এবিএম সালেহ উদ্দীন, নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র
নিউইয়র্ক বইমেলায় (২০১৮) বাংলাদেশ থেকে বেশ কয়েকটি প্রকাশনা সংস্থা যোগ দিয়েছিল। তাদের মধ্যে আমার কয়েকজন বন্ধু প্রকাশকও ছিলেন। নব্বই এর দশকের গোড়া থেকে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ ও তৎসংলগ্ন সুবিস্তৃত এলাকায় মাসব্যাপী অমর একুশে বইমেলার যে সম্প্রসারণ ঘটেছিল। বলা যায়, তখন থেকেই সৃজনশীল প্রকাশনা শিল্পের জাগরণ ঘটে। মনে আছে সাহিত্য প্রকাশ ও মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘরের প্রতিষ্ঠাতা মফিদুল হককে প্রেসিডেন্ট আর ইউপিএল এর মহিউদ্দীন আহমদকে ভাইস প্রেসিডেন্ট করে বাংলাদেশ সৃজনশীল প্রকাশনা পরিষদ গঠন করা হয়েছিল। যার উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশের সৃজনশীল প্রকাশনার উন্নয়ন ও দেশে-বিদেশে তার সম্প্রসারণ। ভারত থেকে আমদানিকৃত অবৈধ পাইরেসি বইয়ের প্রতিরোধসহ বেশ কিছু নীতিমালা গ্রহণ করা হয়েছিল। যার মধ্য দিয়ে জাতীয় গ্রন্থনীতির উৎকর্ষ সাধন ও বাংলাদেশের প্রকাশনা শিল্পের উন্নয়নের পথ প্রশস্ত হবে। সেই সময় ঢাকা ও আমরা বাংলাবাজারের বেশিরভাগ প্রকাশকই সংগঠনটির সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলাম। সৃজনশীল প্রকাশনা জগতের কিংবদন্তী প্রকাশক মুক্তধারা ও পুথিঘরের প্রতিষ্ঠাতা বাবু চিত্তরঞ্জন সাহাও আমাদের সেই সংগঠনের সংগে যুক্ত হয়েছিলেন।

শুনলাম, বর্তমানে সৃজনশীল প্রকাশনা পরিষদের নাম পরিবর্তিত হয়েছে। নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন নামের সংগঠনটির একটি কমিটিও হয়েছে। যার বর্তমান প্রেসিডেন্ট ‘সময়’ প্রকাশনের ফরিদ আহমেদ আর সেক্রেটারি ‘অনন্যা’র মনিরুল হক।
নিউইয়র্ক বইমেলার শুরুর আগের দিন টিভিতে আমার পরিচালনাধীন ‘স্মরণীয় বরণীয়’ অনুষ্ঠানে তারা অতিথি হয়ে কথা বলেছিলেন।
বিষয় ছিল-‘কিংবদন্তী প্রকাশক চিত্তরঞ্জন সাহা’।
চিত্ত’দার সংগে আমার পরিচয় ও স্মৃতি অনেক দিনের। বলা যায় সেই তরুণ বয়স থেকে। হৃদয়ের একান্ত তাগিদেই তাঁর জীবনালোকের অনুষ্ঠানে কিছুটা আলোকপাত করানোই ছিল মূল উদ্দেশ্য। আর এই অনুষ্ঠানটির থিম হচ্ছে যাঁরা পৃথিবীতে নেই, তাঁদের অবদান নিয়ে আলোচনা করা। চিত্ত’দাও তেমনই একজন মহৎ মানুষ ছিলেন। আমাদের সৃজনশীল প্রকাশনার উন্নয়ন ও জাগরণে তাঁর অবদান অনেক। যিনি কর্মে, কৃতিতে ও স্মৃতিতে অমর। তিনি স্মরণীয়, তিনি বরণীয়।
ঢাকায় আমার প্রকাশনা ব্যবসায় আসার নেপথ্যে চিত্ত’দার একটা প্রচ্ছন্ন ভূমিকা ছিল। সেটি অন্য লেখায় উল্লেখ করেছি। তারও আগে থেকে এলিফ্যান্ট রোডে প্রেস, প্যারীদাস রোডে ছিল বাড পাবলিকেশন্স।

এছাড়া মতিঝিলে পত্রিকা অফিস এবং বাংলাবাজারে ছিল কম্পিউটার ব্যবসা। আমার কলেজ জীবনের পূর্ব থেকেই প্যারীদাস রোডস্থ মুক্তধারায় যেতাম। চিত্ত’দার সংগে দেখা হতো। অনেক কথা ও গল্প হতো। বুদ্ধি ও পরামর্শ দিতেন।
বাবু চিত্তরঞ্জন সাহাকে নিয়ে অতলে জমে থাকা আমার সেসব স্মৃতিকে আড়াল করে দুই বন্ধু প্রকাশকের মাধ্যমে চিত্ত’দা সম্পর্কে কিছুটা আলোচনা করিয়ে তাঁর পরমাত্মার শান্তি কামনা করতে পারলাম। নিজের কথার চেয়েও ওদের মাধ্যমে চিত্ত’দার জীবনালোক বিষয়ে দর্শক-শ্রোতাদের জানাতে পেরে নিজেকে খানিকটা হালকা হওয়ার চেষ্টা করলাম মাত্র।
আমেরিকায় গ্রীষ্মের রোদেলা দুপুর।
স্যুটিং শেষে ফরিদ ভাইকে লেখক আবু রায়হানের বাসায় ড্রোপ দিলাম। মনির ভাইকে নিয়ে গেলাম লং আইল্যান্ড সিটি’র একটি বহুতলা বিশিষ্ট হোটেলে। তিনি জানালেন লং আইল্যান্ড সিটির টাউন হোম হোটেলে ঢাকার একজন প্রকাশক আছেন। তিনি তার সংগে দেখা করতে চান। বললাম, নো প্রবলেম ! পৌঁছিয়ে দিব। যথারীতি তাকে নামিয়ে দিয়ে আমি গাড়ি পার্ক করে হোটেলের লিপ্ট (এলিভেটর) দিয়ে নির্ধারিত কক্ষের সামনে গিয়ে কলিংবেল প্রেস করতেই একজন সুদর্শন দরজা খুলে দিলেন। ঢুকতেই ভদ্রলোক এক নিরিখে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। পরক্ষণেই বললেন আপনি কি সালেহ ভাই? বললাম জ্বি হ্যাঁ! তিনি বললেন, আমি জসিম। এই বলেই তিনি কদমবুচি করবার জন্য উদ্যত হলেন। আমি বললাম এ কি! আপনি এসব কি করছেন? আমি তাকে থামিয়ে দিলাম।
জসিম এবার বলতে শুরু করলেন- “আমি তখনো প্রকাশনা ব্যবসায় একেবারেই নবীন। সেই সময়কার দুর্দিনে আপনার প্রতিষ্ঠান থেকে আমাকে অনেক কাজ বাকিতে করার সুযোগ করে দিয়েছিলেন। আমাকে খুব ভালোভাবে না জেনেই আমাকে বিশ্বাস করে আপনার ম্যানেজারকে বলেছিলেন বিল ছাড়াই যেনো আমার কাজগুলো করে দেয়া হয়। কখনও বিলের জন্য যেন কোন কাজ আটকে না রাখা হয়। তাই হয়েছিল। যেখানে তাজ কোম্পানী, কাকলী, আগামী, প্রতীক, পূর্বাচলসহ বড় বড় প্রকাশনার কম্পিউটার কাজ আপনার প্রতিষ্ঠান থেকে কাজ করিয়ে নিয়মমাফিক বিল পরিশোধ করতো। সেখানে আমাকে আস্তে আস্তে বিল পরিশোধ করার সুযোগ করে দিয়েছিলেন। বর্তমানে আপনার দুয়ায় আজ আমি অনেক দূর এগিয়েছি।”
তিনি আরও বললেন- ‘আপনি দেশে থাকলে অনেক কিছু করতে পারতেন।
প্রফেসর গাইড নামে প্রথমে নোট ও গাইড বইয়ের ব্যবসা করতেন জসিম। বর্তমানে সৃজনশীল প্রকাশনা ব্যবসা চালু করেছেন। বেশ উন্নতিও করছেন বলে তিনি জানালেন।
নব্বইয়ের শেষ দিকে আমি নিউইয়র্ক চলে আসি। এরই মধ্যে জীবন থেকে ঝরে গেল বিশটি বছর। বাংলাদেশে প্রকাশনা শিল্পের জাগরণ ও অনেক উন্নতি ঘটেছে। আমার সময়কালের বেশ ক’জন বন্ধু ঢাকায় তাদের প্রকাশনা ব্যবসায় প্রভূত উন্নয়ন করেছেন। পাশাপাশি অন্য ব্যবসায়ও উন্নতি করেছেন।
হ্যাঁ, তারা অনেক কিছু করতে পেরেছেন। আমি পারিনি।
কিন্তু স্মৃতিতো এখনও সম্বল হয়ে আছে। সত্যিই স্মৃতি কারো আজ্ঞাবহ নয়। চাইলেই তাকে বাদ দেয়া যায় না। জীবন থলিতে সেসব স্মৃতিকে ধারণ ও বহন করে এখনও বেঁচে আছি।

বলছিলাম প্রফেসর গাইড এর প্রকাশক জসিম সাহেবের কথা। তার নোট বই ও গাইড ব্যবসা আছে কিনা জানি না। তবে সৃজনশীল প্রকাশনা ব্যবসায় যুক্ত হয়েছেন জানতাম না। বর্তমানে তিনি সৃজনশীল প্রকাশনা সংস্থা’ কথা প্রকাশ’এর র্কুধার। পরে জানলাম তিনি নিউইয়র্ক মুক্তধারা’র মালিক বিশ্বজিৎ সাহা’র আমন্ত্রণে বইমেলায় এসেছেন। আরও জানা গেল চিত্তরঞ্জন সাহা পুরস্কার বিষয়ক অর্থায়নে তার একটা ভূমিকাও আছে। শুনে প্রীত হ’লাম।
মি: জসিমের নিকট থেকে পুস্তক ব্যবসায় তার উন্নতির কথা শুনে আমার মনে বয়ে গেল খুশির ঝলক। হৃদয়টা আনন্দে ভরে গেল।
মানুষের জীবনের একটি প্রধান সম্বল হচ্ছে স্মৃতি। স্মৃতিকে সর্বদা সংগে নিয়েই মানুষ চলতে পছন্দ করে। স্মৃতি ক্রমাগত তাড়া করে বলেই হয়ত: মাঝে মাঝে মানুষকে অতীতের কথা স্মরণ করতে হয়। আমিও তার ব্যতিক্রম নই।
জসিম আমাকে আপ্যায়ণ করানোর চেষ্টা করলেন। বললাম ধন্যবাদ। এখন নয় অন্য কোন সময় হবে।
অত:পর যথারীতি হোটেল থেকে বেরিয়ে পরলাম। দুপুর গড়িয়ে অপরাহ্নের সূর্যটা হেলে পড়েছে। কিন্তু গরমের তীব্রতা কমেনি। মাথার উপর মেঘহীন নীলাকাশ। গাড়ি স্টার্ট দিয়ে এসি ছেড়ে দিলাম। তারই সাথে মিউজিক বেজে উঠলো মিউজিক..
অনুরাধা পাডোয়ালের সুরে:-
“মরুভূমি হয়ে গেছে মনটা
কাঁটা হয়ে গেছে সব কুলে
এত জল ছড়ে গেছে তাইতো
দু’চোখে বুঝি আজ জল নেই…