প্রবাস মেলা ডেস্ক: সম্প্রতি যুক্তরাজ্য প্রবাসী আবু তাহের গিয়াস উদ্দিন খিজির ও নুরুল আমীন দেশে আসলে তারা বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী সিরাজুল আলম খান এর সাথে তার বাসায় সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। এসময় তারা বাংলাদেশ ও বিশ্বের রাজনীতি, সমাজনীতি ও অর্থনীতি সহ বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করেন। আলোচনার এক ফাঁকে সিরাজুল আলম খানের হাতে প্রবাস মেলা’র সৌজন্য কপি তুলে দেন। পত্রিকাটি হাতে পেয়ে তিনি এর ভূয়সী প্রশংসা করেন এবং প্রবাসীদের জন্য এরকম একটি পত্রিকা প্রকাশের উদ্যোগকে স্বাগত জানান। উল্লেখ থাকে যে, আবু তাহের গিয়াস উদ্দিন খিজির ও নুরুল আমীন দু’জনই সিরাজুল আলম খানের রাজনৈতিক শিষ্য।
উল্লেখ্য, সিরাজুল আলম খান বাংলাদেশের রাজনীতির তাত্ত্বিক ব্যক্তিত্ব। তার জন্ম ১৯৪১ সালে নোয়াখালী জেলার বেগমগঞ্জ থানার আলীপুর গ্রামে। তিনি ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র। স্থানীয় স্কুলে কিছুদিন লেখাপড়া করে তিনি বাবার কর্মস্থল খুলনায় চলে যান। ১৯৫৬ সালে খুলনা জিলা স্কুল থেকে প্রথম বিভাগে এসএসসি পাস করেন। তারপর ঢাকা কলেজ থেকে ১৯৫৮ সালে এইচএসসি পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিত বিভাগে সম্মান শ্রেণিতে ভর্তি হন।
তার ছাত্রজীবন এবং রাজনৈতিক জীবন বেশ ঘটনাবহুল। তিনি ১৯৬১ সালে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সহ সাধারণ সম্পাদক ও ১৯৬৩ সালে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৬২-১৯৭১ পর্যন্ত ছাত্র আন্দোলন, ৬-দফা আন্দোলন, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার ও বঙ্গবন্ধুর মুক্তির আন্দোলন, ১১-দফা আন্দোলন পরিকল্পনা ও কৌশল প্রণয়ন করে তিনি। আন্দোলনের এক পর্যায়ে গড়ে তোলা হয় ‘নিউক্লিয়াস নামে একটি সংগঠন। এই নিউক্লিয়াসের সদস্য ছিলেন আব্দুর রাজ্জাক ও কাজী আরেফ আহমেদ। এর রাজনৈতিক উইং বি.এল.এফ এবং সামরিক ইউনিট ‘জয় বাংলা বাহিনী’। ১৯৬৯-১৯৭০ সনে গণআন্দোলনের চাপে ভেঙে পড়া পাকিস্তানি শাসনের সমান্তরালে ‘নিউক্লিয়াস’র সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তিনি বিভিন্ন সংগঠন গড়ে তোলেন। প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের অধীনস্থ ১১টি সেক্টরের পাশাপাশি ৪টি সেক্টরে বিভক্ত করে বিএলএফ-এর সশস্ত্র সংগ্রামের পরিকল্পনা ও কৌশলী কার্যক্রমে তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। বিএলএফ এর চার প্রধান ছিলেন শেখ ফজলুল হক মনি, সিরাজুল আলম খান, আব্দুর রাজ্জাক এবং তোফায়েল আহমেদ। ১৯৭০ সনের নির্বাচনে অংশগ্রহণ এবং আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের নির্বাচিত করার দায়িত্ব পালন করে বিএলএফ। নির্বাচনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে গণআন্দোলনে গড়ে ওঠা জনমতকে সাংবিধানিক এবং প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়ে গণরায়ে পরিণত করার এই কৌশলও নির্ধারণ করে বিএলএফ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সানন্দে এই সিদ্ধান্ত মেনে নেন। আন্দোলন, নির্বাচন, সমান্তরাল প্রশাসন এবং আসন্ন সশস্ত্র সংগ্রামকে হিসাবে নিয়ে বিভিন্ন বাহিনী গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সিরাজুল আলম খান অসামান্য অবদান রাখেন।
