রাসেল আশেকী
পবিত্র কিতাব হাতে
এখানে জন্মাননি কেউ, মাটি মেনে নেয়নি কোনো আগন্তুক। এখানকার মানুষ টিঠুপঙ্খির মতো অন্তরপোষা। কথা শিখিয়েছে প্রকৃতি, আশ্রয় দিয়েছে নিসর্গ।
যার ভেতর দিয়ে প্রবাহিত আমার ভাষা
পূর্বপুরুষের রক্তবিন্দু থেকে উত্তর প্রজন্মের জন্মফুল অবধি, নিত্যনতুনের পথে, অপরূপ সৌন্দর্যের অলৌকিক হৃদয় প্রান্তরে, মাটির আয়নায় আবিষ্কার করে পবিত্র ভাষাভূমি।
বহুমাত্রার একই কথার অজস্র রূপ ছড়াতেই
সেই ভাষাভূমির তীর্থ থেকে কথা বলছি পৃথিবীর সাথে
যে পৃথিবীর সমান বয়সী চিরতরুণ আমার সাহসী বর্ণমালা, দীর্ঘ শ্বাস ও স্বরের অন্তরঙ্গ সুরের মাদকে
অসীম ব্রহ্মলোকে খাঁটি হতে হতে
এক একটি অক্ষরে বিস্তৃত আমার কাব্যপ্রাণ বর্ণমালা।
ভাব আদান-প্রদানে মাটির উত্তাপ থেকে উঠে আসা
ন’হন্যর মতো অগ্নি-জলে অক্ষয় সেই বর্ণমালার জন্ম
আমার জন্মের মতো, রক্ত ভেঙে রক্তের পথ ধরে সূর্যের
সাক্ষাতে দাঁড়ানো, রক্ষাও রক্তের বিনিময়ে
বিশ্বভাষার বুকে জ্বেলে মাতৃভাষার অগ্নিশিখা!
যে বর্ণমালায় ‘ হও ‘ বললেই অবিনশ্বরে হয়ে যায় মহামানবের উত্থান, ‘ না ‘ বললেই নষ্ট হয়ে যায়
জীবনের সকল কীর্তি! এমন বর্ণমালার অমৃত অক্ষরে
জন্মান মা, জন্ম দিতে সন্তানের ভবিষ্যৎ
মহাপ্রকৃতির ফুসফুসে সংযুক্ত হয়ে কথা বলছি
সেই মা’র সাথে, যে মা’র জন্য আমার এতদূর হাঁটা,
এত নিকটে আসা, এত গভীরে ঢুকে আপন আয়নায় সারাপৃথিবী দেখা।
আমদের শাসক নেতা ওলি দরবেশ গাউস কুতুব আর সন্তপথিক, যখন অস্থির অগ্নিতে গরম হয়ে উঠলেন,
মা বললেন, জ্ঞানপুত্রের ভাষাভূমি সাত আসমান ছোঁবার আগে দেখো কীভাবে কৃত্রিম হয়ে যাচ্ছে খাদ্য আর বন্ধুতা, মিথ্যার কোটর থেকে উঠে আসছে ভাসমান মানুষের দ্বীপ, মূল্যায়ন আর স্বীকৃতির কাঙাল হয়ে উঠছে মানবজাতি, বাড়ছে আভিজাত্যের ভূতবসানো ঈশ্বর কেনার উন্মাদনা!
মনে হ’ল মানুষের মূল্যহ্রাসে তুমি আমি সে হতে চলেছি
একবিন্দুতে একা এক খোলসের হাত পা!
তবু অসীম সীমায় জয় করে ভয়
জন্মপ্রেমে জীবনের ঢেউ তুলে ঢেউ ভেঙে
ঘুরঘুরে পাখি ও নদীর মতো
বুকের পাঁজর থেকে অন্তরাত্মায় গেঁথে জলের ভাষা
প্রাচীন গুহা, নতুন পথ, এগোতে এগোতে
তিরতির ছুঁই ছুঁই অমৃতার অন্ধকারে
ধরার আগুন জ্বালিয়ে পরম তৃষ্ণায় খু্ঁজলাম
মানবজাতির সেই নিখোঁজ মানুষটিকে, যার কাছে
আমার বহু জন্মের বহু কর্মের বহু আগমনের ইতিহাস জমা। আর চোখ থেকে ছুড়ে কালোপর্দার বিষ, ধুয়ে হাত, কান পেতে শুনে অনন্ত আত্মার গান
শুভ মানুষের শুভযাত্রার অবগাহনে সাথে সাথে বাউলজন্ম নিলাম। বটবৃক্ষের ন্যায় ত্রিকালদর্শী এক ঋষি ভর করল দেহে, খুলে গেল অনুভব অনুভূতি উপলব্ধির গিঁট। জেনে গেলাম, জীবনের অর্থ ছোট নয়।
নিজেকে বাঁচিয়ে রাখাই শিল্পীর কাজ, ব্যক্ত করাই মুক্তির পথ। বুঝে নিলাম, ঝুলে থাকার চেয়ে লেগে থাকা শ্রেয়, আর আত্মহত্যার বদলে সুস্থ থাকাই মা’র আদেশ মান্য করা।
আমার যখন রোদজন্ম হ’ল
মা বললেন, ভেতর থেকে কথা ক, তোর মা হবে ভাষা
আমি বললাম, তাই হোক।
আমার যখন বৃষ্টিজন্ম হ’ল
মা বললেন, মাটি কামড়ে পড়ে থাক, তোর মা হবে মাটি
আমি বললাম, তাই হোক।
যখন আমার বৃক্ষজন্ম হ’ল
মা বললেন, দুর্ভোগে বীর হয়ে দাঁড়া, তোর মা হবে দেশ
আমি বললাম, তাই হোক।
যখন আমার কবিজন্ম হ’ল
মা বললেন, সব দেহে প্রাণ দে, তোর মা হবে পৃথিবী
আমি বললাম, তাই হোক।
এভাবে যতবার জন্ম নেব ততবার বলব
এখনও বলি, মা আমার দশমুখী দরজার অঢেল আলোর ঘর, আর অনন্ত কাব্যের অফুরন্ত ভাষাভূমি।
জানি কোনোদিন শোধানো যাবে না মাতৃঋণ
জানি বারবার নিতে হবে জন্ম, বারবার আসতে হবে প্রকৃতির পাঠশালায়, উজান-ভাটির বাতাসে বাতাসে… পালতোলা নৌকা, গীতিময় পালকি, দরদি কুটুমবাড়ির হাওয়াই পথে, আবিষ্কার করে মিলনের নতুন পথ।
মনে পড়ে, অর্ধমানুষ অর্ধপশু তাড়ানো রাখালের মতো
নদী ও বায়ুপোষা শক্ত সুঠাম গর্দানসীন সেই অক্ষয় মাঝির কথা!
যাঁর যাদুময় কণ্ঠের থেরাপিতে,সত্যেশ্বর প্রাণেস্মরে জাগতো মাটি, নামতো আকাশ, মানুষের ময়দানে
স্বাধীনতার মাঠে। আমরা থাকতাম প্রবাহে প্রাণবন্ত, উৎসবে পঞ্চমুখ।
কিন্তু মৃত আত্মার কিছু জীব তাকে হত্যা করে রাখল পূজার বেদিতে, বসাল দেবতার আসনে!
তারাও ছাই-ভস্ম হয়ে উড়ে গেল চিরমৃত্যুর কাফনে!
ভালোবাসা ফিরে গেল স্বর্গে, নেমে এলো নরকের যন্ত্রণা
বিষবৃক্ষের ছায়াতলে! কেউ দেখল, কেউ দেখল না, কেউবা আসন গাড়লো সিংহাসনের লোভে!
আর মনভাঙা মনমরা মানুষের দৃশ্য দেখতে দেখতে
আবেগভরা নারী ও মায়াকুমারীর মতো কান্নারত চোখে
নদী ও মাঠগুলো আরেকজন মাঝির আগমনের দিনক্ষণ গুনতে লাগল…
আমি বললাম, মাঠবেষ্টিত নদীসকল শোনো-
আবর্জনাস্তূপ থেকে বেরিয়ে দেখো, এসে গেছে সেই
রাখাল, সেই মাঝি।
ওরা মুগ্ধশ্রোতার মতো আমার কথা শুনল
এবং তাই হোক, তাই হোক বলে স্রোত ঘুরিয়ে দিলো
মহাস্রোতের দিকে, মহাগর্জনে বেরিয়ে এলো মানবদরিয়া।
আর আমার আত্মাস্মরের টানে উপবিষ্ট বালক-বালিকা
সারি সারি গাবগাছ হয়ে ড্যাবড্যাবে চোখে
হা-করে তাকিয়ে থাকল আমার দিকে।
কেউবা নকল রাখাল সেজে অনুসরণ করতে লাগল
আমার ভাষা ও কথার পোশাকসহ গোপন আলোর হাত।
আমি দিব্যচোখে দেখলাম, ভাষার হৃৎপিণ্ড থেকে
জন্ম নেয়া একটি মহাপ্রভাবের কুদরতি।
আরো দেখলাম, একটি জ্যোতির্ময় রক্তপিণ্ডের ভাব থেকে জন্ম নেয়া ভাষার পঞ্চভূতব্যাপী পরিভ্রমণের সময় অপরূপ দৃশ্যাবলির সে কী আশ্চর্য লীলা, যা
প্রাকৃতিক সব আশ্চর্য অতিক্রম করে নিজেই এক মহাশ্চর্য।
বিনম্র চিত্তে পৃথিবীর চোখ আমার দিকে তুলে ধরল সেই ভাষার মুকুট। বললাম, পূর্ণ হোক পিতার ইচ্ছা মায়ের আশীর্বাদ।
বুঝলাম, জীবন বৃথা নয়, বর্ণাঢ্য তার আয়োজন
বুঝলাম, একা নই ভবসংসারে, আমার সাথে
কথা বলছে আমার দেশ আমার পৃথিবী
কণ্ঠে তুলে অন্তরের ভাষাভূমি।
বলি, পৃথিবী আমার ঘরে আমি পৃথিবীর কোলে
পৃথিবী হাঁটে আমার পায়ে, আমি ঘুরি পৃথিবীর সাথে
একসাথে চলি একসাথে ঘুরি মানুষের ঘরে ঘরে
ভয় নাই মুক্তি নিশ্চিত স্বাধীনতার মাঠে।
(লেখক: কবি, সাংবাদিক, গণমাধ্যম গবেষক ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব)