সত্যরঞ্জন সরকার, কুয়েত সিটি, কুয়েত
লোভ, লালসা, হিংসা, বিদ্বেষ এ সব নেতিবাচক শব্দ। নেতিবাচক শব্দগুলোই আজ আমাদের চিরসাথী হতে চলেছে। যে সব সমর্থক নীতিবাক্য এক সময় ছোট বেলায় শিশু পাঠ্যসূচীতে জায়গা করে নিয়েছিল, তা মননে ও মগজে এমনভাবে প্রোথিত হয়েছিল যে তার সুফল আজও সে প্রজন্মের মানুষেরা উপভোগ করে। ‘লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু’- এসব সাধারণ কথা কিন্তু অসাধারণ এর তাৎপর্য।
লোভ-লালসা তথা অপ্রাপ্তি জনিত ক্ষোভ ও অন্তঃকরণের যে ভাব, তার বহি:প্রকাশ যখন ঘটে এবং মনকে বার বার প্রলুব্ধ করে সেটা প্রাপ্তির জন্য উৎসাহিত হলে তখন যে কোন মূল্যে সেটা প্রাপ্তির যে অপচেষ্টা সেটাই লোভ-লালসা। লোভ লালসার শিকারে সমাজে আজ পরিত্রাহী চিৎকার। লোভের আগুনে চারিদিকে পুড়ে ছাড়খার। আজ স্বল্পে বা অল্পে সন্তুষ্ট মানুষের সংখ্যা নগণ্য। সবাই আরও বেশী পেতে চাই, বেশী চাওয়ার যৌক্তিকতার পারিপার্শি¦ক প্রভাব, ‘আমার থেকে ওর বেশী এ মনোভাব, সবার মনেজগতকেই যেন আজ আন্দোলিত, আলোড়িত করছে’।
মানুষের মনুষ্যত্ববোধ মানবিকতা আজ লোভের কাছে পরাস্ত, পর্যুদস্ত। আত্মীয় অনাত্মীয়, পাড়া প্রতিবেশী, চেনা অচেনা এমনকি রক্তের সম্পর্কও আজ লোভ নামক দানবের হাতে বন্দী। ফাঁকি দেওয়াটা লোভেরই নামান্তর। ফাক বুঝে শরিকী ফাঁকি, ফাক বুঝে স্ত্রী স্বামীকে ফাঁকি, পিতা-পুত্রকে, পুত্র পিতাকে এমনকি ‘ভালোবাসার’ ক্ষেত্রেও আজ ফাঁকির কারবার। ভালোবাসা আজ অভিনয়ের মোড়কে ঢাকা। অন্তকরণের “বিশুদ্ধতা” যার মূল উপাদান সেখানেও লাভ আর লোভের হুল ফুটানোর কারণে ভালোবাসা আজ বিবর্ণ। ভালোবাসার পারস্পারিক সম্পর্ক মন ‘দেওয়া নেওয়া’ সেটাও আজ প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির কষ্টিপাথরে বিচার্য। লাভ লোকসানের হিসাব কষেই আজ জীবনসঙ্গীর হাত ধরা পিছনে থাকে লোভের ও লাভের হাতছানি। আইনের কব্জায় অতিরিক্ত মুনাফার আশায় বিয়ে বিয়ে খেলার পূর্ব নির্ধারিত ছকে কত নিষ্পাপ জীবনকে আত্মবলিদান দিতে হয়েছে বা হচ্ছে কে তার খোঁজ রাখে? লোভে তাড়িত জীবনের আনন্দ কোথায়? প্রাপ্তিতে? নাকি ভোগে? প্রাপ্তি ঘটলেও ভোগভাগ্য ক’জনার ভাগ্যে জোটে? ক্ষণস্থায়ী জীবনে কতটুকু দরকার? কতটুকু সঞ্চয়ে, কতটুকু ভোগে সন্তুষ্ট জীবদ্দশায় আমাদের এসব পরিমাপের কোন মাপকাঠি নেই। যা পরিমাপযোগ্য নয়, তার অনন্ত পিপাসা মানুষকে কেন তাড়িত করবে? ভোগ লালসার এমনকি শক্তি যার কাছে আমরা বার বার পরাজিত হয়ে আমাদের নৈতিকতা বোধকে প্রশ্নের সম্মুখীন দাঁড় করাবে?
সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলার জন্য প্রতিযোগিতায় যার মনে অন্যায় বোধ, অনৈতিকতা, হিংসা, এ সব কোন মানসিক উৎপীড়ণ তৈরী করে না, বিবেকবোধ যেখানে নিদ্রারত যা জাগ্রত হয় না, বা জাগ্রত করার চেষ্টাও করা হয় না এমনতর পরিস্থিতিতে লালসার, ভোগলিপ্সার মাত্রা যে বেড়ে যাবে তা নিশ্চিত। ভাবতে হবে আমরা কি তাহলে এ সবের কাছে আত্মসমর্পন করবো? নিশ্চয়ই না, পার্থিব জগতে যা কিছু সুন্দর যা কিছু ভোগ্য সেখানে প্রকৃতিপ্রদত্ত একটা সীমারেখা টানা আছে। সীমাহীন কোন কিছুই প্রকৃতিও ভালোবাসে না। সে সীমারেখাকে আমরা দেখতে পাই না, তা উপলব্ধি করতে হয়। উপযোগ মিটলে নিশ্চয় স্বাদও-বিস্বাদ হয়। পেট ভরার জন্য যতটুকু দরকার তার অতিরিক্ত পেটে পড়লে পেটের পীড়া ডেকে আনবে। আমরা ভাবতে চাই না লোভ লালসার বিষে সমাজ জর্জরিত হোক। প্রয়োজন, অপ্রয়োজন কতটুকু তা নির্ধারণের ক্ষেত্রে আমরা যেন বিবেককে কাজে লাগাতে পারি। বিবেকের সঙ্গে ভাবনাগুলো সুসংহত হলেই আমরা প্রয়োজনটুকুকে লোভের উচ্চ শিখর থেকে নামিয়ে আমার মত করে উপভোগ করতে পারি।
লোভের ধাবমান গতিকে রুখতেই হবে। উপার্জন যেন লোভের ফসল না হয়, উপার্জিত বস্তু বা দ্রব্য যেন উত্তরাধিকারীদের ভোগ বিলাসের কারণ হয়ে না দাঁড়ায়। উপার্জনকারীর সুবিবেচনা প্রসূত জমারাশি স্বার্থকভাবে বন্টিত হলে পরিবারে শান্তি ও স্বস্তি দান করে। আহম্মকের মত অতিব্যয়ের, অতিজাহির করার প্রবণতা যেন রুদ্ধ হয়, বন্ধ হয়। লোক দেখানো আমিত্বের জাহির অর্থ সম্পদে হলেও মননে, মানসিকতায়, প্রজ্ঞায় বিবেচনায় যারা শ্রেষ্ঠ, তাঁদের কাছেই থাকে সমাজ সংসার। হঠাৎ আঙুল ফুলে কলাগাছ হওয়াকেই আমরা ধনী হবার মাপকাঠি মনে করি, কিন্তু কিভাবে কোন পন্থায় তার এই আয়, সেদিকে আমরা খেয়াল করিনা। অথচ পরিবারের সদস্যরাই জানেন কিভাবে আয়ের ¯্রােত স্ফীত হলে ভোগ বিলাসের মত্ততায় জাহান্নানামের দিকে এগিয়ে যায়। বৈধ উপার্জনে প্রশংসা, পুরস্কার, অবৈধ উপার্জনে পরিবারের মধ্য থেকেই যদি, তিরস্কার জোটে তাহলে কিছুটা হলেও অবৈধ আয় উপার্জনে লাগাম টানা পড়বে।
