আহসান নবাব:
আমাদের যৌবনের দিকে ‘মিয়ামী ভাইস’ নামে বিটিভি-তে জনপ্রিয় একটা মনকাড়া ওয়েস্টার্ন সিরিজ দেখতাম। সপ্তাহের যে দিনটিতে এই ধারাবাহিক প্রচারিত হতো সেদিন সব কাজ ফেলে বসে পড়তাম দুই মোটর বাইক সার্জেন্ট ডন জনসন, ফিলিপ মাইকেল টমাস আর প্রেয়সী সান্তিয়াগোর টানে। তখন বা কিছু পরবর্তীকালে মিয়ামী বীচ নিয়ে বড়লোকী সাতকাহনের কত উপাখ্যানই না আমাদের গোচরে আসতো। তা নিয়ে হৃদয় মন উথাল পাথাল হয়নি কোন যুবকের? কার না মনে হয়নি আহা, যদি একবার ওখানে যেতে পারতাম! ২০১৭ তে ছেলে, বউমা, নাতনীর টানে লস এঞ্জেলসে পৌঁছানোর সপ্তাহ খানেক পর থেকেই মিয়ামী থেকে অশোক করের তীব্র দুর্নিবার ডাক আসলো সেখানে তার মেহমান হওয়ার। ব্যাটে বলে মিলে গেল। অশোক রাজবাড়ীর ছেলে। আমাদের সব ভাই বোনদের বেড়ে ওঠা রাজবাড়ীতে। আমি-অশোক একসাথে ওখানে খেলাঘর করেছি, ছাত্র ইউনিয়ন ভাবাদর্শের মানুষ আমরা। অশোক কর কবি মানুষ। ভালো কবিতা লেখে। সাহিত্যের প্রতি আমারও দুর্বলতা রয়েছে। এসব সমীকরণ মিলিয়েই অশোক আমার অসম্ভব প্রিয় এক ছোট ভাই। মিয়ামী, ফ্লোরিডা ভ্রমণ পিয়াসুদের কাছে অগ্রাধিকার তালিকায় উপরের সারির নাম। তাই অশোকের আমন্ত্রণে পুঁজোয় ঢোলের বাড়ি পড়লো। আমার বাবা ছিলেন ভ্রমণ পিয়াসু মানুষ। ছেলে-বউমা ভ্রমণ অন্ত প্রাণ। ছেলেকে ইচ্ছের কথা জানাতেই বাপজান আমার লস এঞ্জেলস-অরল্যান্ডো-মিয়ামী-আটলান্টা-লস এঞ্জেলস এয়ার টিকেট কেটে দিল। চলে গেলাম মিয়ামী। এয়ারপোর্টে প্রায় ২০/২৫ বছর পরে অশোক কে জড়িয়ে ধরলাম। কি আনন্দ, কি অপার্থিব মন উচাটন ভাললাগা! এয়ারপোর্টের পাশে বারগার কিং রেস্টুরেন্টে বসে দুজন সকালের নাস্তা করে নিলাম। এরপর ফেলে আসা দিনগুলির স্মরণে জাবর কাটা শেষে আমার জন্য বরাদ্দ রাখা অতিথি নিবাসে কিছুটা বিশ্রাম নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম যৌবনের লালিত স্বপ্নের চিরযৌবনা মিয়ামী বীচের মোহনীয় তটে। বীচে ঘুরি, পারিপার্শ্বিকতা দেখি, বীচের সৌর্ন্দয্য নর-নারী দেখি……। মিয়ামী বীচের উল্টো পাশে মানব সৃষ্ট অপরূপ মোহনীয় লেক দেখি, দেখি মানুষের উপচে পড়া বিত্ত-বৈভব, নানা নয়নকাড়া স্থাপত্য দেখি! পরদিন আবার সী-বীচে যাই। এটা ফোর্ট মায়ার্স বীচ। আরো সুন্দর। সী-বীচে বালি নয় যেন চিনি গুড়ো করে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দেয়া আছে। সাদা ধবধবে পুরো বীচ। মাইলের পর মাইল। তাতে রৌদ্র স্নানে মত্ত শত শত স্বল্প বসনা নারী পুরুষ। কিছু এলাকা আছে যেগুলো উদোম শরীরের দখলে… তখন আমি দৃষ্টি ফিরিয়ে সীগাল দেখি, বড় সর ভয়ডরহীন পেলিকেন পাখি দেখি, গভীর বিস্তীর্ণ সবুজাভ জলরাশি দেখি…। সন্ধ্যায় শহর দেখি, প্রাচুর্য দেখি। অবাক হয়ে দেখি, আমাদের দেশের আমগাছ, কুল গাছ, কৃষ্ণচুড়া গাছ, জবা, তুলসীগাছ ছড়িয়ে আছে এই শহরে। পরদিন আবারও নতুন আরেক সী-বীচে যাই। সারাসোটা সী-বীচ। এটিও অনিন্দ্য সুন্দর।
এরপর একদিন মিয়ামী থেকে ১৬০ মাইল দুরে আমেরিকার দক্ষিণের সর্বশেষ স্থলভূমি কী-ওয়েস্টে যাই। কী-ওয়েস্ট যেতে সমুদ্রের উপর দিয়ে তৈরি ৭ মাইল ব্রিজ আর সমুদ্রের উপর দিয়েই তৈরি ৩০ মাইল রাস্তা পাড়ি দিতে হয়। বলেছি কী-ওয়েস্ট আমেরিকার দক্ষিণের শেষ সীমান্ত! এখান থেকে সমুদ্র পথে মাত্র ৯০ মাইল দূরে কিউবার রাজধানী হাভানা। সন্ধ্যা নামতেই হাভানার বৈদ্যুতিক আলোকচ্ছটা আটলান্টিক মহাসাগরের এপারের শত্রু রাষ্ট্র্র আমেরিকার জনপদকে ছুঁয়ে যায়। আলো-দের সীমানা পেরুতে বাধা নেই, আলোদের শত্রু-মিত্র’র বাছ বিচার নেই। আলো-তো সেই মহার্ঘ অনুসঙ্গ যা আজকের মানব সভ্যতার সবচেয়ে প্রয়োজনীয় উপহার…..
মিয়ামী বা ফ্লোরিডার উল্লেখযোগ্য সংখ্যক অধিবাসী ফিদেল কাস্ত্রো, চেগুয়েভেরার স্বপ্নের দেশ কিউবার মানুষ। তারা এখন আজকের জনতুষ্টিবাদী সাবেক প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প অনুগত মানুষ।
এই সাথে একটুখানি আমাদের কক্সবাজার সী-বীচের কথা বলি। অপূর্ব নৈসর্গিক এক বীচ আমাদের। দীর্ঘ বীচ-কে ডানে রেখে সমান্তরালভাবে পাশে থাকা পাহাড়, ঝাউ এর ঘন ঝোপ, এখানে আকাশ ছড়িয়ে আছে নীল হয়ে আকাশে আকাশে, প্রকৃতি সৃষ্ট কি গভীর নিসর্গ এই সী-বীচ! এখানে কৃত্রিম আলোর বাইরে নক্ষত্রের আলোরা নৃত্য খেলা করে। তুলনা করলে আমি এগিয়ে রাখবো মিয়ামীকে নয়, কক্সবাজারকেই। কিন্তু জনঘনত্ব, সী-বীচে আমাদের প্রাত্যহিক বিহেভিয়ার, অপরিণামদর্শী ব্যবস্থাপনা আরো সব নোংরামি আমাদের কক্সবাজারকে ক্রমশ পিছিয়ে দিচ্ছে আন্তর্জাতিক মান থেকে। এসব কারণেই হায়, আমরা মিয়ামীর জয়গান গাই, ভুলে থাকতে চাই অপূর্ব, অদ্ভুত মোহনীয়তায় সেরা কক্সবাজার অপ্সরীকে….
সত্যি এ আমাদের অনেক বড় দীনতা।