মো: আশরাফুল আলম মাসুদ
শুধু ব্রিটেনেই নয় বর্তমান বিশ্বেই সবচেয়ে বিতর্কিত রাজনীতিবিদ হলেন ব্রিটেনের নয়া প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন। বিতর্কিত ছাড়াও বাচনভঙ্গি, শব্দের ক্ষুরধার ব্যবহার, চাহনি, মজা করে কথাবলার অসামান্য দক্ষতা, এলোমেলো চুল, ব্যক্তিগত জীবন প্রভৃতি কারণে বরিস জনসন অনেকের চেয়ে ব্যতিক্রমও বটে। ব্রেক্সিট ইস্যুতে ব্রিটেনকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বের করে আনার ক্ষেত্রে তিনি জোর প্রচারণা চালিয়েছিলেন। ঘটনাক্রমে তিনি ব্রিটেনের কনজারভেটিভ পার্টির নেতা নির্বাচিত হয়ে গত জুলাই মাসে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। প্রবাস মেলা’র নিয়মিত আয়োজন ফ্যাক্ট এবাউটের এবারের পর্ব বরিস জনসনের আদ্যোপান্ত নিয়ে প্রতিবেদন।
জন্ম পরিচয় ও শিশুকাল: আলেকজান্ডার বরিস ডি প্যাফেল জনসন (Alexander Boris de Pfeffel Johnson) ১৯ জুন ১৯৬৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরে উচ্চ-মধ্যবিত্ত এক ব্রিটিশ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা স্ট্যানলি জনসন ছিলেন ক‚টনীতিক। কনজারভেটিভ পার্টির হয়ে তিনি ইউরোপীয় সংসদের সদস্যও হয়েছিলেন। মাতা শার্লট ফচেট একজন চিত্রশিল্পী ছিলেন। চার ভাইবোনের মধ্যে সবার বড় জনসনের শৈশব কেটেছে নিউইয়র্ক, লন্ডন ও ব্রাসেলসে।
শিক্ষা: বরিস জনসন ইউরোপীয়ান স্কুল অফ ব্রাসেলস, অ্যাশাডাউন হাউস স্কুল এবং অভিজাত ইটন কলেজে পড়াশোনা করেন। পরে তিনি অক্সফোর্ডের বেলিওল কলেজে ল্যাটিন ও প্রাচীন গ্রিক ক্ল্যাসিকসে পড়াশোনার সময় ১৯৮৬ সালে অক্সফোর্ড ইউনিয়নের সভাপতি নির্বাচিত হন।
রাজনীতিতে পদার্পণ: ১৯৯৭ সালে ক্লয়েড সাউথ এলাকা থেকে হাউস অব কমন্সে নির্বাচন করেন জনসন। এরপর ২০০১ সালে তৎকালীন বিরোধী কনজারভেটিভ দলের মনোনয়ন নিয়ে হেনলির সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তবে তিনি কখনো ছায়ামন্ত্রী সভার জন্য বিবেচিত হন নি। দলের কয়েকজন সিনিয়র নেতা তাকে তেমন পছন্দ করতেন না। ২০০৮ সালে জনসন সংসদের রাজনীতি ছেড়ে কনজারভেটিভ দলের সমর্থনে লন্ডনের মেয়র নির্বাচিত হন। ২০১২ সালে দ্বিতীয় মেয়াদে তিনি লন্ডনের মেয়র নির্বাচিত হন। তার দ্বিতীয় শাসনামলেই ২০১২ এর লন্ডন অলিম্পিক অনুষ্ঠিত হয়। মূলত তখনই ব্রিটেনের রাজনীতিতে এক ভিন্ন মাত্রা তৈরি করেন বরিস জনসন। এরপর ২০১৫ সালে বরিস আক্সব্রিজ ও সাউথ রাইস্লিপের আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে পুনরায় সংসদীয় রাজনীতিতে ফিরে আসেন এবং পরের বছর লন্ডনের মেয়র পদ ছেড়ে দেন।
ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত: ছোটবেলায় পুরো পৃথিবীর রাজা হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন বরিস জনসন। ৫৫ বছর বছর বয়সে তিনি ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। অথচ এর একবছর আগেও তার সবচেয়ে কট্টর সমর্থকরাও নিশ্চয়ই ভাবেন নি তিনি প্রধানমন্ত্রী হবেন, কিন্তু তিনি তাই অর্জন করে দেখালেন।
ব্রেক্সিট ইস্যুতে সমঝোতায় পৌছাতে ব্যর্থ হয়ে গত মে মাসে পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে। ব্রেক্সিট চুক্তিতে সংসদের অনুমোদন পেতে বার বার ব্যর্থ হওয়ার পর চাপের মুখে থেরেসা মে যখন দলের নেতৃত্ব ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত জানান, প্রধানমন্ত্রী হওয়ার নতুন সুযোগ লুফে নেন বরিস জনসন।
এরপর ৭ জুন যুক্তরাজ্যের ক্ষমতাসীন দলের নেতার পদ থেকে থেরেসার সরে দাঁড়ানোর পর নতুন নেতা নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় ১৩ জুন থেকে শুরু হয়ে ২২ জুন পর্যন্ত চার দফার ভোটের প্রায় সবগুলোতেই এগিয়ে দলটির নেতা নির্বাচিত হন থেরেসা মে সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বরিস জনসন। দেশটির রীতি অনুযায়ী ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষ নেতা হিসেবে বরিস জনসন ২৪ জুলাই ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন।
প্রধানমন্ত্রীত্ব নিয়ে সংশয়: বরিস জনসন ইতিমধ্যেই নানাভাবে বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন। তিনি অভিবাসন বিরোধিতায় কট্টর অবস্থান নিয়েছেন। সেই চিন্তাভাবনা থেকেই তিনি ব্রেক্সিটের পক্ষে আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন। ৩১ অক্টোবরের মধ্যে প্রয়োজনে কোনো চুক্তি ছাড়াই ব্রিটেনকে ইইউ জোট থেকে বের করে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়ে কনজারভেটিভ পার্টির ব্রেক্সিটপন্থী শিবিরের প্রিয়পাত্র হয়ে ওঠেন বর্তমান এই প্রধানমন্ত্রী। তবে ব্রেক্সিট নিয়ে নিজের দল এবং গোটা দেশের রাজনীতিতে যে বিভেদ ও মতানৈক্য চলছে, তাতে এই সময়ের মধ্যে তিনি ব্রিটেনকে ইইউ থেকে বের করে আনতে পারবেন কিনা, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।
যদি না পারেন, বরিস জনসনের প্রধানমন্ত্রীত্বের মেয়াদ খুবই সংক্ষিপ্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আগামী ২০২০ সালের জুলাই মাস পর্যন্ত তিনি ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী থাকবেন তা নিয়ে অনেক বাঘা বাঘা রাজনৈতিক বিশ্লেষকও সন্দেহ প্রকাশ করেছেন।
অহমিকা আর ব্যক্তিত্বে মোড়া রাজনীতিবিদ: মিডিয়া ও রাজনৈতিক অঙ্গনে বেশ পরিচিত হলেও জনসনের রাজনৈতিক উত্থান খুব একটা কুস্তুমাকীর্ণ ছিলনা। এক সাংবাদিকের সঙ্গে প্রেমের গুঞ্জনে তাকে ছায়া মন্ত্রী সভা থেকে সরিয়ে দেয়া হয়েছিল। ১৯৮৭ সালে অ্যালেগ্রা মস্টিনকে বিয়ে করলেও তাদের সংসার অল্প সময়ে ভেঙ্গে যায়। পরে ১৯৯৩ সালে আইনজীবী মেরিনা হুইলারের সঙ্গে গাটছাড়া বাঁধেন। দুই যুগ পর তাদের সংসারও আর টেকেনি। এরপর গত বছর থেকে বিয়ে না করেই বসবাস করছেন তার থেকে প্রায় ২৫ বছরের ছোটো ক্যারি সিমন্ডস নামে এক বান্ধবীর সাথে। ফলে বরিস জনসন এবং ক্যারি সিমন্ডস হচ্ছেন ১০ ডাউনিং স্ট্রিটে অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের প্রথম অবিবাহিত দম্পতি।
সাংবাদিক বরিস জনসন: বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকিয়ে বের হবার পর পেশা হিসাবে সাংবাদিকতাকে বেছে নিয়েছিলেন ব্রিটেনের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী। দ্য টাইমস ম্যাগাজিনের প্রতিবেদক হিসেবে যোগ দেয়ার মাধ্যমে সাংবাদিকতায় তার পেশাজীবন শুরু হয়, যদিও একটি মনগড়া উদ্ধৃতি ব্যবহারের জন্য পরে তিনি সে চাকরি হারান। পরবর্তীতে জনসন দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফের ব্রাসেলস প্রতিনিধি হিসেবে চাকরি শুরু করেন। ডেইলি টেলিগ্রাফের চাকরিরত সময়ে তার লেখা ব্রিটিশ ডানপন্থীদের মধ্যে ইউরোপ নিয়ে সংশয়বাদের ধ্যান-ধারণা বিস্তারে প্রভাবশালী ভ‚মিকা রাখেন । ১৯৯৪ সালে তিনি ডেইলি টেলিগ্রাফের সহকারী সম্পাদক পদে উন্নীত হন। এরপর তিনি টেলিগ্রাফের চাকরি ছেড়ে দ্য স্পেক্টেটরে যোগ দেন। ১৯৯৯ সাল থেকে তিনি এই ম্যাগাজিনের সম্পাদক হিসেবে ২০০৫ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন।
লেখালেখি: লেখালেখিতেও জনসনের হাত যথেষ্ট পাকা। ‘লেন্ড মি ইউর ইয়ারস’ প্রবন্ধ ছাড়াও তার লেখা উপন্যাস ‘সেভেন্টি টু ভার্জিনস’ রোমান সাম্রাজ্যের ইতিহাস নিয়ে লেখা ‘দ্য ড্রিম অব রোম’ ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এছাড়াও ২০১৪ সালে জনসনের লেখা সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল কে নিয়ে ‘দ্য চার্চিল ফ্যাক্টর: হাউ ওয়ান ম্যান মেইড হিস্টরি বইটির জনপ্রিয়তাও তার ঝুলিতে রয়েছে।
মুসলিম হেরিটেজ: বরিস জনসনের প্র-পিতামহ অর্থাৎ তার দাদার বাবার নাম ছিল আলী কেমাল। তিনি ধর্মনিরপেক্ষ মুসলমান ছিলেন। পিতার দিক থেকে তিনি ইংরেজি ও ফরাসী বংশোদ্ভূত। বাবার সূত্রে তার বংশের ইতিহাস জানতে স্বজনদের সাথে দেখা করতে বরিস জনসন একবার তুরস্কে গিয়ে বেশ কিছুদিন ছিলেন। এ কারণে নিজেকে মুসলিম উত্তরাধীকারী হিসেবে বলে থাকেন। তবে সম্প্রতি বোরকা পরা নারীদের নিয়ে তার এক কটু মন্তব্যের পর তাকে মুসলিম বিদ্বেষী হিসেবে অনেক গালমন্দ শুনতে হয়েছে।
অজানা গন্তব্যে যুক্তরাজ্য: বরিস জনসন ৩১ অক্টোবরের মধ্যে ইইউ’র সঙ্গে ব্রিটেনের বিচ্ছেদ ঘটাতে বদ্ধপরিকর। কিন্তু এই সময়ের মধ্যে তিনি যাতে চুক্তিহীন ব্রেক্সিট সম্পন্ন করতে না পারেন সেজন্য পার্লামেন্টে একটি আইন পাস করে তার হাত-পা বেধে দেয়া হয়েছে। তাছাড়া ৩১ অক্টোবর ২০১৯ এর মধ্যে যুক্তরাজ্য চুক্তিহীন বেক্সিট এর মাধ্যমে ইইউ থেকে বিচ্ছিন্ন হলে দেশজুড়ে খাদ্য ও জ্বালানি সংকটসহ অরাজক পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে বলে আশংকা করা হচ্ছে।