মুক্তিযুদ্ধ শেষে স্বাধীন স্বদেশভূমিতে ফিরে আসলে আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তার বিপ্লবী জাতীয় সরকার গঠন প্রশ্নে মতভেদ দেখা দেয়। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর আন্দোলন-সংগ্রামের রূপ ও চরিত্র বদলে যায়। ফলে তারই নেতৃত্বে গড়ে ওঠে একমাত্র বিরোধী দল জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ। ১৯৭৫ সনের ৭ই নভেম্বরে অনুষ্ঠিত ‘অভ্যুত্থান’ বাংলাদেশের জাতীয় ইতিহাসে এক ঘটনা। জাসদ গঠন এবং ‘অভ্যুত্থান’ এর নেপথ্য পরিকল্পনাকারী ছিলেন সিরাজুল আলম খান। আর এই দুটি বৃহৎ ঘটনার নায়ক ছিলেন তারই রাজনৈতিক শিষ্য মেজর জলিল, আ স ম আবদুর রব এবং লেফটেন্যান্ট কর্নেল আবু তাহের।
সিরাজুল আলম খানের বিশ্ববিদ্যালয় ডিগ্রী অঙ্ক শাস্ত্রে হলেও দীর্ঘ জেল জীবনে তিনি দর্শন, সাহিত্য, শিল্পকলা, রাজনীতি-বিজ্ঞান, অর্থনীতি, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, সমাজবিজ্ঞান, পরিবেশ বিজ্ঞান, সামরিক বিজ্ঞান, মহাকাশ বিজ্ঞান, সংগীত, খেলাধুলা সম্পর্কিত বিষয়ে ব্যাপক পড়াশোনা করেন। ফলে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের উপর গড়ে উঠে তার অগাধ পাণ্ডিত্য এবং দক্ষতা। সেই কারণে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকলেও তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উইসকনসিন রাজ্যের অসকস বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৯৬-১৯৯৭ সালে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক নিযুক্ত হন। আর্থ-সামাজিক বিশ্লেষণে সিরাজুল আলম খানের তাত্ত্বিক উদ্ভাবন বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক নতুন অধ্যায়। মার্কসীয় রাজনৈতিক তত্ত্বের আলোকে বাংলাদেশের জনগণকে শ্রমজীবী-কর্মজীবী-পেশাজীবী হিসাবে বিভক্ত করে ‘রাষ্ট্রীয় রাজনৈতিক’ মডেল হাজির করেছেন সিরাজুল আলম খান। বাংলাদেশকে কয়েকটি প্রদেশে ভাগ করে প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচন এবং প্রাদেশিক সরকার গঠন, উপজেলা পর্যায়ে স্ব-শাসিত স্থানীয় সরকার পদ্ধতি চালু করার মধ্য দিয়ে ব্রিটিশ-পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক আইন ব্যবস্থা ও শাসন কাঠামোর পরিবর্তে স্বাধীন দেশের উপযোগী শাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলার মডেল উত্থাপন করেন তিনি। বাংলাদেশের অন্য জাতিসত্তাসমূহের স্বীকৃতির প্রয়োজনও তার চিন্তার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। বাংলাদেশে শিল্পায়ন করার লক্ষ্যে প্রবাসীদের অর্থায়নে ‘উপজেলা শিল্প এলাকা’ এবং ‘পৌর শিল্প এলাকা’ গঠন করার তার প্রস্তাব ইতোমধ্যেই সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।
সিরাজুল আলম খান ভিন্ন ভিন্ন মেয়াদে প্রায় ৭ বছর কারাভোগ করেন। কনভোকেশন মুভমেন্টের কারণে ১৯৬৩ সালের শেষ দিকে গ্রেফতার হন। ১৯৭৬ সালে জিয়ার আমলে আবার গ্রেফতার এবং ১৯৭৯ সালে মুক্তি পান। ১৯৯২ সালে খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন বিদেশ যাবার প্রাক্কালে ঢাকা বিমানবন্দর থেকে ২৪শে মার্চ সিরাজুল আলম খানকে গ্রেফতার করা হলে ৪ মাস পর হাইকোর্টের রায়ে তিনি মুক্তি পান।
তার দীর্ঘ ৫০ বছরের রাজনৈতিক জীবনে অসংখ্য ছাত্র-যুব নেতাদের সঙ্গে তার সুসম্পর্ক এক বিষ্ময়কর ব্যাপার। রাজনৈতিক তত্ত্ব উদ্ভাবন এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন মডেল প্রণয়ণে দেশে বিদেশে তার অনেক সহযোগি রয়েছে।