রুমান দীপা একজন প্রতিশ্রুতিশীল মিডিয়াকর্মী। মুন্সিগঞ্জ জেলার এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে তার জন্ম। পিতা হাবিবুর রহমান এবং মাতা সাজেদা রহমানের পাঁচ মেয়ে এক ছেলের মধ্যে রুমানা দীপা চতুর্থ সন্তান। বাবা মায়ের অনুপ্রেরণা নিয়ে ইংরেজি সাহিত্যে পড়াশোনা করেন। ক্যারিয়ারের শুরুতেই একজন মিডিয়াকর্মী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। সুন্দর বাচনভঙ্গি এবং কর্তব্যনিষ্ঠায় তিনি হয়ে উঠেন একজন সফল প্রোগ্রাম ব্যবস্থাপক ও অনুষ্ঠান নির্মাতা। মাঝখানে পড়াশোনার উদ্দেশ্যে কিছুদিন আমেরিকায় ছিলেন। বর্তমানে নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি’র কো-অর্ডিন্যাশন অফিসার হিসেবে কর্মরত আছেন। তবুও থেমে নেই তার মিডিয়া ভাবনা। একদিন সন্ধ্যায় পাক্ষিক প্রবাস মেলা কার্যালয়ে আসলে প্রবাস মেলা পরিবারের সাথে আলাপচারিতায় উঠে আসে তার মিডিয়া জীবনের কথা, সর্বোপরি তার জীবনের কথা। সেসবের অংশ বিশেষ এখানে তুলে ধরা হলো-
প্রবাস মেলা: আপনার জন্ম, বেড়ে উঠা ও শিক্ষা জীবন সম্পর্কে বলুন?
রুমানা দীপা: আমার জন্ম মুন্সিগঞ্জ শহরে। ঢাকার খুব কাছে হলেও এটা একটা মফস্বল শহর। সেখানেই কেটেছে আমার শৈশব, কৈশোর। স্কুল কলেজের পড়াশোনাও সেখানেই। আমি আলবার্ট ভিক্টোরিয়া জোতিন্দ্রমোহন গার্লস হাইস্কুল থেকে এসএসসি পাশ করি। তার পর মুন্সিগঞ্জ হরগঙ্গা কলেজ থেকে এইচএসসি শেষ করে ইডেন কলেজে অনার্সে ভর্তি হই। আমার সাবজেক্ট ছিল ইংরেজি। ইডেন কলেজ থেকে আমি ইংরেজি সাহিত্যে অনার্সসহ মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করি ।
প্রসাব মেলা: মিডিয়াতে কিভাবে এলেন?
রুমানা দীপা: আসলে মিডিয়াতে হুট করেই আমার আসা। এখানে ক্যারিয়ার শুরু করবো এমনটা কখনো ভাবিনি। আমি যখন অনার্সের ফাইনাল পরীক্ষা দিই তখন খবর পেলাম চ্যানেল ওয়ানে প্রোগ্রাম বিভাগে লোক নেবে। আমি এপ্লাই করলাম। কর্তৃপক্ষ আমাকে নিয়োগ দিলেন। ব্যস এভাবে মিডিয়ায় চলে এলাম। এটা ২০০৭ সালের ঘটনা।
প্রবাস মেলা: ইংরেজি সাহিত্যে পড়াশোনা করে মিডিয়াতে ক্যারিয়ার শুরু করলেন এতে আপনার কোন আক্ষেপ ছিলনা?
রুমানা দীপা: না, আমার কোন আক্ষেপ ছিলনা। কারণ, আমি মনে করি যারা মেডিকেল বা ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়াশোনা করে তারা আগে থেকেই জেনে যায় তাদের ক্যারিয়ারের ক্ষেত্র কি হবে। কিন্তু যারা জেনারেল সাবজেক্ট নিয়ে পড়াশোনা করে তাদের ক্ষেত্রে বিষয়টি ভিন্ন। তাদের ক্ষেত্রে ক্যারিয়ার গড়ার ভিন্ন ভিন্ন ক্ষেত্র উন্মুক্ত থাকে। আমার ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে। ছাত্রজীবনে আমি কখনো ক্যারিয়ার নিয়ে ভাবিনি। ভবিষ্যতে এই হবো, সেই হবো এমনটা ভাববার সুযোগ হয়নি। কারণ আমার বাবা বলতেন- ক্যারিয়ার নিয়ে কখনো ভাববেনা। আগে ভালো করে শিক্ষাজীবন শেষ করো- দেখবে ক্যারিয়ারের হাজারটা দরজা খুলে গেছে। যেদিকে যেতে চাও, যেতে পারবে। বলতে পারেন বাবার কথার উপর ভরসা করে নির্ভাবনায় আনন্দের সাথে পড়াশোনা করেছি। তাই কর্মজীবনের শুরুতেই মিডিয়াকেই বেছে নিয়েছি বলে আমার কোন আক্ষেপ নেই।
প্রবাস মেলা: একজন নারী হিসেবে মিডিয়ায় কাজ করার ক্ষেত্রে আপনি কোন বাধা অনুভব করেন কিনা?
রুমানা দীপা: দেখুন আমাদের সমাজটা এখনো অনেক ক্ষেত্রে পুরুষশাসিত হলেও নারীরাও কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করছে, স্বাধীনভাবে ক্যারিয়ার গড়ছে। তারা কলেজ, বিশ^বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা, ব্যাংক, বীমা, সশস্ত্রবাহিনী, পুলিশ, প্রশাসনসহ সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সেক্টরে অত্যন্ত সম্মানের সহিত চাকরি করছেন এবং মিডিয়াতেও নারীদের অংশগ্রহণ দিন দিন বাড়ছে। প্রতিযোগিতা করেই নারীরা সকল কর্মক্ষেত্রে তাদের অংশগ্রহণ বাড়াচ্ছে। এক্ষেত্রে বাধার কিছু নেই, তবে প্রতিযোগিতা আছে। আমি মনে করি যেকোন কাজে প্রতিযোগিতা নারী-পুরুষ নির্বিশেষে বিচার্য হওয়া উচিত। অর্থাৎ ক্যারিয়ার গড়ার প্রশ্নে নারীদের শুধু নয় পুরুষদেরকেও প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হতে হয়। মিডিয়ার ক্ষেত্রেও বিষয়টি সমান গুরুত্বপূর্ণ। তাই আমি মনে করি নারী হিসেবে মিডিয়াতে কাজ করতে তেমন বাধা অনুভব করি না বরং আনন্দ পাই। যেমন চ্যানেল ওয়ানে আমি যখন একদম নতুন, আমার সহকর্মীদের সহযোগিতামূলক মনোভাবের কারণে আমি বেশ স্বাচ্ছন্দে কাজ করতে পেরেছি। তাদের সহযোগিতা না পেলে প্রোগ্রাম ম্যানেজারের মতো একটি দায়িত্বশীল পদে আমি কাজ করতে পারতাম না। উল্লেখ্য তখন মিডিয়ার নতুন মানুষ হয়েও আমি বায়োস্কোপ নামে একটি জনপ্রিয় প্রোগ্রাম নির্মাণ করেছি। ঐ প্রোগ্রামটির বিশেষত্ব হলো, বিশে^র আলোচিত মুভিগুলোর উপর পর্যালোচনামূলক তথ্য উপাত্ত তুলে ধরা যাতে দর্শক ঐ মুভিগুলো সম্পর্কে সম্যক ধারণা পেতে পারে। আবার এশিয়ান টিভিতে আমি এডিশনাল হেড অব প্রোগ্রাম পদে নিয়োজিত থেকে অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করেছি।
প্রবাস মেলা: On Screen -এ আসার ইচ্ছা জাগেনি কখনো?
রুমানা দীপা: ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় এসে শুরু থেকেই আমি প্রোগ্রাম বিভাগে কাজ করতে বেশি স্বাচ্ছন্দবোধ করি। কারণ এ বিভাগে সৃজনশীলতার পাশাপাশি ব্যবস্থাপনাগত বিভিন্ন কৌশল আয়ত্ব করার সুযোগ হয়েছে। সে কারণে On Screen – এ আসা আর হয়ে উঠেনি। তবুও কখনো কখনো On Screen – এ এসেছি, তবে তা নিতান্ত প্রয়োজনে।
প্রবাস মেলা: নতুন যারা মিডিয়ায় আসতে চায় তাদেরকে কি পরামর্শ দিবেন?
রুমানা দীপা: মিডিয়ার যেকোন পেশা- যেমন ধরুন অভিনয়, উপস্থাপনা, অনুষ্ঠান বা নাটক নির্মাণ ইত্যাদি পেশায় যারা আসতে চায় তাদেরকে বলবো, আপনাদের প্রচুর ধৈর্য্য, পরিশ্রম একাগ্রতা এবং লেগে থাকার মানসিকতা থাকতে হবে। তাহলে সাফল্য আসবেই।
প্রবাস মেলা: আমরা শুনেছি আপনি কিছুদিন আমেরিকায় প্রবাসী ছিলেন। প্রবাস জীবন আপনার কাছে কেমন লেগেছে?
রুমানা দীপা: হ্যাঁ, আমি ক্যারিয়ারের ডেভলপমেন্টের জন্য ২০১৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র যাই। সেখানে প্রথমে আমি মিয়ামীর Kaplun University – থেকে ইংরেজি ভাষার উপর একটি স্বল্পকালীন কোর্স সম্পন্ন করি। তারপর ফ্লোরিডা’র State University -এর অধীনে Palmbridges State College – এ বিবিএ ভর্তি হই। এভাবে ২ বছর আমার প্রবাস জীবন অতিবাহিত করি। কিন্তু স্বল্পকালীন এই প্রবাস জীবনে একটা বিষয় আমাকে খুব নাড়া দিয়েছে আর তা হলো, দেশপ্রেম। দেশের প্রতি আমার যে গভীর একটা টান আছে সেটা আমি আমেরিকায় বসে খুব টের পেয়েছি। দেশের কথা, দেশের মানুষের কথা, পরিবার-পরিজনদের কথা এমনকি দেশের দুর্বাঘাসের কথাও আমার মনে পড়েছে। এ থেকে আমি বুঝতে পেরেছি প্রবাস জীবন খুবই কষ্টের জীবন। জীবন জীবিকার প্রয়োজনে আমার দেশের বহু মানুষ প্রবাসে থাকেন। এই প্রবাসী বাংলাদেশিরা আমাদের অনেক বড় সম্পদ। তাদের পাঠানো রেমিটেন্সের বদৌলতে তাদের পরিবার যেমন উপকৃত হচ্ছে পাশাপাশি আমাদের দেশের অর্থনীতিও সমৃদ্ধ হচ্ছে। তাই প্রবাসীদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয়ে সরকারের কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। আর প্রবাসীদের বলবো- আপনারা যারা বিদেশে আছেন মনে করবেন আপনারা একেকজন বাংলাদেশের ব্র্যান্ড এম্বাসেডর। বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশের সুনাম যেন বৃদ্ধি পায় আপনাদেরকে সেভাবে কাজ করার আহ্বান জানাচ্ছি। আর একটা জিনিস আমি বলতে চাই প্রবাসীদের সুখ-দুঃখ তুল ধরার জন্য বাংলাদেশ থেকে প্রবাস মেলা নামে একটি পত্রিকা নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে। আমি প্রবাস মেলা পরিবারের সবাইকে আন্তরিক সাধুবাদ জানাই এ ধরনের একটি মহৎ কাজ করার জন্য।
প্রবাস মেলা: আপনার অবসর কাটে কিভাবে?
রুমানা দীপা: প্রকৃতপক্ষে মানুষের কোন অবসর নেই বলে আমি মনে করি। আমাদের এ পৃথিবী-মহাবিশ্ব সবই গতিশীল- সবই চলছে। কোথাও থামার কোন উপলক্ষ্য নেই। সেহেতু আমাদের জীবন এক চলমান প্রক্রিয়া। জীবন চলার পথে পেশাগত কাজের ফাঁকে আমরা যা করি সেটাকে যদি অবসর হিসাবে ধরি তাহলে বলবো- সেসময় আমি বই পড়ি, গান শুনি আবার কখনো মুভি দেখি। এগুলো করে আমি আনন্দ পাই- আরো বেশি বেশি কাজ করার অনুপ্রেরণা লাভ করি।
প্রবাস মেলা: কার কার বই পড়ে বেশি আনন্দ পেয়েছেন?
রুমানা দীপা: অনেকের বই পড়ে অনাবিল আনন্দ পেয়েছি। যেমন ধরুন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাঁর কবিতা, গান জীবনে অপার অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে। মাদার তেরেসার জীবন ও কর্ম কোনভাবেই ভুলবার নয়। আবার বাংলার বুকে যদি কোন মাকে বার বার মনে পড়ে- তিনি হলেন শহীদ জননী জাহানারা ইমাম। তার লেখাও আমাকে জীবন চলার পথে নতুন দিশা দেখিয়েছে। তাঁর কাছ থেকেই শিখেছি- জীবন মানে অবিরাম চলা- থেমে গেলে চলবেনা। এভাবে দেশি-বিদেশি আরো অনেক লেখকের লেখা পড়ে তাদের কাছে ঋণী হয়ে গেছি কারণ তাদের কথা ধার করেই তো চলছে আমাদের জীবনচাকা। এ মুহূর্তে ইংরেজ কবি Robert Frost – এর একটি কবিতার কথা মনে পড়ছে-
The woods are lovely, dark and deep
But I have promises to keep
And miles to go before I sleep
And miles to go before I sleep
প্রবাস মেলা: আপনাকে ধন্যবাদ।
রুমানা দীপা: প্রবাস মে
লাকেও অনেক ধন্যবাদ।