ডাঃ মাহফুজা বেগম স্নিগ্ধা, সালালাহ্, ওমান
নুহাইজা এবং নুমাইর দু’ভাইবোন। তারা ওমানপ্রবাসী। প্রতিবছর মার্চের স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানের পর পরই মা তাদের নতুন আয়োজনে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। নুহাইজাকে নাচ শিখানো-গান করানো, নুমাইরকে বাংলা ছড়া শেখানো। কার্ড বোর্ড কেটে পেঁচা, বাঘ, ময়নার ছবি আঁকানো আর- “এসো হে বৈশাখ-এসো, এসো” গানের চর্চা চলে।
আশপাশের অনেক ছোট ছোট বন্ধুরাতো আছেই, তাদের পরিবার-পরিজনেরাও তাদের বাসায় নিজ নিজ সংস্কৃতি চর্চায় ব্যস্ত হয়ে ওঠে। এসবকিছুই বাংলা নতুন বছরকে বরণ করে নেবার জন্য প্রস্তুতি। খুব যত্ন নিয়ে প্রতিবছর এই প্রাণের উৎসবে মেতে উঠে তারা।
এবার তাদের সাথে দেশ থেকে আসা দাদা-দাদীও আছে নতুন বছরের শুরুতে। এবারের নতুন বছরটা তাই দাদার মুখে নববর্ষের ইতিকথা দিয়ে শুরু হতে যাচ্ছে।
প্রতিবছর ১৪ এপ্রিল, বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন হিসাবে পালন করা হয়ে থাকে। শুধু বাংলাদেশ নয়, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ এবং ত্রিপুরাতেও ঘটা করে বাংলা পঞ্জিকার প্রথম দিনটিতে আনন্দ আয়োজন করা হয়।
গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জি অনুসারে বাংলাদেশে প্রতি বছর ১৪ এপ্রিল এই উৎসব পালিত হয়। বাংলা একাডেমী কর্তৃক নির্ধারিত আধুনিক বাংলা পঞ্জিকা অনুসারে এই দিন নির্দিষ্ট করা হয়েছে।
পশ্চিমবঙ্গে চান্দ্রসৌর বাংলা পঞ্জিকা অনুসারে ১৪ এপ্রিল অথবা ১৫ এপ্রিল পহেলা বৈশাখ পালিত হয়। এছাড়াও দিনটি বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গে সরকারি ছুটির দিন হিসেবে গৃহীত। ব্যবসায়ীরা দিনটি নতুনভাবে ব্যবসা শুরু করার উপলক্ষ হিসেবে বরণ করে নেয়।
ঐতিহ্যগতভাবে সূর্যোদয় থেকে বাংলা দিন গণনার রীতি থাকলেও ১৪০২ সালের ১ বৈশাখ থেকে বাংলা একাডেমী এই নিয়ম বাতিল করে আন্তর্জাতিক রীতির সাথে সামঞ্জস্য রাখতে রাত ১২.০০ টায় দিন গণনা শুরুর নিয়ম চালু করে।
সৌর পঞ্জিকা অনুসারে বাংলা বার মাস অনেককাল আগে থেকেই পালিত হতো। এই সৌর পঞ্জিকার শুরু হতো গ্রেগরীয় পঞ্জিকায় এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময় হতে। সৌর বছরের প্রথম দিন আসাম, বঙ্গ, কেরালা, মনিপুর, নেপাল, উড়িষ্যা, পাঞ্জাব, তামিল নাড়ু এবং ত্রিপুরার সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে অনেক আগে থেকেই পালিত হত।
এখন যেমন নববর্ষ নতুন বছরের সূচনার নিমিত্তে পালিত একটি সর্বজনীন উৎসবে পরিণত হয়েছে, একসময় এমনটি ছিল না। তখন নববর্ষ বা পহেলা বৈশাখ ঋতুধর্মী উৎসব হিসেবে পালিত হত। তখন এর মূল তাৎপর্য ছিল কৃষিকাজ, কারণ প্রাযুক্তিক প্রয়োগের যুগ শুরু না হওয়া পর্যন্ত কৃষকদের ঋতুর উপরই নির্ভর করতে হতো।
