হ্যাপি রহমান, সিডনি, অস্ট্রেলিয়া: ৮ জানুয়ারি ২০১৯ প্রায় একদশক আগে এমনি কোন এক গ্রীষ্মকালে অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে প্রথম পৌঁছেছিলাম সপরিবারে। গন্তব্য শহর থেকে গ্রামে। কিন্তু প্রকৃত অর্থে এশিয়ার দক্ষিণ-পূর্বে ওশেনিয়া অঞ্চলে অবস্থিত এ মহাদেশটি এতটাই উন্নত যে – এখানে চিরচেনা ‘গ্রাম’ এর দেখা মেলা ভার !
অত্যাধুনিক সুযোগ-সুবিধার সর্বোচ্চ ব্যবহার করে প্রতি শহরতলী থেকে শহর গড়ে তোলা হয়েছে। গ্রাম বা শহুরে জীবনযাপনে আহমরি তফাৎ চোখে পড়ে না এদেশে । নতুন আগুন্তুক হিসেবে আমি যা দেখতাম, তাতেই মুগ্ধ হতাম ! তবুও দিন শেষে কোথায় যেন অতৃপ্তি ! ছোট্ট যে শহরে আমি ছিলাম, আশেপাশে কোন বাঙালি ছিলোনা। মাইল খানেক দূরত্বে কয়েকটি বাংলাদেশি পরিবার বাস করতো । মাঝেমধ্যে দেখা হতো। একেবারেই ছোট পরিসরে আয়োজন হতো দেশীয় উৎসব-পার্বনের। ওখান থেকে বানিজ্যিক নগরী সিডনির দূরত্ব পাঁচশত মাইল।
অস্ট্রেলিয়ায় সবচে বেশী বাংলাদেশিদের বসবাস সিডনিতে । বৃহৎ পরিসরে বিস্তৃত বাঙালি কমিউনিটি । কমিউনিটি প্রকাশিত বিভিন্ন সংবাদপত্র ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জানতে পারি বাংলাদেশিদের উদ্যোগ-অংশগ্রহণে নানান সাংস্কৃতিক-সামাজিক কর্মকান্ড । সেসব আমাকে আপ্লুত করতো তখন ! গভীরভাবে উপলদ্ধি করতাম—একটি জাতির আত্মপরিচয়ের বহিঃপ্রকাশের প্রধান মাধ্যম তার মাতৃভাষায়। প্রবাসে আমাদের সন্তানরা আধো বাংলা-ইংরেজী মিশ্রনে কথা বলে। কতটা শ্রুতিমাধুর্য সে হিসাব বড়ই গড়মিলে ! শংকিত হই এই ভেবে, যে—তৃতীয়-চতুর্থ বা পরের প্রজন্ম গল্পের ছলে না বলে বেড়ায়, ‘আমাদের পূর্বপুরুষদের ভাষা ছিল বাংলা ! এবং একদা আমরা বাঙালি ছিলাম’ !
হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কন্ঠে একটি গান খুব শোনা হতো তখন, “মুছে যাওয়া দিনগুলি আমায় যে পিছু ডাকে । স্মৃতি যেন আমার এ হৃদয়ে বেদনার রঙ্গে রঙ্গে ছবি আঁকে”। পরবর্তীতে সিডনিতে স্থায়ী বসবাস শুরু । সিডনি বাঙালি কমিউনিটি’তে নিজেকে সম্পৃক্ত করা । এবং এরইমধ্যে কমিউনিটির বিভিন্ন কাজে যথাসাধ্য সহযোগিতা করে যাচ্ছি, যাবো। গত এক দশকে একজন প্রবাসী হিসেবে আমি দেখছি, বাংলাদেশিরা পৃথিবীর যে প্রান্তেই বসবাস করছেন, অবধারিতভাবেই সেখানে তৈরি হচ্ছে বিভিন্ন সংগঠন-প্রতিষ্ঠান । শুধুমাত্র বিদেশে থেকে দেশীয় রাজনৈতিক কোন্দল-দলাদলির ঘটনা-রটনার বাইরে অন্যান্য কর্মকান্ড প্রশংসনীয় । যেমন – জাতীয় দিবস উদযাপন, উৎসব-পার্বণ ও দেশজ সংস্কৃতির চর্চা-প্রসার । তাই বিদেশ-বিভূঁইয়ে নবপ্রজন্মের মধ্যে নিজ মাতৃভাষা ও সংস্কৃতির চর্চা ও প্রসারে সাংগঠনিক ভূমিকাকে অস্বীকার করা উচিত নয়। বলাবাহুল্য, প্রায় পঞ্চাশ/ষাট দশকের সিডনি বাঙালি কমিউনিটি এখন অনেক বেশী বিস্তৃত ! সাংস্কৃতিক বিস্তৃতি হয়েছে সবচে বেশী ।
