মহুয়া পৈত, কোলকাতা, ভারত:
‘বাবান… বাবান…., ছেলেটা যে সারাদিন ওই জানালা দিয়ে কি দেখে কে জানে? আমার আবার ৯টার ভেতরে অফিসে যেতে হবে। বাবান, কি হলো, ডাকছি শুনতে পাচ্ছো না? স্কুল বাস চলে আসবে তো, মুখে ব্রাশ নিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছো কেন? তাড়াতাড়ি ব্রাশ করে নাও। জলদি জলদি… ইনি হলেন মিসেস অ্যানা ব্যানার্জি। নিজের ‘অনামিকা’ নামটি ছোট করে ফেলেছেন যাতে তাকে ডাকতে সময় কম লাগে। একটি বড় কন্সালট্যান্সিতে চাকরি করেন। মাস গেলে লাখ খানেক টাকা ঘরে আনেন। নিজের পড়াশুনোর ওপর খুব ভরসা। তিনি চান তার ছেলেও তার মত পড়াশুনা করে একজন সফল মানুষ হবে। সবে ৬ বছরের বাবান, অফিস যাবার আগে ছেলেকে ঘুম থেকে তুলে রেডি করে স্কুল বাসে তুলে দিয়ে তবে শান্তি। সব সময়ের একটি কাজের মেয়ে থাকে যে বাবান কে দেখাশোনা করে আর ঘরের কাজকর্ম করে।
বাবানের বাবা তমাল ব্যানার্জির চা পাতা বিক্রির দোকান, বেশ বড় দোকান। আসলে উনি একজন টি টেস্টার। আয় বেশ ভালো। দোকানে রোজ প্রায় কুড়ি থেকে পঁচিশ হাজার টাকার কেনা-বেচা হয়। ব্যবসা বলে তমাল ব্যানার্জির অফিস যাবার তাড়া নেই। তিনি ধীরে সুস্থে উঠে আয়েশ করে সব কিছু করে তবে দোকানে যান। তবে এতে করে বাবানের মা খুব একটা খুশি নন তার স্বামীকে নিয়ে। কারণ তিনি কোনো বড় কোম্পানি বা কোনো কর্পোরেট অফিসে চাকরি করেন না। তাই বাবান কে নিয়ে অ্যানা ব্যানার্জির অনেক স্বপ্ন। কথায় কথায় বাবানকে বলেন ‘কখনোই বাবার মত চা পাতাওয়ালা হবে না।’ বাবান অবাক হয়ে ভাবে, চা না খেলে মায়ের মাথা ব্যাথা করে তাহলে বাবার মত চা পাতাওয়ালা হলে ক্ষতি কি? যদিও মায়ের সামনে বলে না, জানে বকা খেতে হবে।
আজ শনিবার বাবানের স্কুল ছুটি, তাই বাবানের খুব মজা। মা চলে গেলে চুপি চুপি বাগানে গিয়ে ওই ছোট ছোট ঘরগুলোর বাচ্চাগুলোর সাথে খেলবে। আজ আবার দুজনকে নতুন দেখতে পেলো। বাবাও বেরিয়ে যাবে, খুব মজা হবে। গত শনিবার পেচু, লালু, বুধন, রফিক, সাদেক এসেছিল খেলতে, বলে গেছে এই শনিবারও আসবে। এই শনিবার সাদেক বলেছে ওদের গাছ থেকে পেয়ারা নিয়ে আসবে। যদিও মা কিনে নিয়ে আসে পেয়ারা। কিন্তু গাছ থেকে পাড়া পেয়ারা বেশি ভালো হবে নিশ্চয়, ভাবতেই বাবানের জিভে জল এলো। লালু বলেছে একটু বিট লবণ রাখতে, তাতে নাকি পেয়ারা খেতে খুব ভালো লাগবে। ডালিয়া দিদির কাছ থেকে বিট লবন চেয়ে নেবে। ডালিয়া দিদি খুব ভালো। বন্ধুদের সাথে খেললে মা বাবাকে বলে দেয় না। ৯টা বাজতে না বাজতে অ্যানা ব্যানার্জি বেরিয়ে গেলেন অফিসে। যাবার আগে ছেলেকে সব হোম ওয়ার্ক বুঝিয়ে দিয়ে গেলেন। বাবান লক্ষ্মী ছেলের মত মাথা কাত করে বুঝে নিল। ঘন্টা খানেক পরে বাবানের বাবাও দোকানে বেরিয়ে গেলেন। ব্যাস হোম ওয়ার্ক অর্ধেক করে বাবান খেলতে দৌড়াল। আজ বাবান নিজের হাতে বন্ধুদের জন্যে ছোট্ট ছোট্ট গিফট বানিয়েছে কাগজ কেটে রং করে। কোনোটা গণেশ, কোনোটা পাখি, কোনোটা মানুষের মুখ এমন আরও সুন্দর সুন্দর জিনিস। হাতে খানিকটা বিট লবণ আর গিফটের প্যাকেট নিয়ে গেটের কাছে দাঁড়ালো। একটু পরেই সবাই চলে এলো হইহই করতে করতে।
সাদেক পেয়ারা নিয়ে এসেছে অনেকগুলো। সবাই মিলে গোল হয়ে বসে মাঝখানে বিট লবন রেখে পেয়ারা খেতে খেতে গল্প শুরু করলো। আর সেই সময় বাবান ওর গিফটগুলো বের করে সবার সামনে রাখলো। সবাই গিফটগুলো নেড়েচেড়ে দেখতে লাগলো। সাদেক গণেশ টা হাতে নিয়ে বলল ‘এটা আমায় দিবি’? বাবান বললো ‘এগুলো তোদের জন্যে বানিয়েছি রে, তোদের যার যেটা পছন্দ সে সেটা নে’। ওরা মহা উৎসাহে কাগজ, আঠা আর রং দিয়ে বানানো জিনিসগুলো নিয়ে মেতে উঠলো।
আগামীকাল রফিক আর সাদেকদের বাড়িতে ঈদের উৎসব। ওরা সব বন্ধুদের ওদের বাড়ি যাবার জন্যে নেমন্ত্রণ করলো। বুধন, পেচু, লালু, রুবাই, বুবাই সবাই যাবে বললো। কিন্তু বাবান কেমন করে যাবে? কাল যে রবিবার, মা বাড়িতে থাকবে। তার ওপর বাবান কখনো একা বেরোয় না। অনেকটা বেলা হতে খেলাশেষে সবাই যে যার বাড়ি চলে গেলো। বাবান মন খারাপ করে ফিরে এলো। ঘরে এসে ডালিয়া দিদির কাছে স্নান খাওয়া করে বই নিয়ে বসলো। কারণ হোমওয়ার্ক না করলে মা বকবে। মনটা কিন্তু খারাপ হয়েই থাকলো। কিভাবে সাদেকদের বাড়ি যাওয়া যায় সেটা নিয়ে নানা রকম চিন্তা ভাবনা করতে লাগলো কিন্তু কোনো সুরাহা হলো না। অনেক ভেবে শেষে ডালিয়া দিদি কে বাবান তার মনের কথা বলেই ফেললো। কাজের মেয়ে ডালিয়া শুনেই আঁতকে উঠলো। বললো ‘ওরা ছোট ঘর তার ওপর মুসলমান, ম্যাডাম শুনলে আমাকে কাজ থেকে ছাড়িয়ে দেবে। তুমি জানো ওদের ছুঁলে স্নান করতে হয়। তোমাকে আমি নিয়ে যেতে পারবো না’। বাবানের শেষ আশাও চলে গেলো। টিভিতে কার্টুন দেখতে ইচ্ছে করলো না, হুড়োহুড়ি করতে ইচ্ছে হলো না, চুপ করে নিজের ঘর থেকে জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে রইলো।
অফিস থেকে অ্যানা ব্যানার্জি ফিরে বাবান কে দুষ্টুমি করতে না দেখে অবাক হয়ে গেলেন। বাবানকে ডেকে কোনো উত্তর পেয়ে দক্ষিণের ঘরে গিয়ে দেখেন বাবান জানালা দিয়ে তাকিয়ে আছে বাইরের দিকে। মাকে দেখে বলে উঠলো ‘মা একটা কথা বলবো? মুসলমান মানে কি’? অ্যানা ব্যানার্জি খুব অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন ‘তুমি জানলে কি করে’? সেই সময় ডালিয়া অ্যানা ব্যানার্জিকে চা দিতে এসে বললো ‘ওই রাস্তার ওপারের যে বস্তিটা আছে, সেই বস্তি থেকে কিছু বাচ্চা রোজই বাবানের সাথে খেলতে আসে। আমি বলিনি ম্যাডাম আপনাকে। ভাবতাম বাবান বাচ্চা তো, কোনো খেলার সাথি নেই, একা একা থাকে। তাই ওরা এলে ওদের সাথে একটু খেললে কিছু ক্ষতি হবে না। আজ হঠাৎ বাবান বললো, ‘আগামীকাল ওই ছেলেদের মধ্যে দুজন ছেলের বাড়িতে ঈদের উৎসব আছে। বাবানকে নাকি নেমন্ত্রণ করেছে। তাই ও আমাকে বলেছিল আমি যদি ওকে নিয়ে যাই। আমার আরও আগে আপনাকে বলা উচিৎ ছিল ম্যাডাম। ক্ষমা করবেন বলে মাটির দিকে তাকিয়ে সে নখ খুঁটতে লাগলো। অ্যানা মুখার্জি কিছু না বলে বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে।
রাত বাড়লে বাবানের বাবা তমাল ব্যানার্জি ফিরে এলো দোকান থেকে। ঘরে ঢুকে বুঝলেন পরিস্থিতি থমথমে। মনে ভাবলেন, ‘নিশ্চয় বাবান আজ হোমওয়ার্ক করেনি। কি দরকার এত ছোটো একটা বাচ্চাকে এভাবে চাপের মধ্যে রাখার? ৬ বছর বয়সে আমরা তো সবে পড়াশুনো স্টার্ট করেছিলাম। আর এখন এই বাচ্চাগুলোর চার বছর স্কুল হয়ে গেলো। কিছু বললেই অ্যানা বলবে, তোমার মত চাওয়ালা হবে পড়াশুনো না করলে। এটা বোঝে না আমার মত চাওয়ালা হতে গেলেও পড়াশুনো লাগে। সারাদিন দোকান করে বাড়ি ফিরে আবার অশান্তি ধুর ধুর।
বাবানকে কাছে ডাকলেন তমাল ব্যানার্জি। কি হয়েছে, জিজ্ঞেস করতে ছেলে তো কেঁদে একসার। ছেলেকে বোঝালেন, ‘কাল কি হবে সে দেখা যাবে, এখন তুমি খেয়ে ঘুমিয়ে পড়’।
পরদিন বাবানের ঘুম ভাঙলো বেশ বেলা করে। ততক্ষণে বাজার চলে এসেছে। বাবান মাটন খেতে ভালোবাসে, বাজার থেকে বাবানের বাবা মাটন, মিল্ক কেক আর ও প্রচুর বাজার করে এসেছেন। বাবান ভাবলো ‘এত খাবার বাবা এনেছে, অথচ আজ তার কিছু খেতে ভালো লাগছে না। তার বন্ধুরা আজ কত আনন্দ করবে। সাদেক, রফিক ওরা নতুন জামা পরবে। এটা নাকি ওদের পরব। ওদের বাড়ি না যেতে পারলে কিছুই বোঝা যাবে না। ডালিয়া দিদি বললো, ওরা নাকি মুসলমান। সেটা কি? দেখতে তো আমারই মতো। আমার মতই কথা বলে, খেলে, ভাত খায়। তাহলে কি ওরা আর আমরা আলাদা? তাই কি করে হবে? ডালিয়া দিদি একটা বোকা। কিছু জানে না। কিন্তু সাদেক তো নেমন্ত্রণ করেছে ওদের বাড়ি যাবার। মা বাবাও তো নেমন্ত্রণ খেতে যায়, আমিও অনেকবার গেছি। তাহলে সাদেক, রফিকদের বাড়ি কেনো যাওয়া যাবে না? ওদের ঘরটা ছোট বলে? বাবান আকাশ পাতাল চিন্তা করতে থাকে আর মাঝে মাঝে জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকায়। বাবানের মা আজ বলেছে দুপুর বারোটার মধ্যে খাওয়া-দাওয়া করে নিতে, তারপর তিনজনে মিলে ঘুরতে যাবে। অন্যদিন হলে মাকে বিরক্ত করে ফেলত, কোথায় যাবে জানতে চেয়ে কিন্তু আজ চুপচাপ বিছানায় শুয়ে বাবার মোবাইল দেখতে থাকলো। এগারোটা বাজতে না বাজতেই বাবানের মা তাড়া দিলো খেয়ে রেডি হয়ে নেবার জন্যে।
বাবান লক্ষ্মী ছেলের মত মনমরা হয়ে ডালিয়া দিদির কাছে সব করে নিল। তার মধ্যেই বাবানের বাবা মা তৈরি হয়ে নিল। ডালিয়া দিদিকেও সাথে নিল। তারপর গ্যারেজ থেকে বাবা গাড়ি বের করার পরে ডালিয়া দিদি অনেকগুলো ব্যাগ গাড়িতে নিয়ে তুললো। তারপর সবাই গাড়িতে বসলে বাবা গাড়ি নিয়ে রাস্তায় নেমে যেদিকে বস্তি আছে সেদিকে যেতে লাগলো। যতই বস্তির দিকে এগোয় ততই বাবানের চোখ গোল গোল হয়ে যেতে থাকে। ‘এ বাবা! এটা কোথায় নিয়ে এলো বাবা? এতো জানালা দিয়ে দেখা সেই বস্তিটা যেখানে ওর বন্ধুরা থাকে।’ কিন্তু সে কথা বলবে কি করে বাবান? ওর খুব ইচ্ছে করছে পেচু, লালু, বুধন, রফিক, সাদেকদের চিৎকার করে ডেকে বলতে ‘এই দ্যাখ আমি এসেছি’। হঠাৎ একটা ঘরের সামনে ওদের গাড়িটা থামে। বাবান গাড়ির জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখে রফিক দাঁড়িয়ে আছে। এরমধ্যে ওর মা গাড়ি থেকে নেমে পড়ে ওই ঘরটার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আর বাবানের বাবা গাড়ি থেকে নেমে এসে বাবানকে বলে, নেমে এসো বাবান, এই দেখো তোমার বন্ধুর বাড়ি। গাড়ির ভেতর বন্ধুদের জন্যে গিফট আছে, দিতে হবে তো। বাবান অবাক হয়ে বাবার দিকে তাকিয়ে থাকে। এই সময় সাদেক এসে বাবানের হাত ধরে টেনে ঘরের দিকে নিয়ে যায়। বাবান দেখলো ওর মা রফিকের বাবাকে বলছে, আপনি সেদিন না থাকলে আমার হাজব্যান্ড বেঁচে ফিরতো না। আমি কোনোদিন আপনার এই উপকার ভুলবো না। হাওড়া থেকে ফেরার পথে যখন একদল দুষ্কৃতি ওকে ঘিরে ফেলেছিল সেই সময় আপনি ওকে ভাই বলে বুকে টেনে নিয়ে ওদের হাত থেকে বাঁচিয়েছিলেন। রফিকের বাবা হাতজোড় করে বললো, ‘ভাইজানকে আমি চিনি তো, ওনার বড় চা পাতার দোকান আছে। আমার পাড়ার ভাইকে আমি কি করে ওদের হাতে ছেড়ে দেবো? ওটা আমার কর্তব্য ভাবীজান। আজকে পরবের দিনে আপনি এসেছেন মুখ মিষ্টি করে যাবেন গরীবের বাড়ি। অ্যানা ব্যানার্জি বললেন, কে বললো আপনি গরীব? আপনার একটা বড় মন আছে, যা আমাদের অনেকের নেই। আমি আজকের দিনে আমার ছেলের বন্ধুদের জন্যে কিছু গিফট নিয়ে এসেছি। বাচ্চাদের ডাকুন, আমার ছেলে নিজের হাতে ওদের গিফটগুলো দিক। এতে ওরা সবাই খুব আনন্দ করে আজকের দিনটা কাটাবে।
বাবান দৌড়ে এসে মাকে জড়িয়ে ধরলো, মা আমি রোজ ওদের সাথে খেলব? তুমি বকবে না তো? অ্যানা ব্যানার্জি বললেন, না বকবো না, কিন্তু হোমওয়ার্ক করে তবে। আর বাচ্চারা তোমাদের পড়াশুনোর কিছু দরকার পড়লে আমার কাছে চাইবে। আজ থেকে তোমরা প্রকৃত মানুষ হবার পথে এগিয়ে চলো। বাবান বললো, আচ্ছা মা ডালিয়া দিদি বলেছিল ওরা মুসলমান, ওদের সঙ্গে খেললে তুমি বকবে। তাহলে কি আজ থেকে ওরা আর মুসলমান নয়? অ্যানা ব্যানার্জি বললেন, আমরা সবাই মানুষ, কেউ হিন্দু মুসলমান নয়। তবে সব সময় ন্যায়ের পথে থাকবে, অন্যায়ের পথে নয়। যাও ওদের সাথে খেলো গিয়ে।