ইসরাত জেবিন
গত বছরের জুনে রাশিয়ায় অনুষ্ঠিত ফিফা বিশ্বকাপে টুকটাক খবর রেখেছেন কিন্তু ক্রোয়েশিয়ার দলের দ্বাদশ খেলোয়ার হিসেবে পরিচিতি পাওয়া কোলিন্দা গ্রাবার কিতারোভিচ এর নাম শুনেননি এমন ফুটবলভক্ত খোঁজে পাওয়া নিশ্চয়ই দু:স্কর হবে। বিশ্বকাপে ক্রোয়েশিয়ার প্রতি ম্যাচেই সুন্দরী এই নারী প্রেসিডেন্টের ঝলমলে উপস্থিতি দেখা গেছে। কোয়ার্টার ফাইনাল শেষে তো লুকা মডরিচদের অভিনন্দন জানাতে কিতারোভিচ চলে গিয়েছিলেন খেলোয়ারদের ড্রেসিংরুমেও। ২০১৮ সালের বিশ্বকাপ ফুটবলে তার অসাধারণ স্পোর্টসম্যানশীপ আর ঝলমলে উপস্থিতি জয় করে নিয়েছেল লাখো ফুটবল ভক্তের হৃদয়। কে এই কোলিন্দা গ্রাবার কিতারোভিচ? দেশে-বিদেশে আলোড়ন তুলা ক্রোয়েশিয়ার বর্তমান প্রেসিডেন্ট কোলিন্দা গ্রাবার কিতারোভিচ কে নিয়ে প্রবাস মেলা’র এবারে ফ্যাক্ট এবাউট এর আয়োজন।
কে এই নারী?
কোলিন্দা গ্রাবারের জন্ম ১৯৬৮ সালের ২৯ এপ্রিল ক্রোয়েশিয়ার রিজিক এলাকায়। তখন ক্রোয়েশিয়া, সার্বিয়া, মন্টেনিগ্রো, স্লোভানিয়া, মেসিডোনিয়া আর বসনিয়া ও হার্জেগোভিনা মিলে ছিল যুগোস্লাভিয়া রাষ্ট্র। নব্বই এর দশকে একে একে চারটি যুদ্ধের মাধ্যমে ক্রোয়েশিয়া, মেসিডোনিয়া, বসনিয়া ও হার্জেগোভিনা আর স্লোভেনিয়া স্বাধীন হয়ে যায়। বাবা ব্রংকো গ্রাবার এবং মা দুব্রভকা গ্রাবার সাথে রিজিকার দক্ষিণে লাপাসা গ্রামে বেড়ে উঠা কোলিন্দার পারিবারিক আয়ের উৎস ছিল কসাইয়ের দোকান এবং খামার। ছোট থেকেই বেশ মেধাবী কোলিন্দা ১৭ বছর বয়সে স্কুল এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রামের আওতায় যুক্তরাষ্ট্রে যান। সেখানে নিউ মেক্সিকোর লস আলামোস শহরের ‘লস আলামোস হাই স্কুল’ থেকে তিনি হাইস্কুল পাশ করেন। ব্যক্তি জীবনে ১৯৯৬ সালে তিনি জ্যাকব কিতারোভিচ কে বিয়ে করেন। রাজনৈতিক এই নেত্রী দুই সন্তানের জননী। তার মেয়ে ক্যাটরিনার (জন্ম ২৩, ২০০১) আর ছেলে লোকা (জন্ম ২০০৩)।
উচ্চশিক্ষা
হাইস্কুলের পাঠ চুকিয়ে আবার ক্রোয়েশিয়ায় ফিরে আসেন কোলিন্দা। ভর্তি হন দেশের সনবেয়ে পুরানো বিশ্ববিদ্যালয় “ইউনিভার্সিটি অফ জাগরেব”। ১৯৯৩ সালে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের মানবিক ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ থেকে ইংরেজি এবং স্প্যানিশ ভাষা ও সাহিত্যে গ্রাজুয়েশন করেন। এরপর ১৯৯৫-১৯৯৬ সালে অস্ট্রিয়ার ডিপ্লোম্যাটিক একাডেমি অফ ভিয়েনা থেকে ডিপ্লোামা কোর্স শেষ করে ২০০০ সালে “ইউনিভার্সিটি অফ জাগরেব” এর রাজনৈতিক বিজ্ঞান অনুষদ থেকে “আন্তর্জাতিক সম্পর্ক” বিষয়ে মাস্টার্স করেন।
এছাড়াও ফুল ব্রাইট স্কলারশিপে পড়াশুনা করার সুযোগ পান জর্জ ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটিতে। হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির জন এফ. কেনেডি স্কুল অফ গভর্নমেন্টের ফেলোশিপ প্রোগ্রামেও ছিলেন তিনি। তাছাড়া ভিজিটিং স্কলার ছিলেন জন্স হপকিন্স ইউনিভার্সিটির স্কুল অফ অ্যাডভান্সড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের। তবে এখানেই শেষ নয় সদা হাস্যোজ্জল এই নারীর শিক্ষাজীবন। ২০১৫ সালে তিনি ডক্টরাল ডিগ্রীর জন্য আবার যোগ দেন “ইউনিভার্সিটি অফ জাগরেব” এর রাজনৈতিক বিজ্ঞান অনুষদে। কোলিন্দা গ্রাবার ইংরেজি, স্প্যানিশ ও পর্তুগীজ ভাষায় দুরন্ত। এছাড়াও জার্মান, ফ্রেঞ্চ ও ইতালিয়ান ভাষাও তিনি বুঝতে পারেন।
গুরুত্বপূর্ণ পদে কোলিন্দা গ্রাবার কিতারোভিচ
২০১৫ সাল থেকে ক্রোয়েশিয়ার প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করা কোলিন্দা গ্রাবার কিতারোভিচ মূলত একজন কূটনৈতিক। ক্রোয়েশিয়া রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের আগে, প্রশাসনে এবং কূটনৈতিক অঙ্গণে অনেক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন কোলিন্দা গ্রাবার। এর মধ্যে ছিল পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উত্তর আমেরিকার বিভাগের প্রধানের দায়িত্ব; কানাডায় ক্রোয়েশীয় দূতাবাসে ডিপ্লোম্যাটিক কাউন্সিলর এবং মিনিস্টার-কাউন্সিলর। ইউরোপীয় ইন্টিগ্রেশন মন্ত্রী, পররাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইন্টিগ্রেশন মন্ত্রী, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ক্রোয়েশিয়ার রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব এবং ন্যাটো’র সহকারী মহাসচিব এর দায়িত্ব পালন করেছেন কোলিন্দা গ্রাবার কিতারোভিট।
রাজনীতিতে কোলিন্দা গ্রাবার পদার্পণ
১৯৯৩ সালে কোলিন্দা গ্রাবার যোগ দেন রাজনৈতিক দল ক্রোয়েশিয়ান ডেমোক্রেটিক ইউনিয়ন (এইচডিজেড)-এ। ২০০৩ সালে তিনি তার রাজনৈতিক দল ক্রোয়েশিয়ান ডেমোক্রেটিক ইউনিয়নের মনোনয়নে সংসদ নির্বাচিত হন।
পরের নির্বাচনে জিতে ক্ষমতায় থেকে যায় ক্রোয়েশিয়া ইউরোপীয় ইউনিয়ন। কেবিনেটে আবার জায়গা হয় কোলিন্দা গ্রাবার-কিতারোভিচের। কিন্তু ২০০৮ সালে তাকে ‘অজানা কারণে’ কেবিনেট থেকে অপসারণ করা হয়। তবে সেই বছরই তৎকালীন প্রেসিডেন্ট তাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ক্রোয়েশিয়ার রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব দেন।
২০১১ সালে রাষ্ট্রদূতের পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে ন্যাটো’র সহকারী মহাসচিবের দায়িত্ব নেন। প্রধানমন্ত্রীকে না জানিয়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রপতির পদ থেকে ইস্তফা দেয়ায় সমালোচন মুখে পড়েন তিনি। তার এমন সিদ্ধান্তের জন্য ৯ মাস ফাঁকা ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ক্রোয়েশিয়ার রাষ্ট্রদূতের পদ। ন্যাটোতে থাকাকালেই কোলিন্দা গ্রাবার যুক্তরাষ্ট্রের খ্যাতনামা ব্যবসায়ী (রাজনীতিবিদ) ডেভিড রকিফেলোর প্রতিষ্ঠিত ‘ট্রাইলেটারাল কমিশন’-এর সদস্য মনোনীত হন। আমেরিকার বৈশ্বিক প্রাধান্য (হেজিমনি) তৈরি এবং ৯/১১ পরবর্তী পরিস্থিতি সৃষ্টির অন্যতম কারিগর এই ‘ট্রাইলেটারাল কমিশন’। ন্যাটো এবং ‘ট্রাইলেটারাল কমিশন’-এ কাজের অভিজ্ঞতা কোলিন্দা গ্রাবারকে মার্কিন এস্টাবলিশমেন্টের খুব কাছে নিয়ে এসেছিল। সমালোচকদের মতে, এই সম্পর্ক তাকে ক্রোশিয়ার প্রেসিডেন্ট হতে সহায়তা করে। বাড়তে থাকে তার রাজনৈতিক জনপ্রিয়তা। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৫ সালে ক্রোয়েশিয়ার প্রথম মহিলা প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন বর্তমান বিশে^র সবচেয়ে আবেদনময়ী এই প্রেসিডেন্ট।
বিশ্বকাপ ফুটবল ২০১৮ ও কোলিন্দা গ্রাবার কিতারোভিচ
২০১৮ সালের ফুটবল বিশ্বকাপে ক্রোয়েশিয়ার প্রতি ম্যাচেই দেখা গেছে এই নারী প্রেসিডেন্টের ঝলমলে উপস্থিতি। ক্রোয়েশিয়ার সব ম্যাচে যে কোনো উত্তেজনার পরই ক্যামেরা তাক করে দেখতো এই আবেদনময়ী প্রেসিডেন্টের দিকেই। শুধু মাঠে ভাত্রেনি (ক্রোয়েশিয়া ফুটবল দলের ডাকনাম। মানে রূপকথার বালক!) কে সমর্থন করাই নয়, ফুটবলারদের অনুপ্রেরণা দিতে ড্রেসিংরুমেও হাজির ছিলেন এই ‘হটেস্ট’ প্রেসিডেন্ট। এমনকি জয়ের পর প্রত্যেক ফুটবলারকে জড়িয়ে ধরার ছবিও আলোচনায় ছিল কিছু দিন। একজন প্রেসিডেন্ট হিসেবে ভিভিআইপি বক্সে খেলা দেখা নিয়ে সেসময় তার বক্তব্য ছিল, ‘আসলে ভিভিআইপি বক্সে বসে খেলা দেখলে প্রথাগত পোশাক পরতে হয়। দলের হয়ে গলা ফাটাতেও সমস্যা হয়, তাই স্টেডিয়ামে বসেই খেলাটা উপভোগ করতে চাই আমি।’
ফুটবল কেন্দ্রিক কূটনীতিতে কালিন্দা গ্রাবার কিতারোভিচ
রাশিয়ায় গিয়ে কোলিন্দা গ্রাবার-কিতরোভিচ কূটনীতি যতটুকুই করেছেন, সেটিও ফুটবলকেন্দ্রিক। পুতিন ছাড়াও ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে’কে উপহার দিয়েছেন ক্রোয়েশিয়ার জার্সি। বিশ্বকাপের মাঝে অনুষ্ঠিত ন্যাটোর সম্মেলনে গিয়ে জার্সি উপহার দিয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্পকে। ভ্লাদিমির পুতিনকেও জার্সি উপহার দেন ক্রোয়েশিয়ার প্রেসিডেন্ট কোলিন্দা গ্রাবার-কিতরোভিচ।
বিশ্বকাপে ক্রোয়েশিয়ার সমর্থক বেড়েছিল
রাশিয়া বিশ্বকাপে ক্রোয়েশিয়ার প্রচুর ভক্ত ও সমর্থক তৈরি হয়েছিল এই নারী প্রেসিডেন্টের জন্যই। ফাইনালের দিন সেটা বাংলাদেশেও কিছুটা আঁচ করা গেছে। ফাইনালে বাংলাদেশে অধিকাংশ ফুটবলভক্তরা জিনেদিন জিদানের দেশ ফ্রান্সকে সাফোর্ট করলেও একেবারেই অপরিচিত (অন্তত বিশ্বকাপ ফুটবলমঞ্চে) ক্রোয়েশিয়ার সাফোর্টারও কোন অংশে খুব একটা কম ছিলনা। তাছাড়া ফাইনালে তাঁর উপস্থিতি যেন আলো ছড়িয়েছিল গোটা ম্যাচে। ফ্রান্সের কাছে ক্রোয়েশিয়ার ৪-২ গোলে হারার পরও একটুও মলিন হয়নি তাঁর হাসি। বৃষ্টি মাথায় পুরস্কার বিতরণী মঞ্চে দাঁড়িয়ে তিনি যখন খেলোয়াড়দের সান্তনা দিচ্ছিলেন তখন বিশ্ব যেন দেখছিল সৌহার্দ্যের সুবাস ছড়িয়ে দেয়া এক সত্যিকারের নেতাকে। বৃটিশ সংবাদ মাধ্যম ‘দ্য সান’ তখন জানিয়েছিল- ১৯৯৮ সালে ক্রোয়েশিয়া প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ খেলতে এসেই চমক সৃষ্টি করে তারা যেমন তৃতীয় হয়েছিল। এবার তাদের ৫ম বারের মতো বিশ্বকাপ খেলা। ফাইনালে ফ্রান্সের কাছে হেরে গেলেও তাদের খেলার স্টাইল ও আক্রমণাত্মক ফুটবলের কারণে গোটা বিশ্বে তাদের সমর্থক তৈরি হয়েছে। তবে এবারের বিশ্বকাপে মডরিচদের নৈপুণ্য ছাড়াও তাদের প্রেসিডেন্টের ফুটবলপ্রীতির কারণে ক্রোয়েশিয়ার সমর্থন বেড়েছিল।
মিথ্যা গুজব
বিশ্বকাপের সময়জুরে ইন্টারনেটে ঘুরছিল এক নারীর কিছু খোলামেলা ছবি। দাবি করা হচ্ছিল এগুলো কোলিন্দার ছবি। তবে পরবর্তীতে ক্রোয়েশিয়ান ওয়েবসাইট থেকে জানানো হয় দেখতে কিছুটা কোলিন্দার মত হলেও এই ছবিগুলো আসলে তাঁর নয় এবং এই সংক্রান্ত সব খবরও ছিল মিথ্যা।
সুন্দর চেহারার আড়ালে
যুক্তরাষ্ট্রে ক্রোয়েশিয়ার রাষ্ট্রদূত পালন করা কালিন্দা গ্রাবার কিতারোভিচ দেশটির দক্ষিণপন্থী ক্রোয়েশিয়া ডেমোক্রেটিক ইউনিয়নের (‘এইচডিজেড’ নামে পরিচিত) সদস্য। এইচডিজেড গড়েছিলেন কমিউনিস্ট যুগাস্লোভিয়া ভাঙার অন্যতম কারিগর ফ্রানজো ট্রডাম্যান। যে কারণে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধবিরোধী মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারের খুব প্রিয় ছিলেন তিনি। সেই এইচডিজেডের আজকের নেতা হলেন কোলিন্দা। কিন্তু এইচডিজেডের ভাবাদর্শের রয়েছে কুৎসিত এক অতীত।
আজকের ফুটবলপ্রেমী কোলিন্দা গ্রাবার যে এইচডিজেড দল করেন, সেটা সে দেশের ফ্যাসিবাদী ‘উসতাসা’ আন্দোলনের বর্তমান উত্তরাধিকারী। ১৯২৯ থেকে ১৯৪৫ পর্যন্ত এরাই হাজার হাজার ভিন্নমতাবলম্বীকে হত্যা করেছিল। ক্রোয়েট ‘বিশুদ্ধতা’ রক্ষা করতে ‘উসতাসা’ সদস্যরা গণহত্যাকেও সমর্থন করত। যে গণহত্যার টার্গেট ছিল যুগাস্লোভিয়ার সার্ব, ইহুদি, মুসলমান এবং রোমা জিপসিরা। ১৯৪১-৪৫ সময়ে এরা হিটলার ও নাত্সীদের অন্যতম সহযোগী ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানি ও ইতালির যুদ্ধজোটেও ছিল তারা। আজকের ক্রোয়েট ফুটবল উত্তেজনায় মিশে আছে সেই রক্তাক্ত অতীত। এখনো ক্রোয়েট ফুটবল দর্শকেরা উত্তেজনার বশে স্লোগান দেয়: ‘ফর দ্য হোমল্যান্ড- রেডি!’ যা ছিল উসতাসা আন্দোলনের শপথ।