সম্প্রতি সংযোজন হয়েছে মঞ্চ নাটক । মঞ্চ নাটক এর আগেও প্রদর্শিত হয়েছে সিডনির মঞ্চে । তবে, গত কয়েক মাসে পরপর প্রদর্শিত হয়েছে ভিন্ন সংগঠন আয়োজিত মঞ্চ নাটক—দর্শক চাহিদার কারনে কোনটি দ্বিতীয়, তৃতীয়বারও মঞ্চস্থ হয়েছে । প্রতিটি প্রদর্শণীই ছিলো দর্শক মুখর, এবং অবশ্যই তা টিকেট ক্রয় করে। ভাবতেই ভালো লাগে, ঢাকার নাটক পাড়া বেইলি রোড হতে যাচ্ছে সিডনিতে । সর্বশেষ আমি সপরিবারে দেখতে গিয়েছিলাম ‘রিফিউজি বিভ্রাট’ ।
অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে মঞ্চায়িত এ নাটকটির পটভূমি রচিত হয়েছে, সমুদ্রপথে দেশটিতে আসা শরণার্থীদের নিয়ে—শরণার্থী বা রিফিউজিদের হাসি-কান্না, ফেলে আসা স্মৃতি, স্বপ্ন-স্বপ্নভঙ্গের কাহিনী নিয়েই গড়ে উঠেছে নাটকটি । নাটকটি লিখেছেন অস্ট্রেলিয়াপ্রবাসী বাংলাদেশি নাট্যকার বেলাল হোসেন ঢালী। রচনা ও নির্দেশনা দিয়েছেন তিনি ।
গত ২৩ ডিসেম্বর’ ২০১৮ সিডনির ব্যাংকস টাউনের ব্রায়ান ব্রাউন থিয়েটারে নাটকটি মঞ্চস্থ হয়। ইন্দোনেশিয়া থেকে সমুদ্রপথে ট্রলারে করে অস্ট্রেলিয়ায় আসা একদল শরণার্থীর কর্মকান্ড ফুটিয়ে তুলেছেন অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে বসবাসরত স্থানীয় বাংলাদেশি শিল্পীবৃন্দ । সমুদ্রযাত্রা ও বেআইনিভাবে অস্ট্রেলিয়া প্রবেশের গল্প নিয়ে নির্মিত হয়েছে নাটকটি। নাটকটিতে অভিনয় করেছেন, মো. আবদুল কাইয়ুম, ফজলুল হক শফিক, রহমত উল্লাহ, নুরে আলম লিটন, হাবিবুর রহমান হাবিব, কামরুল ইসলাম, আমেনা আক্তার সাগর, মেরিনা জাহান, মো. মাসুদুর রহমান প্রমুখ।
প্রসঙ্গত, এর আগে সিডনিতে বেলাল হোসেন ঢালীর রচনায় ও নির্দেশনায় সিটিজেন, আদমখানা ও বিদ্রোহী নাটক মঞ্চায়নের পর দর্শকদের প্রশংসা কুড়িয়েছে। বেলাল ঢালী’কে ধন্যবাদ সত্য ঘটনা অবলম্বনে রচিত জীবন যুদ্ধের গল্প তুলে ধরার জন্য । ব্যক্তিগতভাবে আমার সুস্পষ্ট কোন ধারণাই ছিলো না, রিফিউজি বা শরণার্থীদের সম্পর্কে । ঘটনা প্রবাহে হাস্যরসাত্মক সংলাপগুলো কঠিন জীবন সংগ্রাম সহজ করে তুলেছে । দর্শকদের নজর কাড়তে সক্ষম হয়েছে । মঞ্চসজ্জায় ছিলেন পরিচিত মুখ লরেন্স ব্যারেল । সব কিছু মিলিয়েই পরিচ্ছন্ন ছিলো নাটকটি । বিনোদনের মাধ্যমে কমিউনিটি-সমাজে যদি ম্যাসেজ দেয়া যায়, সেটা গুরুত্ব বহন করে । এ নাটকটির মাধ্যমে অভিবাসন সম্পর্কে স্পষ্ট ধারনা পাবে শরণার্থীরা । এছাড়াও আমার ব্যক্তিগত অভিমত, সংগঠন-আয়োজক-উদ্যোক্তা সকলের সহযোগিতায় অন্যান্য শাখায় ও সংযোজন হোক সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের, সেই সাথে চর্চা হোক দেশীয় ভাষার।
বাঙালি কমিউনিটি প্রভাব রাখুক মাল্টিকালচারাল এ মহাদেশটি’তে । শুভকামনা নাটকটির পরিচালক, কলাকুশলী ও সংশ্লিষ্ট সকলের জন্য । বিভ্রাটের কবল থেকে মুক্ত হোক রিফিউজিদের ।