লোভের ফসল ‘অবৈধ আয়’ হিংসাকেও ডেকে আনে। লোভের ফসল আমরা অবৈধ আয়ের ভাগ বাটোয়ার নিয়ে খুন খারাবি সামাজিক অস্থিতিশীলতা, রাজনৈতিক টানাপোড়েন লক্ষ্য করি। হিংসা, বিদ্বেষ মানুষের মনোজগতে বাহ্যিক চাকচিক্যের হাতছানিতে মনের মধ্যে না পারার চর্চিত ভাবনার উগ্রতার বহিঃপ্রকাশ। নেই পেতে হবে পেতে গেলে প্রতিবন্ধকতার কারণে সৃষ্ট অহংবোধেই মানুষকে হিংসুটে করে তোলে। হিংসুটেরাই ভাইরাস হিংসাকে ছড়িয়ে দেয়, সঙ্গে বিদ্বেষ ভাবাপন্নরা বিদ্বেষপ্রসূত মননে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ বিস্তৃতিতে সাহায্য করে। যা দাবানলের মত দ্রুত গতিতে ছড়িয়ে পড়ে, চেনা মানুষকেও অচেনা করে। ভাঙ্গণের শব্দ, হারানোর শব্দ বিবেকবর্জিত হিংসা বিদ্বেষের কারণে তখন শোনা যায়না। শুনবার কান থাকে তখন বধির, চোখ থাকে অন্ধ, মুখ তাকে মুক। মূঢ়তার জেরবারে ‘অহম’ এর আস্ফালনে চোখের নেশায় থাকে তখন অমাবশ্যার কালো অন্ধকার। যে অন্ধকার ভেদ করে আলো দেখা, পাশবিকতাকে দমন করে মানবিকতার ফুল ফুটানো তা আর সম্ভব হয় না।
মানবতার ক্রন্দনধ্বনী গুমরে গুমরে কেঁদে মরে। দুঃশ্চিন্তা, ‘সুচিন্তাকে’ গলা টিপে হত্যা করে। বিদ্বেষ, একপ্রকার ঘৃণা। যা অপছন্দতাকে গ্রহণ না করা, কিংবা অপছন্দজনিত কারণে মনে মনে ঘৃণা করাকে বিদ্বেষপ্রসূত কর্ম বলা হয়। ইদানিং আমরা জাত পাত নিয়ে, ধর্ম নিয়ে, লিঙ্গভিত্তিক মানুষ নিয়ে বিদ্বেষ ছড়াচ্ছি, যার পরিণতিতে অনেক সময় সামাজিক ভারসাম্য নষ্ট হয়। নিজেরাই নিজেদের ক্ষতি করে চলেছি। পার্থিব জগতে বিদ্বেষ সব চাইতে ক্ষতিকর, কারণ বিদ্বেষ প্রসূত যে সব কর্মকা- ঘটে, সেখানে হিংসা, হানাহানির যুগলবন্ধনে সামাজিক ভারসাম্য নষ্ট করে। মানুষে মানুষে বিভেদের বীজ রোপিত হয় বিদ্বেষের মাধ্যমে। চেনা মানুষও হয় তখন অচেনা-অতএব হিংসা, বিদ্বেষের দাবানল অবশ্যই নিভাতে হবে আমাদের জন্যে আমাদের প্রয়োজনে।
প্রত্যেক মানুষের মধ্যেই আছে সত্য ও সুন্দরের প্রতি ভালোবাসার ভালো লাগার উপাদান। উপাদানের আধার তার মন, সে মন ও মননে বিশুদ্ধতার অক্সিজেন যদি ক্রিয়াশীল হয় তবেই লোভ, লালসা, হিংসা, বিদ্বেষ, জীঘাংসা থেকে সে মুক্তি পেতে পারে। ‘বিশুদ্ধতা’ পারিবারিক মূল্যবোধের পরম্পরা যা শৈশবেই শিশুমনে রোপিত হলে তার ফসল অনিবার্যভাবে কেউ একা আস্বাদন করবে না বরং সামাজিক সুস্থতায় তা স্যালাইনের মত কাজ করবে। আজও সমাজে এমন কিছু পরিবার এবং সেসব পরিবারের সদস্যরা আছে যারা পারিবারিক মূল্যবোধকে জলাঞ্জলি না দিয়ে দুর্গন্ধময় এ সমাজকে পাশ কাটিয়ে তাদের স্বতন্ত্রতা বজায় রেখে নিজস্ব ভাবধারায় নির্ধারিত পথেই এগিয়ে যাচ্ছে-তারাই আমাদের চলার পথের পাথেয়। চেনা মানুষের ভীড়ে তারা অচেনা হলেও সঠিক দিক নির্দেশনায় তারা কার্পন্য করেন না। প্রতিবাদে, প্রতিরোধে এরা একা হলেও তাদের একাকীত্বের আলোর ঝলকানি হঠাৎ দুর্যোগময় রাতেও বিদ্যুৎ চমকের মত দৃষ্টিগ্রাহ্য হয়ে ওঠে।
