ্যতা আমার নেই। তবে তিনি আপাদমস্তক একজন কবিতার মানুষ ছিলেন, তা দৃঢ়ভাবে বলতে পারি। তাঁর কবিতার সর্ববিস্তারী মর্ম ক্রমে ক্রমে উপলব্ধি করা যায়।যখন তাঁর সৃষ্ট পঙ্্ক্তিমালার গভীরে ডুব দেওয়া যাবে।
কবিতা প্রসঙ্গে ‘লর্ড আলফ্রেড’-এর একটি বিখ্যাত উক্তি হচ্ছে, ‘সব ভালো কবিতাই আচ্ছন্ন করে আমাদের। আস্তে আস্তে মধুর পারম্পরের সঙ্গে, রক্ত ও রোদনের সঙ্গে।’ স্বাধীনতা, ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধসহ চিরায়ত ও উচ্চমার্গের সে রকম মহৎ কবিতা শামসুর রাহমানের সৃষ্টিতে সমুজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। স্বাধীনতার কবি হিসেবেও তিনি খ্যাতিমান। আর এ প্রসঙ্গে আরও উদ্ধৃতি দেওয়া যায়। যেমন টি এস এলিয়ট বলেছেন, ‘মহৎ কবিতা জীবনদৃষ্টি ও বোধের কল্প সত্যকে উপস্থাপন করে।’ এ ক্ষেত্রে ‘গ্যেটে’ তো আরও স্পষ্ট করে বলেছেন, ‘কবিতা মানুষের চিরায়ত সম্পদ। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে সবখানে, সব সময়ে, সব মানুষের হৃদয়ে তাকে স্থাপন করা যায়।’
এ হচ্ছে সৃষ্টিশীল কবিতার আসল তত্ত্ব, যেখানে কবিতা সর্বযুগে সব প্রজন্মের জন্য নিবেদিত থাকে।
উল্লেখ্য, জীবনের ঘাত-প্রতিঘাতের সৃষ্টিশীলতায় বাংলা কবিতার ভুবনে শামসুর রাহমান একটি স্থায়ী আসন দখল করে নিয়েছেন। পেশায় সাংবাদিকতার মধ্য দিয়ে সমগ্র জীবন কাটালেও সাহিত্যকর্মের প্রায় প্রতিটি শাখায় তাঁর যথোপযুক্ত সঞ্চরণের মধ্যে কবিতার জমিনের দখলদারি তাঁকে অমর করে রাখবে।
সাংবাদিকতা করতে গিয়ে চৌকস বুদ্ধিমত্তা প্রদর্শন ছিল তাঁর লেখকসত্তার একটি বিশেষ টেকনিক। সর্বপ্রথম ইংরেজি পত্রিকা ‘মর্নিং নিউজ’-এ সহকারী সম্পাদক হিসেবে কর্মে যোগদান। চার-পাঁচ বছর পর তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের অধীন দৈনিক পাকিস্তান স্বধীনতার পরবর্তীতে দৈনিক বাংলায় সহকারী সম্পাদক ও দীর্ঘদিন সম্পাদনা এবং পরবর্তীতে দৈনিকা বাংলা ট্রাস্টভুক্ত সাপ্তাহিক বিচিত্রার সম্পাদক হিসেবে যোগদান করেন। পত্রিকায় সম্পাদকীয়, উপ-সম্পাদকীয় ছদ্মনামে লিখতেন। সেই নামগুলো হচ্ছে সিন্দবাদ, চক্ষুষ্মান, লিপিকার, নেপথ্যে, জনান্তিকে, মৈনাক এবং কলকাতার একটি পত্রিকায় মজলুম আদিব ইত্যাদি। তিনি কোনো রাজনীতিতে জড়াননি। কিন্তু শোষণ, নিপীড়ন ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে কলাম লিখেছেন। অনুরূপ তাঁর কবিতার মূল বিষয় হচ্ছে স্বাধীনতা ও গণমানুষের স্বার্থকেন্দ্রিক। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে তাঁর কবিতাগুলো প্রেরণাদায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করে। তাই তো সরকারনিয়ন্ত্রিত পত্রিকায় কাজ করেও কবিতার সংক্ষুব্ধ সত্যবোধ তাঁকে তাড়িত করে। অনেক সময় চাকরি রক্ষা এবং রুটি-রুজির স্বার্থে লেখার ক্ষেত্রে গোঁজামিল দিতে হয়েছে এবং বিরুদ্ধবাদীদের সমালোচনা সইতে হয়েছে। কিন্তু কবিতার ক্ষেত্রে সেটি ছিল অন্য রকম বেপরোয়া ও অপ্রতিরোধ্য। বাইরের বাহ্যিক চাকচিক্য থাকলেও সেই আক্ষেপ ও কষ্টবোধ তাঁকে সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। ‘দুঃসময়ে মুখোমুখি’ কবিতায় কবি নিজের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে নিজেকে উদ্দেশ করে বলেন-
‘না, তোকে বসতে বলবো না
কস্মিনকালেও
তুই যা, চলে যা।
দেখছিস না আমার হাতে কত কাজ, দুঘণ্টায় পাঠক-ঠকানো
নিপুণ সম্পাদকীয় লিখতেই হবে, তদুপরি
আছে দীর্ঘ প্রতীক্ষায় দেশ-বিদেশের বহু চিঠির জবাব
এবং প্রুফের তাড়া, নিত্যনৈমিত্তিক
কবিতার সোনালী তাগিদ।’
কবি জন্মেছিলেন ঢাকার মাহুতটুলির নানাবাড়িতে। তাঁর ডাকনাম ছিল বাচ্চু। নিজের প্রতি প্রশ্ন ছুড়ে আক্ষেপসূচিত বক্তব্যে এই দীর্ঘ কবিতায় কখনো বাচ্চু আবার কখনো শামসুর রাহমান সম্বোধন করেছেন।
আবার মাতৃভাষার গৌরব ও মর্যাদাকে বক্ষে ধারণ করে কবি আনন্দের জয়গান গেয়েছেন। নিজের সামগ্রিক সত্তা দিয়ে গৌরবান্বিত হয়ে উচ্চারণ করেন
‘হে আমার আঁখিতারা তুমি উন্মীলিত সর্বক্ষণ জাগরণে।
তোমাকে উপড়ে নিলে, বলো তবে, কী থাকে আমার?
উনিশ শো বায়ান্নোর দারুণ রক্তিম পুষ্পাঞ্জলি
বুকে নিয়ে আছো সগৌরবে মহিয়সী।’
অসাধারণ মেধা ও তীক্ষবুদ্ধির অধিকারী ছিলেন আমাদের কবি শামসুর রাহমান। কাব্যচর্চায় সম্পূর্ণ স্বাধীনচেতনার এক সম্মোহনী শক্তির অভিধারায় তিনি বাংলা কাব্যজগতে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়ে রয়েছেন।
কবি শামসুর রাহমানকে বাংলা সাহিত্য ও আধুনিক কবিতার বরপুত্র বলা হয়ে থাকে। তাঁকে নগরের কবিও আখ্যা দেওয়া যায়। বাংলার মাটি, মানুষ, তরুলতা ও প্রাণিকুলের বিষয়াবৃত্তি, নারী, নদী, প্রেম রোমান্টিকতার অনুরণনে প্রখর চেতনাবোধ ও সৃজনশীলতাই তাঁকে একজন পূর্ণাঙ্গ কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। শিশুকাল ও শৈশব হচ্ছে একজন মানুষের জীবনের সুতীক্ষ্ণ স্মৃতিধারা। মানুষের বেড়ে ওঠার সঙ্গে শৈশবের স্মৃতিপর্বও তার সঙ্গে চলতে থাকে। সে কারণেই হয়তো শামসুর রাহমানের মাঝে শৈশব ও কৈশোর তাঁর স্মৃতিতে সমুজ্জ্বল চেরাগের মতো সর্বদা যুক্ত ছিল। মাহুতটুলি তথা সেই সময়কার ঢাকা শহরের পিঙল মাটির ঘর, কাছারি, দোকানপাট, দালানকোঠা, সহিস, গাড়ি-ঘোড়া, মসজিদ-মন্দিরসহ সবকিছুই জীবনস্মৃতিতে জড়িয়ে আছে।
এ জন্য তিনি ‘জনৈক সহিসের ছেলে’ কবিতায় বলেন:
‘ঘোড়ার নালের মতো চাঁদ
ঝুলে আছে আকাশের বিশাল কপাটে, আমি একা
খাড়ের গাদায় শুয়ে ভাবি
মুমূর্ষু পিতার কথা, যার শুকনো প্রায়-শব প্রায়-অবাস্তব
বুড়োটে শরীর
কিছুকাল ধরে আঠা দিয়ে সাঁটা
বিছানায়।’
একই কবিতায় তিনি জানান দেন-
‘অথচ আমার স্বপ্নে রহস্যজনক ঘোড়া নয়,
কতিপয় চিমনি, টালি, ছাদ, যন্ত্রপাতি, ফ্যাক্টরির
ধোঁয়ার আড়ালে ওড়া পায়রার ঝাঁক
এবং একটি মুখ ভেসে ওঠে, আলোময় মেঘের মতোই
একটি শরীর’
নিজের শৈশব ও কৈশোর নিয়ে এমন নিখাদ বর্ণনা দিতে পারেন যে কবি, তাঁর কাব্যবোধের মেদহীন জমিন কতটা বিস্তৃত তা ভাবলেও আমাদের গর্বিত হতে হয়। তিনি তাঁর বৈচিত্র্যময় বর্ণিল জীবনে সব ঘটনা-দূর্ঘটনার স্মৃতিপর্ব এবং মানুষের মনের ভাষা ও বোধকে নিবিড়ভাবে কবিতার অলংকরণে স্থায়ীরূপে সাজিয়ে দিয়েছেন। নিজের বংশ, পরিবার-পরিজন, মাতা-পিতা কেউ সেই সব ফুলেভরা স্মৃতি থেকে বাদ পড়েনি। যেমন মমতা মা নিয়ে তাঁর একাধিক কবিতার একটি বিখ্যাত কবিতা ‘কখনো আমার মাকে’ কবিতায় তার অকুণ্ঠ স্বীকৃতি বহাল। তিনি বলেন-
‘কখনো আমার মাকে গান গাইতে শুনিনি।
সেই কবে শিশু রাতে ঘুম পাড়ানিয়া গান গেয়ে
আমাকে কখনো ঘুম পাড়াতেন কি না আজ মনেই পড়ে না।’
শেষের লাইনগুলো এমন-
‘যেন তিনি সব গান দুঃখ-জাগানিয়া কোন কাঠের সিন্দুকে
রেখেছেন বন্ধ করে আজীবন, এখন তাদের
গ্রন্থিল শরীর থেকে কালেভদ্রে সুর নয়, শুধু
ন্যাপথালিনের তীব্র ঘ্রাণ ভেসে আসে!’

তিরিশের দশকের কবিতার সিঁড়ি বেয়ে পঞ্চাশের দশকে শামসুর রাহমান একজন পূর্ণাঙ্গ কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। এ জন্যই দুই বাংলার শ্রেষ্ঠ সাহিত্য সমালোচক ও রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আবু সয়ীদ আইউব দৃঢ়ভাবে উচ্চারণ করেন, ‘তিরিশের পরে শামসুর রাহমানই বাংলা কবিতার প্রধান কবি।’
‘কবিতার সঙ্গে গেরস্তালি’ দীর্ঘ কবিতায় মাত্র আট বছরের বালক তিনি কীভাবে রবীন্দ্রনাথে ডুব দেন, সেই বর্ণনার একপর্যায়ে বলেন, ‘চল্লিশের দশকের গোধূলিতে কবিতার সঙ্গে, বলা যায়,
‘আমার ঘনিষ্ঠ জীবনযাপন হলো শুরু।
তখনই সঞ্চয়িতা উপহার হয়ে
এসেছিল আমার হাতে। কিছুকাল আমি
মগ্ন হয়েছিলাম তাতে, যেমন কোনো দরবেশ
সমাধিস্থ হন অনন্ত কি অসীমের প্রেমে
কিন্তু কী যে হলো, পঞ্চাশের দশকে প্রত্যুষ
আমাকে ছুঁতেই সেই ঘোর গেল কেটে-
তিরিশের কবি-সঙ্ঘ দিলেন প্রবল ডাক, পোড়ো জমি থেকে
হাতছানি দিলেন এলিয়ট, কান পাতলাম—’
কবি শামসুর রাহমানের এসব কবিতা যখন পড়ি, তখন মনে হয় আমরা আমাদের অস্তিত্বের নিপাট সন্ধান পেয়ে যাই।
দেশ, সমাজ ও সংস্কৃতিতে পোক্ত হতে হতে চলনে, বলনে ও স্বভাবে তিনি একজন রহস্যময় রোমান্টিক চৌকস বুদ্ধিদীপ্ত চক্ষুষ্মান মানুষ। যাঁর দৃষ্টিলোক থেকে সমাজ ও বিশ্বের অনেক কিছুই এড়িয়ে যায় না। গণমানুষের মুক্তি, স্বাধীনতা ও ভালোবাসার জন্য আকুলতা তাঁর কবিতা ও সাহিত্যধারার প্রধান চালিকাশক্তি। ইস্পাতকঠিন শহরের যান্ত্রিক জীবনের বিকারগ্রস্ততা ও হৃদয়হীনতার অনেক বৈষম্যের বিকট চেহারা কবিকে আপ্লুত করে ও কাঁদায়। তাড়িত করে। সংক্ষুব্ধ করে তোলে। স্বাধীনতার জন্য মুক্তিপাগল মানুষের সাথে কবিকে বারবার প্রশ্নবিদ্ধ করে-
‘তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা
তোমাকে পাওয়ার জন্যে
আর কতবার ভাসতে হবে রক্তগঙ্গায়?
আর কতবার দেখতে হবে খা-বদাহন?’
যে ভারতবর্ষের শতকোটি দারিদ্র্যপীড়িত মানুষের হাজার বছরের আকুতি শুধু স্বাধীনভাবে জীবিকা ও মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা। যার জন্যে কত রক্তক্ষরণের সাগর পার হয়ে সর্বশেষ নিজের ভাষাভাষী একটি স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের চলমান সাগরে হাবুডুবু খেয়েও নজরুলের বিদ্রোহী কবিতার মতো একাত্তরে লেখা কবিতাটিসহ এমন কিছু কবিতা যুগে যুগে ঝংকৃত হতে থাকবে।
যে স্বাধীনতাকে তিনি মনেপ্রাণে ভালোবাসেন, হৃদয়ে ধারণ করেন, সেই স্বাধীনতার ভরা যৌবনকে চমৎকার অঙ্গসজ্জায় সাজাতে থাকেন। স্বপ্নের আনন্দ নীলিমায় উড়তে উড়তে উচ্ছ্বাসভরা স্বাদ ও রঙের তুলিতে আঁকেন। মনের আনন্দে নৃত্য করতে করতে তিনি গেয়ে ওঠেন-
‘স্বাধীনতা তুমি
রবিঠাকুরের অজর কবিতা, অবিনাশী গান
স্বাধীনতা তুমি
কাজী নজরুল, ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো
মহান পুরুষ, সৃষ্টিসুখের উল্লাসে কাঁপা-
স্বাধীনতা তুমি
শহীদ মিনারে অমর একুশে ফেব্রুয়ারির উজ্জ্বল সভা
স্বাধীনতা তুমি
পতাকা-শোভিত স্লোগান-মুখর ঝাঁঝালো মিছিল।’
জীবদ্দশায় ভারতবর্ষের পরাধীনতার গ্লানি, প্রহসনের স্বাধীনতা, বায়ান্নর মহান ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ ও যুদ্ধোত্তর বিশ্ব নানা সময়ে নানাভাবে দেখেছেন। বিশ্বের মুক্তিপাগল মানুষের মতো বাংলাদেশের মানুষের দুঃখ-দুর্দশা জনগণের অন্ধকারাচ্ছন্ন ভবিষ্যৎ দূরবীক্ষণের মতো পর্যবেক্ষণ করেছেন। অবক্ষয়ী সমাজের একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে তিনি কোনো রকম রাজনৈতিক ডামাডোলে গা ভাসিয়ে না দিয়েই সারা জীবন রুটি-রুজির চাকরিরত অথবা চাকরিচ্যুত অবস্থার কোনো একটু সময়ের জন্যও নিজের বিবেকবোধকে বিকিয়ে দেননি। নিজের ঐতিহ্য ও আভিজাত্যকে জলাঞ্জলি দেননি। এ জন্য তাঁকে অনেক কষ্ট ও অপবাদ সহ্য করতে হয়েছে।
কুসংস্কারের বিরুদ্ধে এবং স্বাধীনতাবিরোধীদের বিরুদ্ধে তাঁর প্রতিবাদী চেতনা থাকার কারণে তিনি অনেক অপবাদ সয়েছেন। কিন্তু তাঁর সাহিত্যচর্চা এক মুহূর্তের জন্যও থেমে থাকেনি। তাঁর প্রতিবাদের ভাষা প্রথাসম্মত রুচিকর, অনুসন্ধিৎসা এবং সাবলীল ভাষণ নান্দনিক মধুরতায় ভরপুর। তাঁর কবিতায় দ্রোহ, প্রতিবাদ, প্রেম-রোমান্টিকতা ও আত্মসংগ্রামের ব্যবস্থা আছে। কবিতার পঙ্্ক্তিমালার স্তবকে স্তবকে তিনি যে ভুবন তৈরি করেছেন, বাংলা সাহিত্য থেকে কখনো তা বিলীন হবে না। অক্ষয় হয়ে থাকবে।
তেমনই সমাজের বৈষম্য তথা রাষ্ট্রপুঞ্জের সীমাহীন নিপীড়ন-নিষ্পেষণ আর সামরিক শাসনের উৎকট ঈগলচেহারা দেখে কবিও ক্ষুব্ধ এবং মাঝে মাঝে ঝলসে ওঠেন। তাঁর কবিতার বিশাল সাহিত্যভান্ডারের কারণেই তাঁকে সংগ্রামব্যাকুল স্বাধীনতার কবি, প্রগতির কবি এবং সর্বমানবিকতার কবিও বলা যায়।
শামসুর রাহমান বাংলা সাহিত্যের একজন প্রতিভাবান ছন্দ-সচেতন পরিশ্রমী কবি। তাঁর উদ্যম কবিতার বিনির্মাণে উদ্যোগী ও ক্লান্তিহীন আবিষ্কারক।
ইংরেজি সাহিত্যের তুখোড় মেধাবী ছাত্র হিসেবে এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমএ ডিগ্রি সম্পন্ন না করেই বিশ্ব সাহিত্য ও কবিতা সম্পর্কে সম্যক জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন কবি শামসুর রাহমান। তাঁর অনুবাদকর্ম ছিল নির্ভুল। জীবনের প্রথম সাংবাদিকতার চাকরিটি তৎকালীন বিখ্যাত ইংরেজি পত্রিকা মর্নিং নিউজের সহকারী সম্পাদক পদে যোগদান করে সম্পাদকীয় ও উপসম্পাদকীয় লিখেছেন। বাচনভঙ্গি চাল-চলনের রীতিতে তিনি ছিলেন নাগরিক জীবনের আভিজাত্যের প্রতীক। তাঁর সম্মোহনী শক্তি ছিল রোমান্টিকতায় ভরপুর। সামনে না গেলে তা সেই সব রোমাঞ্চকর সৌন্দর্যকে উপলব্ধি করা কঠিন। এমন বিজ্ঞজনের সংখ্যা জগতে খুব কমই পাওয়া যায়। একটা সময় প্রায়ই তাঁর সামনে যাওয়া এবং তাঁকে ইনিয়ে-বিনিয়ে দেখার সুযোগ হয়েছে। তিনি সব সময়ই স্মৃতির নন্দনভুবনে সমুজ্জ্বল হয়ে আছেন।
আধুনিক বাংলা কবিতার কবিসম্রাট হিসেবে তিনি অমর হয়ে থাকবেন। জীবন ও কর্মের বহুমাত্রিক বৈশিষ্ট্যের ঔজ্জ্বল্যে বেঁচে থাকবেন চিরকাল। কবিতাই তাঁকে অমর করে রাখবে।
লেখক: কবি ও প্রাবন্ধিক, যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী।