হাকিকুল ইসলাম খোকন, নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র প্রতিনিধি: ফুসফুসে ক্যান্সার ধরা পড়ে কয়েকটি কেমো থেরাপি নেয়ার পর গত ২৮ এপ্রিল, ২০২০ মন্টিফিউর সেন্ট লুকস কনোয়াল হাসপাতালে ফারুক আহমেদ পরলোকগম করেন। অরেঞ্জ কাউন্টি, আপস্টেট নিউইয়র্ক এ বসবাসরত ফারুক আহমেদ যে হাসপাতালে কাজ করতেন সেই হাসপাতালেই মৃতু্বরণ করেন বলে তাঁর ফুফাতো বোন জার্মানিতে বসবাসরত একুশে পদক বিজয়ী সাংবাদিক লেখক নাজমুন নেসা পিয়ারী জানান।
ফারুক আহমেদের মৃত্যুতে সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচুর লেখা-লেখি হয়। তার স্ত্রী জেসমিন আহমেদ গত ২৯ এপ্রিল, ২০২০ তার ফেসবুকে একটা স্ট্যাটাস দেয়েছিলেন। তিনি লিখেছেন, ”আগামীকাল বৃহস্পতিবার বাদ জোহর ফারুকের জানাজার সময় ঠিক করা হয়েছে | আপনারা যে যেখানে আছেন , আপনারা সবাই ওর জন্য দোআ করবেন | জানাজা এবং দোয়া হবে নিউইয়র্ক টাইম দুপুর ১টা, ঢাকা টাইম হবে রাত এগারোটা।”

নিশ্চয়ই ফারুক আহমেদের স্ত্রীর জন্য আরো অনেকের ভালোবাসা-শ্রদ্ধা, বিশেষ করে কিছুদিন আগে স্কুল জীবনের বন্ধুদের সাথে একত্রিত হওয়া যে ছিল অনেক বড় আনন্দের। এটা অনেক কষ্টের, অনেক বেদনার। করোনা আক্রান্ত সময়ে প্রতিদিন-প্রতি মুহূর্তে কিছু না কিছু হারাচ্ছে নিউইয়র্ক বাসী। এই ক্ষতি অপূরণীয়। ফারুক আহমেদের আপনজন তার সহধর্মিণীকে সমবেদনা জানিয়ে বলেন, আপনি আপনার দুই সন্তান নিয়ে শোক কাটিয়ে উঠুন। ফারুক ভাই যেখানেই থাকুন ভাল থাকবেন।
মামাতো ভাই ডা. ফারুক আহমেদ- এর মৃত্যুতে জার্মানি থেকে সাংবাদিক, লেখক এবং একুশে পদক বিজয়ী নাজমুন নেসা পিয়ারী লিখেছেন —— ফারুক — আমার মামাত ভাই ডাক্তার ফারুক প্রাণবন্ত, চির সবুজ মানুষ ছিল। বাবা মায়ের তৃতীয় সন্তান। ঢাকার পুরানা পল্টনে আমাদের বাড়ির পাশেই মামার বাড়ি ছিল, দুই বাড়ির মাঝে কোন দেয়াল ছিল না, বলা যায় আমরা এক বাড়িতেই বড় হয়েছি। আমার ভাই মাহমুদের সহপাঠী ছিল ফারুক। তারা সে সময়ে লেখাপড়ার বাইরে অন্যান্য বিষয়েও চৌকস ছিল সে। আবৃত্তি, ডিবেট, রচনা প্রতিযোগীতা ইত্যাদি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশ নিতো। যেখানেই যেতো কিছু না কিছু গল্প নিয়ে বাড়ি ফিরতো। ফারুক সেসব কথা এমন রসিয়ে বলতে পারতো যে না হেসে উপায় থাকতো না। আমার খুব ভাল লাগতো।
এবার আমি যখন ঢাকায় ছিলাম ও ছুটি কাটাতে দেশে গিয়েছিল। ওর সঙ্গে একদিন টেলিফোনে কথা হলো। বললাম “এবারও তোর সঙ্গে দেখা হলো না। নিউইয়র্কে গেলেও দেখা হয় না।” বললো, “আপা এবার এলে অবশ্যই দেখা হবে। নিউইয়র্কে পেশাগত কারণেই সপরিবারে দীর্ঘদিন থেকে বসবাস করছিল ফারুক।” মাস দেড়েক আগের কথা। অথচ এখন শত সন্ধানেও নিউইয়র্কে ওকে আর আমি খুঁজে পাব না। এ সত্য মেনে নিতে হবে! সকাল থেকেই বার্লিনের আকাশ বিষন্ন —- “রোদন ভরা”। মনকে আয়ত্তে রাখতে পারছি না। নিজেকে খুব অপদার্থ মনে হচ্ছে। এবার নানা কাজে, নানা চাপে ছিলাম — কোন কিছু গুছিয়ে করতে পারিনি। প্রিয় মানুষদের কাছে যেতে পারিনি। কেবল ছুটছি তো ছুটছিই।

আজ ফারুকের এক বন্ধু ডাক্তার আরিফুর রহমানের তিন দিন আগের ফেসবুক পোস্ট দেখলাম, আমার ভাতৃবধু বীনার এফ বি টাইম লাইনে — লেখাটা ও শেয়ার করেছে।
সে লিখেছে—-“ডাক্তার ফারুক আহমেদের ঢাকায় শান্তিনগরে “গার্ডেন ক্লিনিক ছিল। সেই সময়ে ঢাকা শহরে হাজার হাজার ক্লিনিক ছিল না। ঢাকা মেডিকেল কলেজের কে টুয়েন্টি ওয়ান ব্যাচের আড্ডা হতো হারুনের শমরিতা হাসপাতালে আর ডাক্তার ফারুকের “গার্ডেন”-এ। সারাটা জীবন বন্ধুদের ভালোবেসে অনেকের আগে আজ সকালে নিউইয়র্কের একটি হাসপাতালে ইন্তেকাল করেছে, আমাদের ফারুক। সিগারেট প্রিয় মানুষদের যা হয় তা হয়ে গেল — ফারুকের ফুসফুসের সবটাই দখল করে ফেলেছিল ওর নিজের অজান্তেই। যখন বুঝতে পেরেছে তখন গ্রেড ফোর।
আমাদের কে টুয়েন্টি ওয়ান ডাক্তারদের চার বন্ধু সহপাঠী ধূমপান জনিত রোগে ইন্তেকাল করেলো। এই সেদিন আমরা কক্সবাজারে ফারুকের উদ্ভট জোকস শুনে হো হো করে হেসেছি। আমরা এতগুলো বড় বড় ডাক্তার এক টেবিল বসে তিনদিন আড্ডা দিয়েও কেউ বুঝতে পারিনি, সন্দেহও করতে পারিনি আমাদের বন্ধু তার নিজ মৃত্যু বুকে লুকিয়ে রেখেছে। আমরাও হয়তো তাই।
সিগারেট পান জীবনকে ছোট করে দেয়, এটি শুধু অকাল মৃত্যুর সময় মানুষ অনুভব করে। ফারুকের জন্য কষ্ট হচ্ছে অনেক। কবি শহীদ কাদরী ছিলেন ফারুকের দুলাভাই। ফারুকও কবিতা লিখতো। ধ্রুপদী গান শুনতে ভালবাসতো। সহজ আর সৎ মানুষ ছিল।”———ডা. ফারুক আহমেদের মৃত্যুতে নিউইয়র্কবাসী গভীর শোক ও সমবেদনা জানিয়েছেন।