সুপর্ণা বসু দে , কোলকাতা, ভারত থেকে:
কি ভাবলে? বলে রিনির পতিদেব সঞ্জয়
কি? চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বললে রিনি।
দেখ, দেরি না করে এক মাসের মাইনে এক্সট্রা দিয়ে বুনু কে দেশে পাঠিয়ে দাও। ফিসফিসিয়ে বললো সঞ্জয়।
আরেকটা নুতন লোক না পাওয়া পর্যন্ত ওকে ছাড়ি কি করে। তাহলে তো আমাকে স্কুলে থেকে ছুটি নিতে হবে। বলে রিনি নেবে, কি করা যাবে।
এই কয়দিনে বুনু কেমন আপন হয়ে গিয়েছিল! স্কুল থেকে ফেরার সাথে সাথেই চা। মা’কে সময় ধরে ওষুধ খাওয়ানো। বলতে বলতে কেমন আনমনা হয়ে গেল রিনি।
মা’র সেরিব্রাল attack এর পর হন্যে হয়ে যখন সবসময়ের একটা কাজের মেয়ে খুঁজছিল, তখন পাশের ঘরের মাসি, বুনুকে বাগনান থেকে নিয়ে এলো। অভাবী বাড়ির মেয়ে। ক্লাস সিক্স অবধি পড়াশুনা। বাবা দিদিদের বিয়ে দিতে গিয়ে দেনার দায়ে পর্যুদস্ত। তাই ভদ্র বাড়ী তে কাজের জন্য পাঠানো। রুক্ষ, শুষ্ক চুল, একটা কম দামি সালোয়ার কামিজ পরা ছিপছিপে কিশোরী। ঢলঢলে মুখের মধ্যে চোখ দুটো খুব মায়াবী।
প্রথম দর্শনে ই ভালো লেগে যায় রিনির। জিগ্যেস করেছিল- কাজকর্ম করতে পারিস।
বাঁ দিকে মাথা কাত করে উত্তর দিয়েছিল-হ্যাঁ।
নাম কি?
বুনু, সরু রিনরিনে আওয়াজ। স্বরটা ও মধুর।
দু’একদিনের মধ্যেই বুনু বাড়ির সদস্য হয়ে উঠেছিল নিজগুনে। তখন নিজেদের ভাগ্যে নিজেরাই বিস্মিত।
আর আজ! কত তাড়াতাড়ি ওকে ভাগানো যায়, তার চিন্তা।
সত্য সেলুকাস কি বিচিত্র এ দেশ। দোষ করে একজন। শাস্তি পায় আরেক জন।
রিনি বলে- জানো বুনু কেমন চুপ হয়ে গেছে। দিনে পাঁচ ছয় বার চান করছে। মাঝে মধ্যে কাঁদে, আমার এত খারাপ লাগে, কি বলবো।
দেখো, ওর সঙ্গে সমবেদনা দেখাতে গিয়ে বিপদে পড়া কি বুদ্ধিমানের কাজ হবে? একটু রেগেমেগেই বলে উঠলো সঞ্জয়। বাস্তব টা মানতে হবে। তারপর ও আবার দত্ত দা’র ছেলে র নাম করেছে।
সেতো ঠিক। কিন্তু কি দোষ মেয়েটার?
আচ্ছা, আজকাল ছেলেগুলো র মধ্যে কোনো সদগুণই তৈরী হয়নি।
এই যে পরীক্ষায় এত নম্বর পায় ,সেটা শুধুই পুঁথিগত। চরিত্র বলে কি কিছুই নেই। রাগে বলে ওঠে রিনি সেদিন আরো বড় কিছু অঘটন হয়ে যেতে পারত। সেদিন কারেন্টটা তাড়াতাড়ি এসেছিল বোধহয় ওকে বাঁচানোর জন্যই। জানো, ঈশ্বর ওকে রক্ষা করেছেন।
শুধু ওকে কেন? আমাদের কেও রক্ষা করেছেন।
থানা, পুলিশ, কোর্ট, কাছারি না জানি কি কি? অর্থহানি, মানহানি এসব তো আছেই। একটা আত্মতৃপ্তির সুরে কথাগুলো বললো সঞ্জয়।
রিনি অবাক হয়ে চেয়ে রইল সঞ্জয়ের দিকে। একবারও মেয়েটার জন্য দুঃখ প্রকাশ নেই। আছে খালি বিপদমুক্তির আনন্দ। একেই কি পুরুষ মানুষ বলে! কি নির্মম। কতগুলো শিক্ষিত ছেলের অসভ্য আচরণ মেনে নিতে হচ্ছে। কিন্তু কেন?
উত্তর জানা নেই রিনির, নেই বুনুর।
মগে মগে জল ঢেলে ও শরীরটা জুড়েছে না বুনুর। শরীরের ঘিনঘিনে ব্যাপারটা যাচ্ছেই না। মনে হচ্ছে কতগুলো কালো কালো কেঁচোর মতন তৈলাক্ত পোকা গায়ের মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে। দুহাতে কতবার, কতভাবে বাধা দেবার চেষ্টা করেছিল ছেলেগুলোর হাত কে।
কিন্তু বুনুর আর কত শক্তি?
