খুব ছোট থাকতেই গানের প্রতি আলাদা একটা টান ছিল। গানের প্রতি অগাধ প্রেম দেখে তার বাবা তৃতীয় শ্রেণিতে থাকা অবস্থাতেই একটা হারমোনিয়াম কিনে দিয়েছিলেন। প্রাথমিকে পড়া অবস্থাতেই প্রখ্যাত লোকদের থেকে নজরুল গীতি ও ক্ল্যাসিক্যাল গানে শিক্ষা নিয়েছেন। এখন তিনি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ১৯টি ভাষায় গান গাওয়ার গৌরব অর্জন করেছেন। এতক্ষণ বলছিলাম সংগীতশিল্পী কাজী কল্পনার কথা। বর্তমানে তিনি লন্ডনের সাউদেন্ড অন সী-তে পরিবার নিয়ে বসবসা করছেন। সম্প্রতি কাজী কল্পনা আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে এসেছিলেন প্রবাস মেলা কার্যালয়ে। কথা বলেছেন তার সংগীত জীবনের নানা বিষয় নিয়ে। সেসবের চুম্বক অংশ প্রবাস মেলার পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো।
জন্ম ও বেড়ে উঠা
কাজী কল্পনার পৈত্রিক নিবাস ঢাকার দোহারে। তবে জন্ম চট্টগ্রাম। তার বাবা মরহুম কাজী আহাদুজ্জামান ছিলেন রেলওয়ের অ্যাকাউন্টস অফিসার। চাকরি সুবাদে তিনি পরিবার নিয়ে চট্টগ্রাম থাকতেন। সেখানেই কাজী কল্পনার জন্ম। জন্মের চার বছরের মধ্যে তার বাবার সঙ্গে আবার ঢাকায় ফিরে আসেন। কাজী কল্পনার পড়াশোনা শুরু হয় মতিঝিল প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। এরপর মতিঝিল সে›ট্টাল গভর্মেন্ট স্কুল থেকে এসএসসি এবং ইডেন মহিলা কলেজ থেকে এইচএসসি কৃতিত্বের সঙ্গে পাশ করেন। পরে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বোটানিক্যাল গার্ডেন (উদ্ভিদ বিদ্যা) থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেন।
গানে যেভাবে আসলেন
ছোটবেলা থেকেই কাজী কল্পনার গানের প্রতি আলাদা একটা টান ছিল। স্কুলে ভর্তি হওয়ার আগে তিনি বাড়িতে প্রাথমিকের পাঠ পরিবার থেকেই নিয়েছিলেন। বয়স যখন পাঁচ বছর তখন তার বাবা স্কুলে ভর্তি করতে নিলেন। তার বাবার ইচ্ছা ছিল কল্পনা যেহেতু প্রাথমিকের অনেক কিছু বাড়িতেই শিখেছে তাই তাকে দ্বিতীয় শ্রেণিতে ভর্তি করাবে। কিন্তু স্কুলের শিক্ষক কোনোভাবেই তাকে দ্বিতীয় শ্রেণিতে ভর্তি করাতে রাজি ছিলেন না। এক পর্যায়ে তাকে একটি গান গাইতে বললেন, কল্পনা তখন একটি গান গাইলেন। শেষ হওয়ার পর শিক্ষক আরেকটি গান গাইতে বললেন। এভাবে তিনি তিনটি গান গাইলেন। এসময় স্কুলের সকল শিক্ষার্থীরা গান শুনতে শিক্ষকের রুমের সামনে হাজির হয়ে যায়। বিষয়টির স্মৃতিচারণা করে কাজী কল্পনা বলেন, আমার গান শুনে শিক্ষক আমাকে দ্বিতীয় শ্রেণিতে ভর্তি করালেন।
গানের হাতেখড়ি
কাজী কল্পনা স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর একই বছর বুলবুল ললিতাকলা একাডেমি মতিঝিল শাখা থেকে নজরুল গীতি এবং ক্ল্যাসিক্যাল গানে শিক্ষা নিতেন। তৃতীয় শ্রেণিতে ক্লাসে প্রথম হওয়ার পর তার বাবা একটি হারমোনিয়াম কিনে দিয়েছিলেন। সেসময় ওস্তাদ মো. ফজলুল হক বাড়িতে এসে তাকে গান শিখাতেন। এছাড়া তিনি এম এ মান্নান, রওশন আরা মোস্তাফিজ, সোহরাব হোসেন, ইয়াকুব আলীসহ আরও অনেকের কাছ থেকে গানের তালিম নিয়েছেন।
প্রাথমিক এবং হাইস্কুলে পড়া অবস্থায় কাজী কল্পনা স্কুলের সকল সাংস্কৃতিক এবং বার্ষিক ক্রীড়া অনুষ্ঠানে গান গেয়ে প্রথম হতেন বলে জানান।
এইচএসসিতে পড়া অবস্থায় বাংলাদেশ টেলিভিশনের দেশব্যাপী হামদ-নাত প্রতিযোগিতায় তিনি সারা দেশের প্রথম স্থান অর্জন করেন। এরপর তিনি বাংলাদেশ টেলিভিশন এবং বাংলাদেশ বেতারে শিল্পী হিসেবে এনলিস্টেড হন। এছাড়া তিনি শিল্পকলা, বাংলা একাডেমির যেকোন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে গান গাইতেন।
প্রথম অডিও ক্যাসেট
কাজী কল্পনা জানান, অনেক ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় একটা ক্যাসেট বের করতে পারেননি। তবে এরপর সেলিম চৌধুরীর একটি গানের প্রতিযোগিতা বিজ্ঞাপনে অংশ নিয়ে প্রথম স্থান অর্জন করেন। তারপর তার প্রথম মিশ্র অডিও অ্যালবাম বের হয়। যেটির নাম ছিল ‘হৃদয় জুড়ে আছো তুমি’।
পরে ‘মন আমার’ প্রেমের ভাব’ নামে দুটি একক অ্যালবাম বের করেন কাজী কল্পনা। এছাড়া ‘অন্তরে জ্বালা’ নামে একটি একক মিউজিক ভিডিও বের করেন কাজী কল্পনা। এগুলো দর্শক-শ্রোতাদের কাছে ব্যাপক সমাদৃত হয়। দেশে থাকতে এটিএন বাংলায় ‘ধুম ধারাক্কা’ অনুষ্ঠানে নিয়মিত পারফর্ম করতেন কাজী কল্পনা।
প্রবাসে পাড়ি
বিবাহের সূত্রে কাজী কল্পনা ২০০০ সালে ইতালিতে পাড়ি জমান। তার আগে থেকেই তার স্বামী কাজী লুৎফুর রহমান ইতালির রোমে থাকতেন। বিদেশ বিভূঁইয়ে গেলেও কাজী কল্পনা গানের জগত থেকে পিছু হটেননি। তিনি বলেন, আমি ইতালি যাওয়ার চারদিন পর রোমে বৈশাখি মেলা ছিল। সেখানে আমি গান পরিবেশন করি। এরপর থেকে আমাকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।
প্রবাসেও শিল্পী হয়ে উঠা
ইতালিতে বাঙালি কমিউনিটি এবং দূতাবাসের সব সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে কল্পনা গান পরিবেশন করতেন। এমনকি ইতালির চারটি টেলিভিশন চ্যানেলেও গানের অনুষ্ঠান করতেন বলে জানান কাজী কল্পনা। সেখানে তিনি বাংলা, ইংরেজি, হিন্দি এবং ইতালিয়ান ভাষায় গান করতেন।
পরিবারসহ লন্ডনে পাড়ি
ইতালিতে পরিবারসহ কাজী কল্পনার সময় ভালোই কাটছিল। তার স্বামীও ব্যবসায় মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু দুই ছেলের পড়াশোনার কথা চিন্তা করে তারা ২০১৩ সালে লন্ডনে স্যাটেল্ড হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে দেশটিতে পাড়ি জমান।
লন্ডনেও গানের জগতে কল্পনা
বিশ্বের ১৯টি দেশের ভাষায় গান গাওয়ার এক অসাধারণ রেকর্ড রয়েছে কাজী কল্পনার। বাংলা ছাড়াও তিনি ইংরেজি, হিন্দি, ইতালিয়ান, উর্দু, নেপালি, জাপানি, চাইনিজ, স্প্যানিশ, আরবি, তামিল, কানাডিয়ান, অস্ট্রিয়ান, জার্মান ও মালয়লাম ভাষায় বিভিন্ন দেশে গান গেয়েছেন বিরল প্রতিভার অধিকারী এই গুণী শিল্পী।
প্রবাসী কমিউনটিতে কর্মকাণ্ড
কাজী কল্পনা দেশের শিল্প সংস্কৃতি বিদেশে বেড়ে উঠা নতুন প্রজন্মের বাংলাদেশিদের কাছে ছড়িয়ে দিতে প্রতিষ্ঠা করেছেন হাসন-লালন মিউজিক্যাল একাডেমি। এই প্রতিষ্ঠানটিতে তিনি ছাড়াও আরও কয়েকজন শিল্পী নতুন প্রজন্মের বাংলাদেশিদের নজরুল সংগীত, রবিন্দ্র সংগীত, লালন গীতিসহ বিভিন্ন ধরনের গান শেখান। তিনি প্রতিষ্ঠানটির প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এছাড়া কাজী বল্পনা ঢাকা অ্যাসোসিয়েশন ইউকের কালচারাল সেক্রেটারি, দোহার অ্যাসোসিয়েশন ইউকের সেক্রেটারি, ঢাবি অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন ইন দ্য ইউকে ইসি সদস্য হিসেবে সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয় রয়েছেন। লন্ডনে তিনি শিক্ষকতাও করছেন করছেন।
পারিবারিক জীবন
কাজী কল্পনা বর্তমানে পরিবার নিয়ে লন্ডনের সাউদেন্ড অন সী-তে বসবাস করছেন। তার স্বামী কাজী লুৎফুর রহমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়ন থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর করেছেন। বর্তমানে তিনি লন্ডনে চাকরি ও প্রপার্টিজ বিজনেস করছেন। তাদের বড় ছেলে কাজী প্রত্যয় কিংস্টন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নিউক্লিয়ার ফার্মাসিটিতে স্নাতকে পড়াশোনা করছেন। তাদের ছোট ছেলে কাজী প্রণয় প্রতীক লন্ডনের একটি স্কুলে ও লেভেল শেষ করেছে।
যাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা
দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশেও নিজের গানের পেশা ধরে রাখতে পারায় কাজী কল্পনা তার স্বামী কাজী লতিফুর রহমানকে অশেষ কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন। তিনি বলেন, আমার স্বামী যদি আমাকে আমার গানের পেশায় সহযোগিতা না করতো তাহলে আমি আজকের এই অবস্থানে কখনোই আসতে পারতাম না। তিনি আমাকে আগেও সহযোগিত করে আসছেন, বর্তমানেও করছেন এবং ভবিষ্যতেও করবেন। কাজী লতিফুর রহমান তার অনেকগুলো গান লিখেছেন বলেও কাজী কল্পনা জানান। এছাড়া সংগীত জীবনে এতটুকু পথ আসতে পারার জন্য কাজী কল্পনা তার বাবা-মায়ের প্রতিও কৃতজ্ঞতা জানান। তিনি বলেন, আমার বাবা ছোট থাকতেই আমাকে গানের প্রতি উৎসাহ দিতেন। তিনি আমাকে হারমোনিয়াম কিনে দিয়েছেন। বাসায় গানের শিক্ষক রেখে গান শেখার সুযোগ করে দিয়েছিলেন। বাবা যদি আমাকেও ছোট বেলায় উৎসাহ না দিতেন আমি হয়তো আজ এই পর্যায়ে আসতে পারতাম না।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
শুদ্ধ বাংলা গান এবং শুদ্ধ সুরে প্রবাসে যে সকল বাঙালি আছেন তাদেরকে সেখানোর প্রচেষ্টা সব সময়ই ছিল, আছে এবং সামনের দিনগুলোতেও থাকবে। আমি হয়তো একটা সময় থাকবো না, আমি চাই আমি যদি অল্প কয়েকজন নতুন প্রজন্মের বাচ্চাদেরও শিখিয়ে যেতে পারি আমি মনে করি সেটাই আমার জন্য সার্থক। এরইমধ্যে কিছু শিক্ষার্থী আমার সঙ্গে বিভিন্ন শোতে পারফর্ম শুরু করছে। তাদেরকে দর্শক শ্রোতারা ভালোভাবে গ্রহণও করছে।
এ বিষয়ে তিনি আরও বলেন, বাংলা গান যেন বিলীন না হয়ে যায়, বাংলা গানের যে রুট, পল্লীগীতিসহ যেসব গান রয়েছে সেগুলো যাতে না হারিয়ে যায় সেজন্য সেগুলো নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার জন্য কাজ করে যাচ্ছি। এটাই হচ্ছে আমার মূল উদ্দেশ্য।
প্রবাস মেলাকে নিয়ে যা বললেন
প্রবাসীদের জন্য প্রবাস মেলা ভালো একটা উদ্যোগ। প্রবাস মেলার জন্য অনেক শুভ কামনা থাকলো। পত্রিকাটির উত্তরোত্তর সাফল্য কামনা করছি।
আলাপচারিতায় লেখা তৈরি ও সম্পাদনা করেছেন- মোস্তফা কামাল মিন্টু।