তানিজা খানম জেরিন, নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র: আজ সোমবার আটই মার্চ জাতিসংঘ অন্তর্ভূক্তে সকল দেশেই বর্তমান করোনা সঙ্কটের মধ্যেই মহাসাড়ম্বরে বিভিন্ন কর্মসূচীর মাধ্যমে আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালিত হচ্ছে। ১৯৯৬ সন থেকে প্রতি বছরই জাতিসংঘ একটি প্রতিপাদ্য বিষয় নির্বাচন করে। যদিও গত পঁচিশ বছরের কোন প্রতিপাদ্য বিষয়ই বিশ্বব্যাপী শতভাগ সাফল্য অর্জন করতে পারেনি। এমন কি কোন প্রতিপাদ্য বিষয় দেশ ভেদে সাফল্য অর্জনের হার মাত্র পাঁচ থেকে বাইশ ভাগ। অন্যদিকে জাতিসংঘের অনেক বছরের প্রতিপাদ্য বিষয় উন্নত দেশগুলিতে অনেকক্ষেত্রে পূর্বেই পূর্ণভাবে অর্জিত থাকে অপরদিকে স্বল্পোন্নত দেশগুলিতে দুই দশকেও বিশ ভাগের বেশি লক্ষ্য অর্জন করতে পারেনি। এমন কি জাতিসংঘ কর্তৃক ঘোষিত কোন প্রতিপাদ্য বিষয় সব দেশের নারীদের জন্য সমানভাবে বাস্তবায়নের প্রশ্ন অবান্তর। বিশ্বের প্রতিটি দেশেই নারীদের সমস্যার ভিন্নতা রয়েছে তাই সমস্যার আলোকে সমাধানের পথ খুঁজতে হবে।
প্রতি বছরই বিশ্বের প্রতিটি দেশেই বিভিন্ন আয়োজনে ৮ই মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস উদযাপন করা হয় এবং গত আড়াই দশক ধরে জাতিসংঘ ঘোষিত একটি প্রতিপাদ্য বিষয় নির্ধারিত থাকে কিন্তু বাস্তবে উপরোক্ত প্রতিপাদ্য বিষয়টি সঠিক প্রয়োগ ও বাস্তবায়নে কোন সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নেওয়া হয়না। যার পরিপ্রেক্ষিতে গত সাড়ে চার দশক অর্থাৎ ১৯৭৫ সনে জাতিসংঘ স্বীকৃত আন্তর্জাতিক নারী দিবস শ্লোগানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে; অবশ্যই নারীদের উন্নয়ন দেশভেদে অনেক সফলতা অর্জন করেছে। বিশেষ করে বিশ্বের উন্নত দেশগুলি নারীদের সমান অধিকার অর্জনে এবং অন্যান্য আরো কিছু সূচকে ষাট/ সত্তর ভাগ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সক্ষম হয়েছে। চরম সত্য হলো অনুন্নত এবং স্বল্পোন্নত দেশগুলি নারীদের সমান অধিকার অর্জনে মাত্র দশ থেকে বিশ ভাগ সফলতা অর্জনে সক্ষম হয়েছে যদিও অনুন্নত কয়েকটি দেশে নারীর ক্ষমতায়ন প্রায় ত্রিশ/চল্লিশ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। অপরদিকে জাতিসংঘ কর্তৃক ঘোষিত নারী দিবস ঘোষণার সাড়ে চার দশক পরে গত ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহেই নাইজেরিয়াতে একটি সন্ত্রাসীচক্র তিনশত সতেরজন কিশোররীকে অপহরণ করে নিয়ে যায়। উল্লেখ্য ১৯০৯ সনে ঘোষিত ক্ষমতায়ন, সমতা ও সম-অধিকার দাবী আদায়ের লক্ষ্যে বিশ্বে যে নারী দিবস আন্দোলন শুরু হয়েছিল গত এগারো দশকে মাত্র সিকি ভাগ অর্জিত হয়েছে। দিবস পালন প্লেকার্ড ব্যানার নিয়ে রাস্তা প্রদক্ষিণ জাতিসংঘ কতৃর্ক প্রতিবছরই একটি প্রতিপাদ্য বিষয় নির্ধারণ এমন নামকাওয়াস্তে কর্মসূচী থাকলে আগামী ২০০/৩০০ বছরেও নারীর ক্ষমতায়ন, সমতা ও সম-অধিকার আদায়ে বাস্তবায়ন হবে বলে আমি সন্ধিহান।
জাতিসংঘ ঘোষিত গত সাড়ে চার দশকেও স্বল্পোন্নত এবং উন্নয়শীল দেশগুলিতে নারীদের মজুরি বৈষম্য দূর হয়নি অর্থাৎ মজুরি বৈষম্যের দাবীতে এগার দশক আগে যে নারী আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল তা শত বছরেও মৌলিক দাবী আদায় পূর্ণ হয়নি। উল্লেখ্য উপরোক্ত ক্যাটাগরির দেশ গুলিতে কর্মে নারীদের নিয়োগের ক্ষেত্রে পূর্বেও বৈষম্য ছিল বর্তমানেও আছে। নারীরা বিশ্বে গত শতকের প্রথম থেকেই ভোটাধিকার প্রয়োগ ও নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে নির্বাচিত হয়ে রাষ্ট্র পরিচালনায় অন্তর্ভূক্ত হয়েছে। অপরপক্ষে সৌদি আরবে সৌদি বাদশা ২০১১ সনের ফরমান অনুযায়ী ২০১৫ সনে সৌদি নারীরা পৌর নির্বাচনে জীবনের প্রথম ভোটটি দিতে পেরেছেন। বর্তমান বিশ্বে অতিমারি করোনা সঙ্কটকালেও এগারোজন নারীনেত্রী দেশ পরিচায়নায় রয়েছেন এবং পঁচিশটির বেশি দেশে সরকার প্রধান বা রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে দ্বায়িত্ব পালন করছেন। বর্তমান বিশ্বে তিরিশটির মতো দেশে নারী কর্মজীবি প্রায় পঞ্চাশ ভাগ, মধ্যপ্রাচ্যের দেশ কুয়েতে নারী কর্মজীবির সংখ্যা তিপ্পান্ন শতাংশ। মেক্সিকোর সাম্প্রতিক নির্বাচনে দেশটির পার্লামেন্টে দুটি কক্ষেই সমান সংখ্যায় নারী ও পুরুষ এমপিরা নির্বাচিত হয়েছে যে ঘটনা একটি “বড় মাইলফলক” হিসেবে দেখা হচ্ছে। স্পেন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে রূপান্তরের পর এই প্রথম দেশটির মন্ত্রিসভায় পুরুষদের চেয়ে বেশি সংখ্যায় নারীদের মনোনীত করা হয়েছে গত জুন মাসে।
উনবিংশ শতাব্দীর ষাটের দশকে শ্রীলংকার প্রধানমন্ত্রী শ্রীমাভো বন্দর নায়েকের পথ অনুসরণ করে বিশ্বের অনেক দেশেই প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী, চ্যান্সেলর নারী ক্ষমতায়নের অগ্রযাত্রায় সামিল হয়েছেল। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ইতিহাস সৃষ্টিকারী নারী নেতৃত্বের মধ্যে রয়েছে আর্জেন্টিনার ইসাবেলা পেরন, ভারতের ইন্দিরাগান্ধী, ইসরাইলের গোল্ডামায়ার, গ্রেটবৃটেনের মার্গারেট থেচার এবং তেরেসা মে, জার্মানের চ্যান্সেলর আঙ্গেলা মেকেল, শ্রীলঙ্কার চন্দ্রিকা কুমারাতুঙ্গা, পাকিস্তানের বে-নজীর ভূট্টো, বাংলাদেশের বেগম খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনা ওয়াজেদ, ইন্দোনেশিয়ার মেঘবতী সুকর্ণ পুত্রী। আরো উল্লেখ্য বিশ্বের অনেক দেশেই নারী ভোটাধিকার পেতে দেরী হয়েছে। বিশ্বে সর্ব প্রথম নিউজিল্যাণ্ডের নারীরা ১৮৯৩ সালে ভোটাধিকার লাভ করেন। বর্তমান শতাব্দীতে নারীর ক্ষমতায়নের ভরা মৌসুমেও অনেক দেশেই নারীদের সম-অধিকারের দাবীতে সোচ্চার থাকতে হচ্ছে; এই বিশ্ব ভ্রমাণ্ডে নারীরা সকল ক্ষেত্রেই আত্মমর্যাদার সাথে লড়াই করে এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো বিশ্বে অনেক দেশেই নারীর ক্ষমতায়নতো দূরের কথা বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তেই নারীরা আজও নির্যাতিত, বঞ্চিত, লাঞ্ছিত, নিপীড়িত ও অত্যাচারিত হচ্ছে। সম-অধিকারের লড়াইয়ে নারীদের ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তেই নারীদেরকে সুসংগঠিত হয়ে সম-অধিকারের আন্দোলন সংগ্রাম অব্যাহত রাখতে হবে। আমরা আমেরিকানবাসী হিসেবে অবশ্যই গর্বিত যে আমরা একজন নির্বাচিত ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে কমলা হ্যারিসকে পেয়ে গর্ববোধ করছি। আশা করি গণতন্ত্রের প্রবক্তা হিসেবে আমেরিকা আগামী দশকে অবশ্যই একজন নারী প্রেসিডেন্ট পাওয়ার ইতিহাস গড়বে। কমলা হ্যারিস যে আশার আলো প্রজ্জ্বলন করেছে বিশেষ করে এশিয়ান বংশোদ্ভূত আমেরিকান নারীরাও সেই পথ অনুসরণ করে বিশ্ব দরবারে রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসীন হয়ে বিশ্বে নারীদের মুখ উজ্জ্বল করবে। একবিংশ শতাব্দীতে নারীর ক্ষমতায়ন, সমতা, সম-অধিকার সমভাবে প্রতিষ্ঠিত করার লড়াইয়ে নতুন প্রজন্ম আরো সোচ্চার ও বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখবে এই আশাবাদ সর্বক্ষণ। আগামী প্রজন্মের নারীদের প্রতি আমার আহ্বান নারীদের সমস্যা দ্রুত চিহ্নিত করে তা আশু সমাধানের লক্ষ্যে নারী আন্দোলনে যার যার অবস্থান থেকে অধিকার আদায়ে সোচ্চার হোন। নারী-দের সম-অধিকার, সমতা, ক্ষমতায়ন আদায়ে আন্দোলন অব্যাহত থাকবে; শুভ হোক আন্তর্জাতিক নারী দিবস।