একজন তো মুখটাকে এমন ভাবে চেপে ধরেছিল, চিৎকার তো দূরে থাক, নিশ্বাস নেয়াই শক্ত হয়ে উঠছিল। মনে হচ্ছিল, কোনো ডোবা পুকুরে ডুবে যাচ্ছে। জলের নিচের ঘন শ্যাওলা, ঝাঁঝি গুলো ওকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে নিচের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। চারিদিকে শুধু কালো অন্ধকার। তখনই হঠাৎ সূর্য্য উঠলো। তার আলোয় কালো নোংরা হাতগুলো ছোট হয়ে গেল। ভয় পেয়ে ছেলেগুলো ওকে ছাদে ফেলে ধুপধাপ করে পালিয়ে গেল।
অনেকক্ষণ চেতন অবচেতন এর মধ্যে পড়ে রইল বাগনানের বুনু। ভদ্র শিক্ষিত যুবসমাজ এর শিকার পড়ে রইল ।
ছাদের কঠোর মেঝেতে অবহেলায়।
সেদিন সঞ্জয়ের তেলেভাজা খাবার ইচ্ছে হয়েছিল।
তাই বুনু গিয়েছিল কোয়ার্টার এর সামনের তেলেভাজার দোকানে। দোকানে ভিড় ছিল না, তাই বেশিক্ষণ দাঁড়াতে হয়নি।
চপের ঠোঙা নিয়ে ফ্ল্যাট এর দিকে পা বাড়ানোর সময় ঝুপ করে সব অন্ধকার। লোডশেডিং। একটুক্ষণ চোখ বুজে, তারপর চেয়ে দেখলে-
এইতো বেশ দেখা যাচ্ছে।
আঁধারের আলো।
কিন্তু বুনু খেয়াল ই করেনি যে কতগুলো কালো ছায়া ।
ওর ছায়ার সঙ্গে মিশে পা টিপে টিপে অনুসরণ করছিল ওকে।
তিনতলায় বৌদির ঘরের কলিংবেল টা বাজাতে যাবে, ঠিক তার একমুহূর্ত আগেই কে যেন ওর মুখ টা চেপে ধরলো ।
আর কিছু বোঝার আগেই কতগুলো পুরুষ্ট হাত ওকে একটা শিশুর মতো পাঁজাকোলা করে ছাদে নিয়ে এলো।
আঁধারের আলোয় দেখলো। কতগুলো মানুষের ঘিনঘিনে পোকায় রূপান্তর। আর চিটচিটে নোংরা হাতগুলো যখন শরীরের আনাচে কানাচে অবাধে ঘুরছিলো । ঠিক তখন ই কারেন্ট এসে গেলো।
সব ফ্ল্যাট, লাইটপোস্ট এর আলোয় অন্ধকার ছাদ টা আর অত অন্ধকার লাগছিলো না। সবকিছুই স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল, কিন্তু রুমাল বাঁধা মুখগুলো চেনা যাচ্ছিল না।
একজন বলে উঠলো- যা, কারেন্ট এসে গেছে, পালা।
সবাই ধুপধাপ করে দৌড়ে নেমে গেল। কিন্তু গলার স্বর টা খুব চেনা চেনা লাগলো বুনুর। নিচের ফ্ল্যাট এর দত্ত বৌদির বড় ছেলে, রানাদা না? কেমন করে যেন বুনুকে দেখে।
বোধহয় আধঘণ্টা বা তারও পরে বুনু যখন ছাদে উঠে বসল, তখন দুচোখে জলের ধারা বাঁধ মানছিল না।
অনেক কষ্টে তিনতলায় বেল মারতেই বৌদি বলে- কি রে? দোকানে খুব ভিড় ছিল বুঝি? তারপর খালি হাতের দিকে তাকিয়ে বলে- কিরে চপ কোথায়? কী হয়েছে তোর!
না আর কিছুই বলার প্রয়োজন হয়নি রিনির। বুনু হাউ হাউ করে বৌদিকে জড়িয়ে কাঁদতে শুরু করে ছিল।
ঘটনা শুনে সবাই ‘থ’।
একি হচ্ছে? এরা কারা?
এখন কি করা উচিত?
কাউকে চিনতে পেরেছিস, নাকি?
একটু গরম দুধ খাবি? এমন সব প্রশ্ন ফ্ল্যাটের বন্ধ দরজায় মাথা খুঁড়ে মরল কিন্তু কেউ বাইরে আসতে পারলো না।
সঞ্জয় গম্ভীর হয়ে বললে- একথা যেন পাঁচকান না হয়। তাহলে বিপদ বাড়বে বৈ কমবে না। মেয়েটার বদনাম ছাড়া আর কিচ্ছু হবে না।
সবার ও তাই মনে হল। পাপীর শাস্তি নয়। পাপ লুকানোর মধ্যে বুদ্ধিমত্তার পরিচয়।
তারপর আবার সুর্য উঠলো। আলো ফুটলো। অন্ধকার নামলো। খালি মাঝখান থেকে বুনুর মনের মধ্যে অন্ধকারের ভয় আরও জমাট বাঁধলো। হাসি মলিন হলো। চার পাঁচ বার চান করার বাতিক হোল।
একদিন সকালে বুনুর মাসি এসে বুনুকে বাগনান এ ফিরিয়ে নিয়ে গেল। যাবার সময় ছলছল চোখে বুনু রিনি কে প্রণাম করে জিগ্যেস করেছিল- মামী, আমার কি দোষ? রিনি মাথায় হাত দিয়ে বলেছিল- ঈশ্বর, তোর মঙ্গল করুন।
সন্ধ্যায় রিনি চায়ের কাপ এগিয়ে দিয়ে সঞ্জয়কে বললো- আচ্ছা, বুকে হাত দিয়ে বলত, যদি বুনু আমাদের মেয়ে বা বোন হতো, তাহলে কি আমরা এত তাড়াতাড়ি সব ভুলে যেতে পারতাম??
আজ প্রথম সঞ্জয়কে অপরাধী অপরাধী লাগলো। রিনি ও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। যাক মানুষটা পুরোপুরি অমানুষ হয়ে যায়নি।
একটা অক্ষম, অসমর্থ মেয়ে হবার জন্য রিনির মনে দুঃখটা রয়েই গেল।