ইসরাত জেবিন
রান্না তার ধ্যান-জ্ঞান। তাই ‘রান্না’ই তার পরিচয়। জন্মসূত্রে ব্রিটিশ হলেও মনটা তার এখনও বাংলাদেশি। বলছিলাম নাদিয়া হোসেনের কথা। ২০১৫ সালে বিবিসিতে প্রচারিত The Great British Bake Off এর ষষ্ঠ সিরিজে বিজয়ী হিসেবে সবার মাঝে পরিচিতি পাওয়া নাদিয়া একজন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিক। প্রবাস মেলা’র এবারের প্রচ্ছদে এই ব্রিটিশ বাংলাদেশিকে নিয়ে আমাদের আয়োজন।
নাদিয়া জমির হোসেন একাধারে একজন রন্ধনশিল্পী, উপস্থাপক এবং লেখক। তবে তার সবকিছু ‘রান্না’ ঘিরেই। ২০১৫ সালে Bake OFF এ বিজয়ী হওয়ার পর বিবিসি তে The Chronicles of Nadi‘a নামে একটি ডকুমেন্টারী শুরু করেন। রান্নার প্রতি নাদিয়ার ভালোবাসার গল্পই ছিল এই ডকুমেন্টারীর মূল বিষয়। এছাড়াও TV cookery series- Nadi‘a’s British Food Adventure এবং Nadi‘a’s Family Favourites নামে দুটো রান্নার অনুষ্ঠানের উপস্থাপক ছিলেন তিনি। এর বাইরে The Big Family Cooking Showdown এর সহকারী উপস্থাপক এর দায়িত্ব পালন করার পাশাপাশি The One Shwo এর Contributor হিসেবেও কাজ করেছেন তিনি।
এছাড়া The Times Magayine, The Sun, The Guardian, The Telegraph সহ বেশ কিছু প্রথমসারির পত্রিকা এবং ম্যাগাজিনে নাদিয়ার রান্না বিষয়ক কলাম এবং রেসিপি প্রকাশিত হয়। তিনি যুক্তরাজ্যের সবচেয়ে বড় ফুড মিডিয়া ব্র্যান্ড BBC’s Good Food এর Contributing Editor। এছাড়া রান্না বিষয়ক বেশ কিছু বই লিখেছেন নাদিয়া যার কিছু প্রকাশিত হয়েছে, কিছু প্রকাশিত হবে কিছু দিনের মধ্যেই। ২০১৬ সালে মাইকেল জোসেফ এর প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয় নাদিয়ার প্রথম বই Nadi‘a’s Kitchen। নাদিয়ার একান্ত নিজস্ব কিছু রেসিপি নিয়ে সাজানো হয় বইটি। ২০১৭ সালে একই প্রকাশনী থেকে বের হয় Nadi‘a’s British Food Adventure নামে আরও একটি বই। বাচ্চাদের জন্য লেখা তার বই Bake Me A Story বইটি প্রকাশ করে Hodder Children’s Books। বাচ্চাদের প্রিয় রুপকথার গল্প আর সহজ সহজ রেসিপির মিলন হচ্ছে Bake Me A Story। এই বইটির জন্য British Book Awards এ Childrens Book of the Year পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছিলেন নাদিয়া।
নিজের যোগ্যতায় ২০১৭ সালে নাদিয়া যুক্তরাজ্যের ক্ষমতাসীন ৫০০ জনের মাঝে নিজের জায়গা করে নেয়ার পাশাপাশি বিবিসির করা ১০০ জন নারীর তালিকাতেও নিজের স্থান করে নিয়েছিলেন।
নাদিয়ার জন্ম ১৯৮৪ সালের ২৫ ডিসেম্বর লুটন শহরে। বাবা জমির আলী ব্রিটেনে আসেন ১৯৭০ সালে। তারপর সেখানেই স্থায়ী হন। জমির ও আসমা দম্পতির চার মেয়ে, দুই ছেলের মধ্যে নাদিয়া তৃতীয়। যুক্তরাজ্যে জন্ম এবং বড় হলেও বাংলাদেশের সাথে একটা সম্পর্ক বরাবরই ছিল। নাদিয়ার পৈতৃক বাড়ি সিলেটের বিয়ানীবাজারের মোহাম্মদপুর গ্রামে। প্রতিবছর গ্রীষ্মের ছুটিতে নাদিয়াদের পুরো পরিবার বাংলাদেশে আসতো, ঘুরে যেতো পৈত্রিক ভিটায়। প্রতিবছর বাবা-মা আর ভাই-বোনদের নিয়ে এখানে আসতো বলেই অন্তরে এখন বাংলাদেশকে লালন করে নাদিয়া।