আকবরের সময়কাল থেকেই পহেলা বৈশাখ উদযাপন শুরু হয়। তখন প্রত্যেককে বাংলা চৈত্র মাসের শেষ দিনের মধ্যে সকল খাজনা, মাশুল ও শুল্ক পরিশোধ করতে বাধ্য করা হতো।
ভারতবর্ষে মুঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পর সম্রাটরা হিজরী পঞ্জিকা অনুসারে কৃষি পণ্যের খাজনা আদায় করত। কিন্তু হিজরি সন চাঁদের উপর নির্ভরশীল হওয়ায় ফসল উৎপাদনের সাথে অসামঞ্জস্যতা তৈরী হতো। কিন্তু কৃষকদেরকে খাজনা পরিশোধ করতে বাধ্য করা হতো ঠিকই।

খাজনা আদায়ে সুষ্ঠুতা প্রণয়নের লক্ষ্যে মুঘল সম্রাট আকবর বাংলা সনের প্রবর্তন করেন। তিনি মূলত প্রাচীন বর্ষপঞ্জিতে সংস্কার আনার আদেশ দেন। সম্রাটের আদেশ মতে তৎকালীন বাংলার বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও চিন্তাবিদ ফতেহউল্লাহ সিরাজি সৌর সন এবং আরবি হিজরী সনের উপর ভিত্তি করে নতুন বাংলা সনের নিয়ম বিনির্মাণ করেন।
১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দের ১০ মার্চ বা ১১ মার্চ থেকে বাংলা সন গণনা শুরু হয়। তবে এই গণনা পদ্ধতি কার্যকর করা হয় আকবরের সিংহাসন আরোহণের সময়ে। প্রথমে এই সনের নাম ছিল ফসলি সন, পরে “বঙ্গাব্দ” বা বাংলা বর্ষ নামে পরিচিত।
পহেলা বৈশাখে ভূমির মালিকরা নিজ নিজ অঞ্চলের অধিবাসীদেরকে মিষ্টান্ন দ্বারা আপ্যায়ণ করতেন। এ উপলক্ষে বিভিন্ন উৎসবের আয়োজন করা হত। এই উৎসবটি একটি সামাজিক অনুষ্ঠানে পরিণত হয় যার রূপ পরিবর্তন হয়ে বর্তমানে এই পর্যায়ে এসেছে। তখনকার সময় এই দিনের প্রধান ঘটনা ছিল একটি হালখাতা তৈরি করা।
হালখাতা বলতে একটি নতুন হিসাব বই বোঝানো হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে হালখাতা হল বাংলা সনের প্রথম দিনে দোকানপাটের হিসাব আনুষ্ঠানিকভাবে হালনাগাদ করার প্রক্রিয়া। গ্রাম, শহর বা বাণিজ্যিক এলাকা, সকল স্থানেই পুরনো বছরের হিসাব বই বন্ধ করে নতুন হিসাব বই খোলা হয়। হালখাতার দিনে দোকানদাররা তাদের ক্রেতাদের মিষ্টান্ন দিয়ে আপ্যায়ণ করে থাকে। এই প্রথাটি এখনও অনেকাংশে প্রচলিত আছে, বিশেষত স্বর্ণের দোকানে।
আধুনিক নববর্ষ উদযাপনের খবর প্রথম পাওয়া যায় ১৯১৭ সালে, ১৯৩৭ সালে এবং তৎপরবর্তী ১৯৬৭ সনের পূর্বে ঘটা করে পহেলা বৈশাখ পালনের রীতি তেমন একটা জনপ্রিয় হয়নি।
বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকার প্রধান ৩টি আদিবাসী সমাজেও ঘটা করে বর্ষবরণ উৎসব উদযাপন করা হয়। এটি তাদের প্রধান সামাজিক অনুষ্ঠানগুলোর একটি। এ উৎসবটি ত্রিপুরাদের কাছে বৈসুব, বৈসু বা বাইসু, মারমাদের কাছে সাংগ্রাই এবং চাকমা ও তঞ্চঙ্গ্যাদের কাছে বিজু নামে পরিচিত।
‘বৈসাবি’ নামকরণটাও করা হয়েছে এই তিনটি উৎসবের এর প্রথম অক্ষর গুলো নিয়ে। বৈ শব্দটি ত্রিপুরাদের বৈসু থেকে, সা শব্দটি মারমাদের সাংগ্রাই থেকে এবং বি শব্দটি চাকমাদের বিজু থেকে। এই তিন শব্দের সম্মিলিত রূপ হলো ‘বৈসাবি’।
এসবই গেলো তথ্য-উপাত্ত। নতুন বছরের প্রথম দিনটিতে অর্থাৎ পহেলা বৈশাখে সাদা শাড়ি-লাল পাড়, এলোচুল বা বেলিফুল গোঁজা একটা হাতখোঁপা সাথে জীবনের পরমবন্ধু কিংবা ঘরের শিশুটি ভোরের আলো ফুঁটে ওঠার সাথে সাথেই রাস্তায় নেমে আসে। সকলের চোখে-মুখে কী দারুণ এক উচ্ছ্বাস খেলা করে।
রমনার বটমূলে নতুন বছরের প্রথম সূর্যোদয়ের সাথে সাথেই “এসো হে বৈশাখ-এসো এসো” গানের মাধ্যমে নতুন বছরকে স্বাগত জানানো হয়। এটা বাংলা সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ।
বাংলাদেশে চারুকলা থেকে যে শোভাযাত্রা শুরু হয় তা মঙ্গলযাত্রা নামে পরিচিত। অনেকদিন ধরে দিনরাত খেটে মাটির সড়ায় রংতুলির মাধ্যমে অতি পরিচিত প্রতিকৃতি ফুটিয়ে তোলা হয়। বিশাল সেই মঙ্গল শোভাযাত্রায় অংশ নিতে পারে যে কেউ।
এটা বাঙ্গালীদের একান্ত প্রাণের উৎসব। ইউনেস্কো এই শোভাযাত্রাকে বিশ্বপরিচিতি দিয়েছে। ‘‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’’ অশুভ শক্তির বিরূদ্ধে শান্তি, গণতন্ত্র ও বাঙ্গালী জাতিসত্বার ঐক্যের প্রতীক হিসেবে ধরা হয়।
১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দ থেকে বছরের প্রথম দিনে ‘‘মঙ্গল শোভাযাত্রার’’ মাধ্যমে অপশক্তির অবসান এবং অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের মানুষের কল্যাণময় ভবিষ্যতের আশা ব্যক্ত করে চলেছে। ইউনেস্কোর অধরা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত এই মঙ্গল শোভাযাত্রা ২০১৬ এর ৩০ নভেম্বর থেকে।
শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা পৃথিবীতে বাংলা ঐতিহ্যের ধারক ও বাহকগণ এদিনটি বিশেষভাবে পালন করে থাকেন। দেশের বাইরে প্রবাসীগণ সবসময় নির্দিষ্টদিনেই আনন্দ উদযাপন করতে পারেন না। তারা সুবিধামতো পরবর্তী ছুটিরদিনটিতে বর্ষবরণ করেন। বিদেশের মাটিতে এসো হে বৈশাখ-এসো এসো বলে উদাত্ত আহ্বানে যখন বর্ষবরণ করা হয় তখন আমাদের প্রাণ জেগে ওঠে যেনো।
শুভেচ্ছা সকলকে নতুন বঙ্গাব্দ ১৪২৬ এর আগমনে। সুন্দর-সমৃদ্ধির কামনায় আমাদের প্রাণের উৎসব, বর্ষবরণের শুরুতে। মঙ্গলবার্তা বয়ে আনুক নতুন বছর।
নুহাইজা, নুমাইর এবং তাদের মতো অসংখ্য প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য শুভেচ্ছা আরো একটু বেশি। দেশের বাইরে বসে একটু দেশীয় আমেজ তৈরী করার জন্য প্রচুর সময়, উৎসাহ এবং আবেগের দরকার হয়। আমাদের আজন্মলালিত ঐতিহ্য বেঁচে থাকুক এবং চর্চিত হোক সর্বত্র। ধন্যবাদ সকলকে।