বাংলা সংগীতের খ্যাতিমান পরিচালক ও সুরকার শেখ সাদী খান। তাকে বাংলাদেশের সঙ্গীতের জাদুকর হিসেবেও অভিহিত করা হয়। গানের মধ্যদিয়ে এই সংগীত পরিচালক নিজেকে নিয়ে গেছেন অন্য উচ্চতায়। অসংখ্য কালজয়ী গানের স্রষ্টা তিনি। এছাড়া তিনি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। সম্প্রতি এক সন্ধ্যায় গুণী এই সংগীত পরিচালক আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে প্রবাস মেলা অফিস পরিদর্শন করেছেন। প্রবাস মেলার কলাকুশলীদের সঙ্গে আড্ডায় তার সংগীত জীবনের নানা বিষয়ে কথা বলেন। আলোচনা আড্ডায় কথা বলেছেন সংগীত জীবনের শুরুর কথা, দীর্ঘ সংগীত ক্যারিয়ার, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নিয়ে নিজের ভাবনা। সেসসবের চুম্বক অংশ পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো।
জন্ম ও বেড়ে উঠা
জীবন্ত কিংবদন্তি সংগীত পরিচালক শেখ সাদী খান। তিনি ওস্তাদ আলাউদ্দিন খানের ভাতিজা, ওস্তাদ আয়েত আলী খানের সন্তান, বিখ্যাত ওস্তাদ আবেদ হোসেন খান, বাহাদুর হোসেন খান ও সংগীতজ্ঞ মোবারক হোসেন খানের ছোট ভাই। ১৯৫০ সালের ৩ মার্চ ব্রাহ্মণবাড়িয়ার শিবপুর গ্রামের সংগীত সমৃদ্ধশালী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তার পিতা ওস্তাদ আয়েত আলী খাঁ উপমহাদেশের বিখ্যাত সুর সাধক। পিতার হাত ধরে সংগীত শিক্ষা শুরু করেন শেখ সাদী খান। প্রথমে তবলা ও তারপর বেহালা শেখেন। শেখ সাদীর শৈশব কাটে ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও কুমিল্লায়। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজিয়েট স্কুলে শিক্ষাজীবন শুরু করেন। ঢাকার ধানমন্ডি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক পাশ করেন। এরপর আইমিউজ ও বিমিউজ করেন ঢাকা সংগীত মহাবিদ্যালয় থেকে। ১৯৬৩ সালে মেজভাই সরোদ বাদক ওস্তাদ বাহাদুর খানের সাথে ভারতে যান বেহালায় উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত শেখার জন্য। তিন বছর তার অধীনে তালিম নিয়ে ১৯৬৫ সালে বাংলাদেশে ফিরে আসেন।
ছোটবেলায় যেমন ছিলেন শেখ সাদী
ছোটবেলার প্রচুর ডানপিঠে ছিলেন শেখ সাদী। এই প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমাদের শৈশব কেটেছে বেশ আনন্দে। এখনকার ছেলেদের শৈশব দেখলে আফসোস হয়। অথচ এ সময়টা আমরা অনেক উপভোগ করেছি। এখনকার শৈশব তো মোবাইলে বন্দি হয়ে গেছে। শেখ সাদী ছোটবেলায় বেশ ক্রিকেট আর ফুটবল খেলতেন বলে জানান।
সংগীতে শুরু যেভাবে
শেখ সাদী সংগীত পরিবারের সন্তান। ছোটবেলা থেকেই সুরের সঙ্গে বড় হয়েছেন তিনি। যে কারণে সংগীতের প্রতি আলাদা একটা আকর্ষণ ছিল। জন্মগতভাবে এটাও সুরের প্রতি আগ্রহের অন্যতম কারণ। পরিবারের ছেলেদের সংগীতের রেওয়াজটা নিতে হবে-এটা ছিল পারিবারিক ঐতিহ্যের ব্যাপার। এ বিষয়ে তিনি বলেন, আমাদের বলা হতো, তুমি যা কিছুই করো, সংগীতটা শিখো। ছোটবেলা থেকেই তালিম পেয়েছিলাম বাবার কাছে। তবলায়। এটা সবারই প্রয়োজন। তালের তালিম। তাল যদি জানা না থাকে, সংগীতের যেকোনো শাখায় বিচরণ করা কষ্টসাধ্য হয়ে ওঠে। তাল না থাকলে বেতাল হয়ে যেতে পারে। সে জন্য পরিবারে প্রথমেই আমাদের তালযন্ত্রে হাতেখড়ি দেওয়া হয়। তার বাবার কাছে প্রথমে তবলায়, পরে বেহালায় হাতেখড়ি হয়। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সুর সম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ আমার জ্যাঠা। বাবা উপমহাদেশের প্রখ্যাত সুর সাধক ওস্তাদ আয়েত আলী খান। যে পরিবার পঞ্চম পুরুষ পর্যন্ত সঙ্গীতচর্চা করে চলেছে। মা-বাবার প্রেরণাতেই আজকের এ শেখ সাদী খান।
কর্মজীবন
১৯৬৫ সালে রেডিও পাকিস্তান চট্টগ্রামে বেহালা বাদক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন শেখ সাদী খান। তিন বছর সেখানে চাকরির পর ১৯৬৮ সালে তৎকালীন পাকিস্তান টেলিভিশনে যোগ দেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় যুক্ত হন স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের সঙ্গে। বাংলাদেশ স্বাধীন হলে বাংলাদেশ বেতারে সংগীত পরিচালক হিসেবে যোগ দেন। শেখ সাদী খান সত্তরের দশকে সংগীত পরিচালক খন্দকার নুরুল আলমের সহকারী হিসেবে চলচ্চিত্রে পদার্পণ করেন। ১৯৭৭ সালে সংগীত পরিচালক হিসেবে সারাদেশে খ্যাতি লাভ করেন। প্রথম চলচ্চিত্রের সংগীত পরিচালনা করেন ১৯৮০ সালে আবদুল্লাহ আল মামুন পরিচালিত ‘এখনই সময়’ চলচ্চিত্রে। ১৯৮৫ সালে তার সঙ্গীত পরিচালনায় ‘সুখের সন্ধানে’ চলচ্চিত্রের গানে কণ্ঠ দেন উপমহাদেশের প্রখ্যাত সঙ্গীতশিল্পী মান্না দে। এছাড়া তিনি আশা ভোঁসলে, সাবিনা ইয়াসমিন, সুবীর নন্দী, এন্ড্রু কিশোর, শাম্মী আখতার, এস আই টুটুল, চন্দনা মজুমদার, ফেরদৌস আরা, আসিফ আকবর, দিনাত জাহান মুন্নী, রুনা লায়লাসহ দেশি-বিদেশি অনেক শিল্পীর সাথে কাজ করেন।
গানের কথায় সুর
শেখ সাদী খান ১৯৬৯ সালের দিকে গানে সুর দেয়া শুরু করেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ওই সময় বেহালা বাজানোর সঙ্গে সঙ্গে গানে সুর করার অনুশীলন শুরু করতাম। তখন কয়েকজন শিল্পীর জন্য গানের সুর দিই। কয়েকটি গান রেডিও টিভিতে প্রচার হওয়ার পর শ্রোতারা বেশ প্রশংসা করেন। তাদের ওই প্রশংসায় বেশ উৎসাহ পাই। তখনই ওই সময়ের বিখ্যাত মিউজিক কোম্পানি হিজ মাস্টারস ভয়েজ অর্থাৎ এইচএমভিতে সুর ও সংগীত পরিচালনার সুযোগ পাই। শিল্পী মৌসুমী কবির ও শওকত হায়াত খানের কণ্ঠে আমার সুর ও সঙ্গীত পরিচালনায় চারটি গান রেকর্ড করা হয়। যা আমার সঙ্গীত নিয়ে পথচলা সুগম করে দেয়। এটা আমার জন্য বিশাল এক পাওয়াও ছিল।
জনপ্রিয় গান
কোটি মানুষের হৃদয়ে গেঁথে থাকা অসংখ্য গানের সুরকার শেখ সাদী খান। এর মধ্যে কয়েকটি জনপ্রিয় গান হলো- কাল সারা রাত ছিল স্বপনের রাত, আমার এই দুটি চোখ পাথর তো নয়, ডাকে পাখি খোলো আঁখি, তুমি রোজ বিকেলে আমার বাগানে ফুল নিতে আসতে, আমার মনের আকাশে আজ জ্বলে শুকতারা, জীবন মানে যন্ত্রণা, পৃথিবীতে প্রেম বলে কিছু নেই, তোমার চন্দনা মরে গেছে, কেন ভালোবাসা হারিয়ে যায়, ভালোবাসলেই ঘর বাঁধা যায় না, ওগো বিদেশিনী তোমার চেরি ফুল দাও, শোনো সোমা একটু দাঁড়াও, তোমারে নি চিনি বন্ধু তোমারে নি চিনি প্রভৃতি।
পারিবারিক জীবন
শেখ সাদী খান ব্যক্তিগত জীবনে রওশন আরা বেগমের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। এই দম্পতির এক ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে। ছেলে রওনাক ফেরদৌস খান এমবিএ শেষ করে লন্ডনে চাকরি করছেন। মেয়ে সাগুফতা জারিন খান ম্যানেজমেন্ট মাস্টার্স করে প্রিমিয়ার ব্যাংকে উচ্চপদে কর্মরত।
পুরস্কার
শেখ সাদী খান ২০১৮ সালে সংগীতে একুশে পদকে ভূষিত হন। ২০০৬ সালে ‘ঘানি’ চলচ্চিত্রের জন্য শ্রেষ্ঠ সংগীত পরিচালক এবং ২০১০ সালে ‘ভালোবাসলেই ঘর বাঁধা যায় না’ চলচ্চিত্রের জন্য শ্রেষ্ঠ সুরকার হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন। তিনি (২০২০-২০২১) বাংলা একাডেমি ফেলো লাভ করেন। শেখ সাদী খান ১৯৮৪, ১৯৯৬ এবং ২০০৪ সালে বাচসাস পুরস্কার, ২০১৮ সালে ভারত থেকে গীতিকার পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় সম্মাননাসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে শতাধিক পুরস্কারে ভূষিত হন।
আলাপচারিতায় লেখা তৈরি ও সম্পাদনা করেছেন- শহীদ রাজু।