ইসরাত জেবিন
ইরানের বর্তমান প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি। মধ্যমপন্থী নেতা হিসেবে পরিচিত রুহানি ইরানের ২০১৩ সালের ১৪ জুন হওয়া প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রথমবারের মত নির্বাচিত হন এবং ৩ আগস্ট থেকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করা শুরু করেন। ইরানের সপ্তম প্রেসিডেন্ট এবং মুসলিম বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী এই নেতা দ্বিতীয় দফায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন ২০১৭ সালে। একজন আইনজীবী, ইসলামিক চিন্তাবিদ এবং দক্ষ কূটনীতিক হিসেবে পরিচিত হাসান রুহানি নিজেকে বর্তমান পর্যায়ে এনেছেন তার শিক্ষা এবং রাজনৈতিক প্রজ্ঞার মাধ্যমে।
প্রেসিডেন্ট রুহানি সম্পর্কে আলোচনার আগে চলুন এক নজরে জেনে নেই ইরান সম্পর্কে…
ইরান: দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়ায় পারস্য উপসাগরের তীরে অবস্থিত একটি মুসলিম রাষ্ট্র ইরান। ভৌগলিকভাবে ইরান বিশ্বের সবচেয়ে পর্বতময় দেশগুলোর একটি। হিমালয়ের পরে এশিয়ার দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ দামভান্দ এখানেই অবস্থিত। জাতি ও ভাষায় বৈচিত্র্য থাকলেও ধর্মীয়ভাবে বেশিরভাগ মানুষ মুসলিম ধর্মাবলম্বী। পারস্য উপসাগরের অন্যান্য তেলসমৃদ্ধ দেশের মতো ইরানেও অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি তেল রপ্তানি। এছাড়া পর্যটন খাতও দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। শিয়া অধ্যুষিত ইরান পৃথিবীর প্রাচীনতম থেকে শুরু করে বর্তমান পর্যন্ত অস্তিত্বশীল বৃহৎ সভ্যতাগুলোর মধ্যে অন্যতম।
প্রেসিডেন্ট রুহানির প্রাথমিক জীবন ও শিক্ষা: প্রেসিডেন্ট রুহানির জন্ম ১৯৪৮ সালে ১৩ নভেম্বর সেমনান প্রদেশের সোরখেহ শহরে। ধার্মিক পরিবারে জন্ম হওয়া রুহানি ১৯৬০ সালে সেমনানের ধর্মতত্ত্ব কেন্দ্রে ইসলামের ওপর পড়াশোনা শুরু করেন। একবছর অধ্যয়নের পর তিনি ইরানের পবিত্র নগরী কোম চলে যান। সেখানে বিশিষ্ট ইমালামিক চিন্তাবিদ এবং দার্শনিকদের সান্নিধ্যে শিক্ষা গ্রহণ করেন। সেই সাথে আধুনিক শিক্ষায় ও নিজেকে শিক্ষিত করে তোলেন। ১৯৬৯ সালে তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ১৯৭২ সালে আইন বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৯৫ সালে স্কটল্যান্ডের গ্লাসগো কালেডোনিয়ান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন বিষয়ে M.Phil. এবং ১৯৯৯ সালে Constitutional LaW এর উপর PhD করেন মুসলিম বি অন্যতম নেতা হাসান রুহানি।
রাজনীতিতে পদার্পণ: প্রেসিডেন্ট রুহানি হঠাৎ করে ইরানের রাজনীতিতে প্রকট হওয়া কোন ব্যক্তি নন। রাজনৈতিক টানাপড়েন এবং দীর্ঘ সময় অর্থনৈতিক অবরোধের মুখে থাকা ইরানের বিরোধের কাহিনী যেমন দীর্ঘ তেমনি এই বিরোধের সাথে রুহানির পরিবারের সংশ্লিষ্টতার ইতিহাসও দীর্ঘ। ১৯৭৯ সালে ইরানের শাসনক্ষমতা ছিল মার্কিনপন্থী রেজা শাহ পাহলভী’র হাতে। জানা যায়, হাসান রুহানির পিতা আসাদুল্লাহ রেজা শাহ পাহলভীর বিরুদ্ধে রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় ছিলেন এবং ১৯৬২ সালে গ্রেফতার হন। ১৯৭৯ সালে আয়াতুল্লাহ খোমেনীর নেতৃত্বে হওয়া Iranian Revolution বা ইসলামি বিপ্লবের আগ পর্যন্ত ২০ বারেরও বেশি তাকে জেলে যেতে হয়। পিতার মত ১৯৬৫ সাল থেকে রুহানি ইরানের বিভিন্ন জায়গায় ক্ষমতাসীনদের বিপক্ষে বক্তব্য প্রচার করতে থাকেন। ১৯৭৭ সালে Tehran’s Ark মসজিদে আয়তুল্লাহ খোমেনির জ্যেষ্ঠ পুত্র মোস্তফা খোমেনির স্মরণে আয়োজন করা এক অনুষ্ঠানে সর্বসম্মুখে প্রথম আয়তুল্লাহ খোমেনিকে ‘ইমাম’ বলে সম্বোধন করেন। সেই থেকে তিনি ঝঅঠঅক (রেজা শাহ তৈরি করা গোপন পুলিশ সংস্থা)’র নজরে পড়ে যান। পরবর্তীতে অন্যান্য নেতাদের পরামর্শে তিনি দেশের বাইরে চলে যান এবং ইউরোপে পড়তে যাওয়া ইরানি শিক্ষার্থীদের মাঝে তার তৎপরতা চালাতে থাকেন।
সংসদ সদস্য ও রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন: ১৯৭৯ সালে বিপ্লবের পর তিনি সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন এবং ২০০০ সাল পর্যন্ত একাধারে পাঁচবার সংসদ সদস্যের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি সংসদের ডেপুটি স্পিকার এবং প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্রনীতি সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির প্রধান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। ইরানের ওপর ইরাকের চাপিয়ে দেয়া আগ্রাসী যুদ্ধ চলাকালে ১৯৮০ থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত তিনি প্রতিরক্ষা উচ্চ পরিষদ, ইরানের বিমান প্রতিরক্ষা বিভাগের কমান্ডার এবং সশস্ত্র বাহিনীর ডেপুটি কমান্ডার ইন চীফের দায়িত্ব পালন করেন। ইরানের সর্বোচ্চ জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদ প্রতিষ্ঠার পর এ পরিষদে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনীর প্রতিনিধি হিসেবে তার নাম প্রস্তাব করা হয়। ২০০৫ সাল পর্যন্ত একাধারে ১৬ বছর এ দায়িত্ব পালন করেন তিনি। এ ছাড়া আলী আকবর হাশেমি রাফসানজানি এবং তার উত্তরসূরি মোহাম্মদ খাতামির শাসনামলে এ পরিষদের সচিবের দায়িত্ব পালন করেন হাসান রুহানি।
দুই দফায় প্রেসিডেন্ট: ২০১৩ সালে কট্টরপন্থীদের হারিয়ে প্রথম ক্ষমতায় আসেন হাসান রুহানি। এরপর ২০১৭ সালেও দ্বিতীয়বার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন সংস্কারপন্থী হিসেবে পরিচিত এই নেতা। ক্ষমতায় এসেই তিনি ইরানকে দীর্ঘদিনের অর্থনৈতিক অবরোধ থেকে মুক্ত করার পদক্ষেপ নেন। পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে ইরানের সাথে পশ্চিমা দেশগুলোর দীর্ঘ বিরোধ কারো অজানা নয়। ১৯৭৯ সালের বিপ্লব থেকেই আমেরিকা এবং ইরানের সম্পর্কের অবনতি হতে থাকে।
ইরানের সাথে পশ্চিমা বিশ্বের দ্বন্দের ইতিহাস: ১৯৭৯ সালে ইরানের শাসনক্ষমতায় থাকা মার্কিনপন্থী রেজা শাহ পাহলভীর পতন ঘটে আয়াতুল্লাহ খোমেনীর নেতৃত্বে এবং ১৯৭৯ সালের জানুয়ারিতে রেজা শাহ স্বপরিবারে ইরান থেকে পালিয়ে যান। এর দুই সপ্তাহ পরে ১৪ বছরের নির্বাসিত জীবন ছেড়ে বিপ্লবের নেতা হিসেবে আয়াতুল্লাহ খোমেনী ফ্রান্স থেকে দেশে ফেরেন। অক্টোবর, ১৯৭৯ তে পলাতক, দেশছাড়া শাহকে ক্যানসারের চিকিৎসার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে ঢুকতে দেয়া হয়। এর দুই সপ্তাহ পরে তেহরানের মার্কিন দূতাবাসে বিক্ষুব্ধ ছাত্ররা ঢুকে পড়ে ৫০ জন মার্কিনীকে জিম্মি করে। প্রতিবাদে যুক্তরাষ্ট্রে থাকা সকল ইরানির সম্পদ জব্দ করে যুক্তরাষ্ট্র।
১৯৮০ সালে শুরু হয় ইরাক-ইরান যুদ্ধ। ১৯৭৯ সালের ইসলামি বিপ্লবের প্রতিক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি ইরাকের স্বৈরশাসক সাদ্দাম হোসেনের পক্ষাবলম্বন করে।
১৯৮১ সালে যুক্তরাষ্ট্রে রোনাল্ড রিগ্যান প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেয়ার কয়েক মিনিটের মধ্যেই মার্কিন জিম্মিদের ছেড়ে দেয় ইরান।
২০০২ সালে জর্জ ডব্লিউ বুশ যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে স্টেট ইউনিয়নের ভাষণে ইরাক, ইরান এবং উত্তর কোরিয়াকে ‘শয়তানের দোসর’ হিসেবে অভিহিত করেন। একই বছরের আগস্ট মাসে স্বপক্ষত্যাগী একদল ইরানি দাবি করেন, তেহরান গোপনে সন্দেহভাজন পারমাণবিক কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছে। এবং তাদের এই দাবি পশ্চিমা বিশ্বকে সুযোগ এনে দেয়। সুযোগের সদ্ব্যবহার করে যুক্তরাষ্ট্র চড়াও হতে শুরু করে ইরানের ওপর।
২০০৬ সালের ডিসেম্বরে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ ইরানের ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা পাস করে। একই ধরনের ব্যবস্থা নেয় যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নও।
২০১১ সালে ইরানের ওপর সর্বাত্মক অবরোধ আরোপ করা হয়। মার্কিন কংগ্রেস ইরানের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে লেনদেন করা ঋণদাতাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। একই বছর জানুয়ারিতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সব দেশ ইরানের তেল আমদানির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে।
২০১২ সালে এসে সর্বাত্মক অবরোধ ইরানের অর্থনীতি ও সমাজকে মারাত্মক আঘাত করে।
ইরান ও ছয় বিশ্বশক্তির চুক্তি: ২০১৩ সালে ক্ষমতার পালাবদলে আসেন সংস্কারপন্থী নেতা হাসান রুহানি। নবনির্বাচিত মধ্যপন্থী প্রেসিডেন্ট আলোচনার প্রস্তাব দেন এবং বারাক ওবামার সাথে ফোনে কথা বলেন, ফলে ছোটখাট নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয়। পরমাণু কর্মসূচি স্থগিত করে ইরান।
২০১৪ সালে জুলাই-নভেম্বর সময়সীমার মধ্যে আলোচনায় সমঝোতা ব্যর্থ হয়।
২০১৫ সালের এপ্রিলে সুইজারল্যান্ডে ইরান ও ছয় বিশ্বশক্তির আলোচনা শুরু হলে সমঝোতার চূড়ান্ত রূপরেখার ব্যাপারে একমত হয় দু’পক্ষ।
একই বছরের জুনে অস্ট্রিয়ার ভিয়েনায় আলোচনা ফের শুরু হয়। টানা ২০ মাস ধরে যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের কূটনীতিকরা হোটেলের বন্ধ কক্ষে আলোচনা করেন।
সর্বশেষ দফা আলোচনার ১৮তম দিনে ১৮ জুলাই ২০১৫ এই ঐতিহাসিক সমঝোতা চুক্তি সম্পন্ন হয়।
পরমাণু চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বের হওয়া: আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্বাচিত হওয়ার পরই এই চুক্তিকে আমেরিকার জন্য লজ্জাজনক বলে আসছেন। সম্প্রতি তিনি এই চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বেরিয়ে যাওয়ার সই করেন, তবে আলোচনার জন্য তিনি প্রস্তুত বলেও জানিয়েছেন। এদিকে দু’দেশের প্রেসিডেন্ট এনিয়ে বাকযুদ্ধে জড়িয়েছেন। হাসান রুহানি ট্রাম্পকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন ‘সিংহের লেজ নিয়ে খেলবেন না’। ট্রাম্প পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় জানিয়েছেন ‘আমেরিকাকে আর কখনো হুমকি দিবেন না, দিলে এমন পরিমাণ ভোগ করবেন, ইতিহাসে যার সংখ্যা খুব কম’।