ইসরাত জেবিন
জেসিন্ডা আরডার্ন (Jacinda Ardern) বর্তমানে বিশ্বের পরিচিত এবং জনপ্রিয় একটি নাম। বর্তমানে সবাই তাকে মানবতার মূর্ত প্রতীক হিসেবে গ্রহণ করেছে। এই মুহূর্তে সারা বিশ্বে শ্রদ্ধার সাথে উচ্চারিত হচ্ছে জেসিন্ডা আরডার্ন এর নাম। নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী থেকে তিনি এখন পরিণত হয়েছেন বিশ্বকে শান্তির পথে নেতৃত্ব দেয়ার দূত হিসেবে। নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চের দুটি মসজিদে সন্ত্রাসী হামলার পরে তার বিভিন্ন পদক্ষেপ প্রশংসিত হয়েছে সারা বিশ্বে। শুধু শোকাহত মুসলিম জনগোষ্ঠীর কাছে নয় পৃথিবীতে প্রতিটি মানবতাবাদী শান্তিপ্রিয় মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছেন তিনি। হিংসা-বিদ্বেষ উগ্র ধর্মান্ধতাকে যখন সারা বিশ্বের বড় বড় নেতারা রাজনীতির হাতিয়ার বানিয়েছে তখন একজন জেসিন্ডা বিপরীত স্রোতে দাঁড়িয়ে মানবিকতার দীক্ষাগুরু হয়ে উঠেছেন।
জন্ম ও পড়াশোনা: ১৯৮০ সালের ২৬ জুলাই জন্ম নেয়া আরডার্ন এর বেড়ে ওঠা মুরুপাড়া নামে নিউজিল্যান্ডের মাউরি আদিবাসী অধ্যুষিত একটি ছোট শহরে। যেখানে শিশুদের পায়ে দেয়ার মতো জুতা ছিল না, এমনকি দুপুরে তারা খাবারও পেত না। এই ঘটনাই তাকে রাজনীতিতে উদ্বুদ্ধ করে। উচ্চ মাধ্যমিক শেষে তিনি পড়াশোনা করেন যোগাযোগ বিদ্যায়। তার আগে ১৭ বছর বয়সেই যুক্ত হন নিউজিল্যান্ডের লেবার পার্টির রাজনীতিতে। তিনি নিজেকে বলেন একজন সমাজবাদী গণতন্ত্রী বা সোশাল ডেমোক্র্যাট ও প্রগতিশীল হিসেবে।
![](http://www.probash-mela.com/wp-content/uploads/2019/04/222222222-1024x260.jpg)
তিনি একজন ‘অজ্ঞেয়বাদী’ বা এ্যাগনস্টিক – যারা ঈশ্বর আছেন কি নেই তা জানতে চান না বা এ নিয়ে মাথা ঘামান না। তবে তিনি বড় হয়েছেন মরমোন খ্রিস্টান হিসেবে। তবে সমকামিতা সম্পর্কে চাচের্র ধারণার সাথে একমত হতে না পেরে তিনি তা ত্যাগ করেছেন।
পারিবারিক জীবন: টিভি উপস্থাপক ক্লার্ক গেফোর্ডকে সঙ্গী হিসেবে বেছে নিয়েছেন জেসিন্ডা। ২০১৮ সালের ২২ জুন বেনজির ভুট্টোর পর বিশ্বের দ্বিতীয় প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্বকালে সন্তানের জন্ম দেন আরডার্ন। বিশ্বে প্রথমবার কোনো প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনের কক্ষে সন্তান নিয়ে বক্তৃতা দিতে যান। জেসিন্ডা আরডার্ন বিশ্বের প্রথম সরকার প্রধান যিনি জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে তার শিশুসন্তানকে নিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি সন্তান জন্মের পর ৬ সপ্তাহের মাতৃত্বকালীন ছুটি নিয়েছেন, প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পার্লামেন্টে শিশুকে স্তন্যপান করিয়েছেন।
![](http://www.probash-mela.com/wp-content/uploads/2019/04/2-3-1024x576.jpg)
রাজনীতির পাঠ: স্নাতক শেষ করে আরডার্ন নিউজিল্যান্ডের লেবার পাটির্র একজন সংসদ সদস্যের অধীনে গবেষক হিসেবে কাজ করেন। ২০০৮ সালে তিনি লেবার পার্টির সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচনে অংশ নিয়েও ১৩,০০০ ভোটে হেরে যান। কিন্তু দেশটির সংবিধানিক নিয়মে তিনি সংসদে যাওয়ার সুযোগ পান। ২৮ বছর বয়সে সর্বকনিষ্ঠ রাজনীতিবিদ হিসেবে জায়গা করে নেন হাউস অফ রিপ্রেজেন্টেটিভে।
জেসিডামেনিয়া: ২০১৭ সালে লেবার পার্টির উপ প্রধান নির্বাচিত হন আরডার্ন। নির্বাচনের দু’মাস আগে দলটির প্রধান পদত্যাগ করলে সেই ভারও চাপে তার কাঁধে। নির্বাচনী প্রচারে তরুণদের কাছে ব্যাপক জনপ্রিয় হন আরডার্ন। তাকে নিয়ে এসময় দেশটিতে জনপ্রিয়তার যে ঢেউ উঠে, তা পরিচিতি পায় ‘জেসিডামেনিয়া’ নামে।
সবচেয়ে কম বয়সী প্রধানমন্ত্রী: মাত্র দু’মাসের নেতৃত্বে অনেকটা অপ্রত্যাশিতভাই দলকে নির্বাচনে বিজয়ী করেন জেসিন্ডা আরডার্ন। ২০১৭ সালে ৩৭ বছর বয়সে বিশ্বের সর্বকনিষ্ঠ নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেন। নিউজিল্যান্ডের ১৫০ বছরের ইতিহাসেও তিনি সবচেয়ে কম বয়সি সরকার প্রধান।
![](http://www.probash-mela.com/wp-content/uploads/2019/04/jacinda-clarke-750x1024.jpg)
বিশ্ব মিডিয়ায় স্বীকৃতি: ২০১৮ সালে ‘ফোর্বসের পাওয়ার উইমেনের’ তালিকায় জায়গা করে নেন জেসিন্ডা আরর্ডান। ছিলেন টাইম ম্যাগাজিনে সবচেয়ে প্রভাবশালী ১০০ ব্যক্তির তালিকাতেও।
ক্রাইস্টচার্চে হামলা ও জেসিন্ডা আরডার্ন: ক্রাইস্টচার্চে নির্বিচারে গুলি চালিয়ে ৫০ জনকে হত্যার পর জেসিন্ডা আরডার্নকে নতুন করে চেনে বিশ্ব। এই ঘটনার অভিযুক্তকে কোনো কার্পণ্য না করেই সন্ত্রাসী ও জঙ্গি হিসেবে অভিহিত করেন তিনি।
জেসিন্ডা আরডার্ন মসজিদে আক্রমণের পর প্রথম সংবাদ সম্মেলনেই বলেছিলেন, “স্পষ্টতই একে এখন একটি সন্ত্রাসী আক্রমণ হিসেবেই শুধু বর্ণনা করা যেতে পারে। “
সেই আক্রমণে যারা নিহত হন-তারা ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, মিসর, জর্ডান, সোমালিয়া – এরকম নানা দেশ থেকে আসা অভিবাসী। কিন্তু আক্রমণের কয়েক ঘন্টা পরই জেসিন্ডা বলেন, ‘যারা নিহত হয়েছে তারা আমরাই’ এবং তিনি শুধু যে নিউজিল্যান্ডের লোকদের উদ্দেশ্যেই এ কথা বলছিলেন তা নয়।
বিশ্লেষকরা বলেন, ব্রাজিল, চীন, হাঙ্গেরি, ভারত বা তুরস্ক এমন অনেক দেশ আছে যেখানে নেতারা এক সম্প্রদায়কে আরেকটির বিরুদ্ধে লাগিয়ে দেন। কিন্তু জেসিন্ডা যখন বললেন ‘দে আর আস’ তখন বিভেদ নয়, ঐক্যের ডাক দিয়েছেন।
এ ঘটনার পর দ্রুত অস্ত্র আইন পরিবর্তনেরও ঘোষণা দেন জেসিন্ডা। মুসলমানদের উদ্দেশ্যে জানান, নিউজিল্যান্ড মোটেও এমনটা নয়। এই দেশে তারা স্বাধীনভাবেই থাকতে পারবে। ক্রাইস্টচাচের্র ঘটনার পর নিহতদের স্বজনদের কাছে তিনি যেভাবে সমবেদনা জানিয়েছেন তা সকলের কাছেই প্রশংসা পেয়েছে। তিনি তাদের জড়িয়ে ধরছেন, সমব্যাথী হয়েছেন। শুধু তাই নয়, মুসলমানদের সাথে একাত্মতার প্রকাশ হিসেবে তিনি একাধিক দিন হিজাব পরে বেরিয়েছেন। ১৯ মার্চ সংসদে বক্তব্য দেয়ার শুরুতেই সবাইকে ‘আসসালামু আলাইকুম’ বলে সম্বোধন করেন। তিনি ক্রাইস্টচার্চের ঘটনায় অভিযুক্তের নাম কখনও মুখে আনবেন না বলে জানান। মুসলিম কমিউনিটির সাথে এক সাক্ষাতে তিনি হামলাকারী সম্পর্কে বলেন, তিনি সন্ত্রাসী হামলা চালিয়ে অনেক কিছু করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তিনি কুখ্যাত। এ জন্য আপনারা কখনোই আমার মুখে তাঁর কথা শুনবেন না।
![](http://www.probash-mela.com/wp-content/uploads/2019/04/new-zealand-pm-jacinda-ardern-signs-national-condolence-book-for-christchurch-mosque-shooting-victim_675174_.jpg)
বিশ্ব সংবাদ বিশ্লেষকদের কাছে আরডার্ন: মিজ আরডার্নের প্রথম বক্তব্যের সূত্র ধরে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানের পর্যবেক্ষকরা তার নেতৃত্বের প্রশংসা করেছেন। ব্রিটিশ পত্রিকা গার্ডিয়ানে সুজানে মুর লিখেছেন “মার্টিন লুথার কিং বলেছেন সত্যিকারের নেতারা ঐক্য খোঁজে না তারাই ঐক্য তৈরি করে, আরডার্ন ভিন্ন ধরনের ঐক্য তৈরি, কর্ম, অভিভাবকত্ব ও একতার প্রদর্শন করেছেন। “
“সন্ত্রাসবাদ মানুষের মাঝে ভিন্নতাকে দেখে এবং বিনাশ ঘটায়। আরডার্ন ভিন্নতা দেখেছেন এবং তাকে সম্মান করতে চাইছেন, তাকে আলিঙ্গণ করছেন এবং তার সাথে যুক্ত হতে চাইছেন। “
ওয়াশিংটন পোস্টের ঈশান থারুর লিখেছেন যে, “আরডার্ন তার জাতির শোক এবং দুঃখ এবং তা নিরসনের প্রতিমূর্তি হয়ে উঠেছেন।”
এবিসি অস্ট্রেলিয়া ওয়েবসাইটে অ্যানাবেল ক্র্যাব লেখেন, “একজন নেতার জন্য ভয়াবহ বাজে খবরের মুখোমুখি হওয়ার পর… মিজ আরডার্ন এখনো পর্যন্ত কোনও ভুল পদক্ষেপ নেননি।”
গ্রেস ব্যাক এক বাক্যে ম্যারি ক্লেয়ার অস্ট্রেলিয়াতে যেটা লিখেছেন: “একজন নেতা এমনই হয়ে থাকেন”।