২০১৬ থেকে এখন পর্যন্ত বেশ কিছু টিভি ‘শো’ তে দেখা গেছে নাদিয়া হোসেনকে। এ বছর নাদিয়াকে দেখা যাবে নতুন আরেকটি কুকিং ‘শো’ তে। Time To Eat নামের এই শো এ অল্প সময়ে স্বল্প খরচে রান্নার কিছু উপায় দেখাবেন নাদিয়া। কবে থেকে এই ‘শো’ টিভিতে শুরু হবে তা এখনও ঠিক না হলেও আট পর্বের এই অনুষ্ঠানটি নিয়ে দর্শকদের মাঝে বেশ আগ্রহ রয়েছে।
এছাড়াও ২০১৮ সালে BlissHome এর সাথে মিলিতভাবে নাদিয়া হোসেন বাজারে এনেছেন তার Homewares Collection। এতে আছে স্পাইস র্যাক, ডিজাইনার মোমবাতি, রান্নার এপ্রোন, টি টাওয়েল, ওভেন গ্লাভস।
২০১৬ সালে ২১ এপ্রিলে বাকিংহাম প্যালেসের অনুরোধে রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের ৯০তম জন্মদিনের কেক তৈরি করেন নাদিয়া হোসেন। এক সাক্ষাতকারে নাদিয়া বলেছিলেন, সনাতনী ডিজাইনের তুলনায় সম্পূর্ণ অন্যরকম চেহারায় তিনি রানির জন্মদিনের এ কেকটি বানিয়েছিলেন। কেকটি দেখে রানি এলিজাবেথ নাদিয়াকে প্রশ্ন করেছিলেন এর ভিতরে কি আছে? নাদিয়া উত্তরে বলেছিলেন ‘অরেঞ্জ ড্রিজল’। রানি তখন আবার প্রশ্ন করেন এটা কি কাটা যাবে? উত্তরে নাদিয়া হেসে বলেছিনে হ্যাঁ কাটা যাবে। এবং কেকটি কাটতে রানির কোন অসুবিধাই হয় নি।
এছাড়া London Dungeon এর অনুরোধে ১৬৬৬ সালের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের (Great Fire of London) ৩৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে একটি বড় fire-inspired loaf তৈরি করেন নাদিয়া। তাছাড়া ডিজনির ইচ্ছায় ডিজনির অন্যতম চরিত্র “এলিস” এর থিমেও কেক তৈরি করেছেন তিনি।
এতোসব কাজের মাঝে নিজেকে ব্যস্ত রাখলেও ব্যক্তিগত জীবনে তিনি দুই ছেলে এবং এক মেয়ের মা। তার স্বামী আবদাল হোসেন এর সাথে তার বিয়ে হয় পারিবারিকভাবে মাত্র ১৯ বছর বয়সে। একদম অপরিচিত একজন মানুষের সাথে সারা জীবনের জন্য জড়িয়ে যাওয়া তার জন্য বেশ কষ্টকর ছিল। ২০১৮ সালে ডিসেম্বরে তাই তারা আরও একবার বিয়ে করেন। বর্তমানে স্বামী আবদাল হোসেন ও তিন সন্তানকে নিয়ে লন্ডনের অদূরে মিলটনকিন্স শহরে নাদিয়ার বসবাস। একজন নামকরা রন্ধনশিল্পী হিসেবে শুধুমাত্র সেলিব্রেটি জীবন যাপন করেন না তিনি। কাজ করেছেনে মানুষের জন্যও। Starlight Children’s Foundation এবং WaterAid এর বিশেষদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে নিহত মুসলিম সৈন্যদের স্মরণে “পপি হেডস্কার্ফ” পরে মুসলিম কমিউনিটি তে এক অন্যরকম শান্তির বার্তা পৌঁছে দেন নাদিয়া। কাজ করেছেন নারীর উন্নয়নেও।
সহজ সরল নাদিয়া হোসেন কোন কাজ কাউকে খুশি করার জন্য করেন না। মাথায় স্কার্ফ পরা থেকে শুরু করে একজন মুসলিম ব্রিটিশ বাংলাদেশি হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করা সব কিছুই করেন নিজের মন থেকে। তাই খুব সহজেই তিনি বলতে পারেন ‘I’m just me. I’m a part of the Bangladeshi community, I’m a part of the Muslim community, I’m British. But my aim isn’t to represent any of those communities, my aim is to represent me, and the best job and the most important job that I do is being a mum – and if I can nail that then I’m happy.’