প্রাপ্তি যোগের প্রতিবন্ধকতায়, হিংসার জন্ম, অন্ধ আবেগ যা বিচার বুদ্ধির স্থিরতা নির্ধারণে অক্ষম, এমনতর টলটলায়মান মনের গভীরে কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থায় হিতাহিত জ্ঞান শূন্য মানবাকৃতির পশুরা কি না করতে পারে। তার জন্য নিকট অতীতের অনেক উদাহরন টেনে আনা যেতে পারে। সহজাত প্রবৃত্তি মানুষ মানুষকে ভালোবাসবে। কিন্তু ইদানিং হিংসাশ্রয়ী মানুষের যে রূপ সমাজের অলিতে গলিতে লক্ষ্য করছি বিশেষত হিংসার আবহে ধর্ষণজনিত অপরাধের অপরাধিরা পাশবিক ও পৈশাচিক যে কর্মকান্ড ঘটাচ্ছে তাতে শংকা জাগে মানুষের নূন্যতম মূল্যবোধের শিক্ষা কি পরিবার থেকে সে অর্জন করেনি? প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না পেলেও এ সব নরাধমেরা তাদের পরিবার থেকে কি কিছুই শিখেনি?
না পাবার বেদনা মানুষকে আগ্রাসী করে পাবার জন্য সর্বান্তকরনের শুভ চেষ্টা ব্যর্থ হলে তার হিংস্র স্বভাবের তথা হিংসার মশাল জ্বলে ওঠে। মনস্তাত্বিকভাবে এরা রোগাক্রান্ত, মনোরোগী। হিংসার বশবর্তী হয়ে এরা কী পারে আর কী পারে না, ইদানিং শিশু ধর্ষণকারীর সংখ্যা বৃদ্ধিই তার প্রমাণ। সমাজের অলিতে গলিতে এদের বিচরণ এদের কর্মকান্ডে সাধারণ জনতাও হিংসাশ্রয়ী হয়ে উঠবে।
মোদ্দাকথা অন্যায়কে অন্যায় দিয়েই প্রতিরোধ করার প্রবণতা জন্ম দেবে, যা দেশ ও জাতির জন্য মঙ্গলজনক হবে না। চুরি ছিনতাইজনিত অপরাধে ধরা পড়ার পরে জনতার হাতে যেভাবে মারধরের ঘটনা ঘটে, কিংবা বাস-ট্রাক চাপা পড়ার পরে মৃত্যুকে কেন্দ্র করে যে হিংসার আগুন ছড়িয়ে পড়ে যা কারোরই কাম্য নয়। তাহলে এসবের প্রতিকার হবে কিভাবে? হিংসা, বিদ্বেষ তৈরীর কারখানা কোথায়? মানুষের নৈতিকতাবোধের জায়গায় দাঁড়িয়ে মানবিকতার মশালে যদি আলোকিত করে পথ চলতে পারে, ন্যায় অন্যায়বোধের পার্থক্য যদি বিবেক দিয়ে বুঝতে পারে ‘হিংসা হিংসাকেই ডেকে আনে’ এ মর্মবাণী যদি সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করানো যায় তবেই আমরা এ মারাত্মক ব্যাধি হিংসা, বিদ্বেষ, লোভ লালসার হাত থেকে রেহাই পাবো।
(লেখক, কুয়েত সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা)