চলচ্চিত্র নায়িকা নূতন। বাংলা চলচ্চিত্রের স্বর্ণযুগের তারকা তিনি। তার গ্ল্যামারস চেহারা, নজরকাড়া চাহনি, অনবদ্য নৃত্যমুদ্রা সর্বোপরি অসাধারণ অভিনয়গুণ তাকে বাংলা চলচ্চিত্রের সিংহাসনে অধিষ্ঠিত করেছে। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত গুণী এই অভিনয়শিল্পী সম্প্রতি এসেছিলেন প্রবাস মেলা কার্যালয়ে। প্রবাস মেলা কলাকুশলীদের সাথে আড্ডায়-আলাপচারিতায় ওঠে আসে তার দীর্ঘ অভিনয় জীবনের নানা অজানা কাহিনী। সেসবের চুম্বক অংশ নিচে তুলে ধরা হল………….
প্রবাস মেলা: আপনার শৈশব, বেড়ে ওঠা সম্পর্কে কিছু জানতে চাই।
নূতন: আমার জন্ম ময়মনসিংহ জেলায়। সেখানেই কেটেছে আমার শৈশব কৈশোর। ছোটবেলায় আমি খুব দুরন্ত ছিলাম। পাড়ার ছেলেমেয়েরা একসাথে মিলে ফুটবল, ক্রিকেট, ব্যাডমিন্টন খেলতাম। এছাড়া অন্যান্য গ্রামীণ নানা খেলায় মত্ত থাকতাম সবসময়। ছোটবেলার সেইসব স্মৃতি মনে পড়লে ভালো লাগে।
প্রবাস মেলা: চলচ্চিত্রে কিভাবে এলেন?
নূতন: আমার বড় বোন গীতা চলচ্চিত্রে অভিনয় করতেন। সেটা ষাটের দশকের কথা। সে সময় আমাদের দেশের প্রখ্যাত চলচ্চিত্র অভিনেত্রী ও প্রযোজক সুমিতা দেবি সাথে কাজ করতেন আমার বড় বোন। তার সাথে আমিও স্যুটিং দেখতে যেতাম। একবার সম্ভবত অপরাজিতা ছবির স্যুটিং এর সময় সুমিতা দেবী গীতা আপুকে বললেন- এই তোর বোন নূতন তো দেখতে বেশ সুন্দর। একে সিনেমায় অভিনয় করতে দিবি? আপু বললো- আচ্ছা দেখি- ওতো এখনো ছোট, আরেকটু বড় হোক তারপর দেখা যাবে। তাছাড়া ও গান শিখছে, অভিনয়ের প্রতি তার তেমন আগ্রহ নেই। তখন আমি নবম শ্রেণির ছাত্রী। কিন্তু সুমিতা দেবী আপুকে বললেন, ওর তো গ্রোথ ভালো- ও চাইলে এখনই অভিনয় করতে পারে। এভাবে স্যুটিং দেখতে আপুর সাথে আমার যাওয়া আসা চলছিল। তখন গান আর পড়াশোনা নিয়েই আমার সময় কাটতো। মাঝে মাঝে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গান গাইতাম। যাই হোক- একদিন সুমিতা দিদি আপুকে সরাসরি বললেন, গীতা একটা নতুন ছবি আসতেছে। এ ছবিতে পরিচালক নায়িকা খুঁজতেছে। তুই চাইলে আমি নূতনকে এ ছবিতে নায়িকা হিসেবে অভিনয়ের সুযোগ করে দিতে পারি। ব্যস আপু রাজী হলেন। আমিও আপুর আর সুমিতা দিদির কথায় সাড়া দিয়ে ইন্টারভিউ দিতে রাজি হলাম। ইন্টারভিউতে অনেকেই এসেছিল। কিন্তু শেষমেষ আমাকেই নায়িকা হিসেবে নির্বাচিত করা হলো। এটা ১৯৬৯ সালের কথা। তখন আমার বয়স ১১ বছর। এভাবে ‘নতুন প্রভাত’ ছবিতে নায়িকা হিসেবে আমার অভিনয় জীবনের শুরু। আমার বিপরীতে নায়ক ছিলেন আনসার ভাই। ছবিটি পরিচালনা করেছেন মোস্তফা মেহমুদ।
প্রবাস মেলা: আপনার সেই প্রথম অভিনয়ে আসার স্মৃতিটাকে কিভাবে মূল্যায়ন করবেন?
নূতন: আমার অভিনয় জীবনের শুরুটা এতো চমৎকার হবে আমি কখনো ভাবিনি। তাই সেই দিনগুলোর কথা মনে পড়লে আমি এখনো বেশ রোমাঞ্চিত হই। সুমিতা দিদি এবং পরিচালক মোস্তফা মেহমুদ ভাইয়ের কাছে আমি কৃতজ্ঞ যে তারা চলচ্চিত্রের মতো জায়গায় আমাকে পা বাড়াতে সহযোগিতা করেছিলেন।
প্রবাস মেলা: আপনি বললেন ছোট বেলায় গান করতেন- তো গান ছেড়ে অভিনয়ে আসায় আপনার কোন দুঃখবোধ আছে কি?
নূতন: ছোটবেলায় গানের প্রতি আমার অদম্য আগ্রহ ছিল। ভবিষ্যতে বড়শিল্পী হবো এজন্য আমি বাফায় (ময়মনসিংহ) ভর্তি হয়েছিলাম। ওস্তাদ মিতুন দে’র কাছে উচ্চাংগ সঙ্গীতের তালিম নিতাম। তিনি বেশ ভালো শিখাতেন। তখন স্থানীয় বিভিন্ন প্রোগ্রামে গান করতাম। তারপর একসময় নাচের প্রতি আমার বেশ আগ্রহ জন্মায়। গানে বিরতি দিয়ে নিয়মিত নাচ শিখতে শুরু করি। আমার নাচের শিক্ষক ছিলেন পূর্ণচন্দ্র সরকার। ময়মনসিংহের বিভিন্ন মঞ্চে নাচও পারফর্ম করতে থাকি। কিন্তু একসময় সব হিসেব নিকেষ বদলে গিয়ে হলে গেলাম নায়িকা। হয়তো বিধাতা আমার নিয়তি এভাবেই নির্ধারণ করে রেখেছেন। তাছাড়া আমার বাবা কৃষ্ণমুর্তি আইয়ার একজন ভারতীয় জমিদার বংশের সন্তান ছিলেন। তিনি দক্ষিণ ভারতের নির্বাক চলচ্চিত্রে নিয়মিত অভিনয় করতেন। বলতে পারেন আমার রক্তেও অভিনয়ের চেতনা প্রবাহিত রয়েছে। তাই গায়িকা বা নৃত্যশিল্পী না হওয়াতে এখন আর কোন আক্ষেপ নেই। তবুও গানের প্রতি ভালোবাসা এখনো আমার আছে। অবসরে এখানো গান শুনি। দেশাত্ববোধক, পল্লীগীতি, ভাটিয়ালী এসব গান আমার খুব ভালো লাগে। শ্রদ্ধেয় নীনা হামিদ, আব্দুল আলীম, আব্বাস উদ্দিন প্রমুখ শিল্পীদের কখনো ভুলতে পারবোনা।
প্রবাস মেলা: আপনিতো প্রায় তিন শতাধিক ছবিতে নায়িকা হিসেবে কাজ করেছেন। এতগুলো ছবির মধ্যে কোন কোন ছবিকে আপনার সেরা কাজ হয়েছে বলে মনে করেন?
নূতন: আমি মনে করি বাংলাদেশের প্রথম মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক চলচ্চিত্র ‘ওরা ১১ জন’ ছবিতে অভিনয় করতে পারাটা আমার জন্য জীবনের সেরা একটা কাজ। এ ছবির পরিচালক ছিলেন প্রখ্যাত পরিচালক চাষী নজরুল ইসলাম। এতে অভিনয় করেছেন- মুক্তিযোদ্ধা খসরু ভাই, সোহেল রানা ভাই, খলিল ভাইসহ আরো অনেকে। তাদের কাছে আমি কৃতজ্ঞ যে, তারা আমার মতো একজন আনকোরা নায়িকাকে সহশিল্পী হিসেবে কাজ করতে অনেক সহযোগিতা করেছেন। এটা আমার জন্য অনেক বড় পাওয়া। কারণ মুক্তিযুদ্ধ বাঙালি জাতির ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে বাংলার দামাল ছেলেরা জীবন বাজি রেখে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীকে পরাস্ত করে স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছিল। বাঙালি জাতি আজীবন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে এবং মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বীরদের গভীর শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে। যে সব মা বোনেরা দেশের স্বাধীনতার জন্য তাদের সম্ভ্রম হারিয়েছেন তাদের প্রতি আমাদের অজ¯্র ঋণ হয়েছে তা আমরা কোনদিন শোধ করতে পারবোনা। আর এই সব ঐতিহাসিক বিষয়কে উপজীব্য করে নির্মিত যেকোন শিল্পই হাজার হাজার বছর ইতিহাসে টিকে থাকবে। সে কারণে আমি মনে করি ‘ওরা ১১ জন’ ছবিটির অনেক ঐতিহাসিক মূল্য রয়েছে। এ ছবিতে কাজ করতে পারা আমার জন্য অনেক গর্বের বিষয়।
প্রবাস মেলা: আমরা শুনেছি আপনি আপনার অভিনয় জীবনের শুরুর দিকে হঠাৎ অভিনয় ছেড়ে দিয়েছিলেন, কেন? গানে বা নাচে ফিরে যাবেন চিন্তা করেছিলেন?
নূতন: না, গানে বা নাচে ফিরে যাবো তা কখনো ভাবিনি। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে ‘ওরা ১১ জন’, ‘সংগ্রাম’ ছবিতে কাজ করার পর আমি ব্যক্তিগত কারণে প্রায় পাঁচ বছর চলচ্চিত্রে অভিনয় করতে পারিনি। পরে আবার অভিনয়ে নিয়মিত হই। দর্শকও আমাকে ভালোভাবে গ্রহণ করে। বিশেষ করে নায়ক রাজ রাজ্জাক ভাই এর সাথে ‘পাগলা রাজা’ ছবির মাধ্যমে অভিনয়ে আবার ফিরে আসি। এরপর একের পর এক সিনেমায় কাজ করার জন্য আমার ডাক আসতে থাকে। রাজ্জাক ভাইয়ের সাথে টানা বেশ কয়েকটা ছবিতে কাজ করি। বদনাম, সৎভাই, মিস্টার মাওলাসহ আরো অনেকগুলোতে জুটি হয়ে অভিনয় করি। রাজ্জাক-নূতন জুটি তখন বেশ আলোড়ন তোলে। উল্লেখ্য নায়ক হিসেবে রাজ্জাক ভাইয়ের শেষ চলচ্চিত্র মালা-মতির ভূমিকায়ও আমরা দুজন ছিলাম।
প্রবাস মেলা: জুটি হিসেবে আর কার কার সাথে অভিনয় করতে স্বাচ্ছন্দবোধ করতেন?
নূতন: আমাদের সময়কার প্রায় সব নায়কদের সাথে আমি জুটি হিসেবে অভিনয় করেছি। সবার সাথে কাজ করতে আমি স্বাচ্ছন্দ পেতাম। যেমন- নায়ক জসিম, সোহেল রানাসহ সবাইকে আমি শ্রদ্ধা করি।
প্রবাস মেলা: বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে আপনাদের যুগকে তো স্বর্ণযুগ বলা হয়। এখনকার চলচ্চিত্র শিল্প সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কি ?
নূতন: আসলে ইতিহাসে সব যুগেরই কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্য থাকে। আমাদের সময়টা ছিল স্বাধীনতা পরবর্তী যুগ। সে সময় দর্শকদের চাহিদামতো বেশ কিছু ছবি নির্মিত হয়েছিল যা সামাজিক ছবি হিসেবে দর্শক গ্রহণ করে। তবুও বলবো মাঝখানে কিছু সময় বাদে এখন বাংলাদেশে কিছু ভালো ছবি তৈরি হচ্ছে। তবে আরো ভালো করতে হবে। শুধু নায়ক নায়িকা নির্ভর গল্প নিয়ে গ্লামারাস ছবি বানালে হবে না। সমসাময়িক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে জীবনমুখী গল্প তৈরী করতে হবে। তাহলে সেগুলো দর্শকনন্দিত হবে। আসলে বলতে কি- চলচ্চিত্র বা সিনেমা হলো একটা যৌথ কাজ। এখানে ভালো সিনেমা নির্মাণে যুগের যেমন ভূমিকা রয়েছে তেমনি, প্রযোজক, পরিচালক, অভিনয়শিল্পী, চিত্রনাট্য রচয়িতা, দর্শক সবার ভূমিকা অনস্বীকার্য।
প্রবাস মেলা: মিডিয়াশিল্পীদের সামাজিক দাায়বদ্ধতা সম্পর্কে আপনার মতামত কি?
নূতন: দেখুন, সিনেমা নাটকে যারা অভিনয় করে তারাও সাধারণ মানুষের মতই জীবন-যাপন করে। সাধারণ মানুষের যেমন সামাকিজ দায়বদ্ধতা রয়েছে তেমনই মিডিয়া কর্মীদের ক্ষেত্রেও তা প্রযোজ্য। এক্ষেত্রে তারাও সচেতন থাকে। তবে, চলচ্চিত্র বা নাটকের সাথে সংশ্লিষ্টদের জীবনাচার, চালচলন, পোশাক-আশাক ইত্যাদি সাধারণ মানুষের চেয়ে সমাজে বেশি প্রভাব ফেলে। সে কারণে মনে হয়, তাদের সামাজিক দায়বদ্ধতা বেশি। তারকাশিল্পী হিসেবে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হবার পর তাদেরকে সমাজের অন্য মানুষেরা ফলো করে। আবার তাদের জীবনে ঘটে যাওয়া যেকোন ঘটনা মিডিয়ার কল্যাণে ব্যাপক প্রচার পায় বলে তাদের সামাজিক দায়বদ্ধতা বেশি বলে বিচার করা হয়। তবে আমি মনেকরি একটি দেশে বসবাসরত সকল নাগরিকের সামাজিক দায়বদ্ধতা বা সমাজ সচেতনতা সমান থাকা উচিত।
প্রবাস মেলা: প্রবাসী বাংলাদেশিরাও আপনাদের মত সেলিব্রেটিদের ফ্যান, বিদেশ বিভূঁয়ে শতব্যস্ততার পরেও তারা অবসরে আপনাদের অভিনীত সিনেমা নাটক দেখে থাকে, এসব প্রবাসীদের উদ্দেশ্যে আপনার কিছু বলার আছে কি?
নূতন: প্রবাসী বাংলাদেশিরা সত্যিকার অর্থে আমাদের দেশের জন্য অনেক বড় সম্পদ, আমার জানামতে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এক কোটিরও অধিক বাংলাদেশি নানা কর্মে নিয়োজিত আছেন। তাদের কষ্টার্জিত রেমিটেন্স আজ আমাদের অনেক বড় সম্পদ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। বিদেশে যারা থাকেন তাদের বেশিরভাগই খুব কষ্টে কায়িক পরিশ্রম করে অর্থ আয় করেন। বিশেষ করে যারা মধ্যপ্রাচ্যে থাকেন তাদের কষ্ট অনেক বেশি। আমি শুনেছি এবং দেখেছি এতকষ্টের মাঝেও তারা অবসরে বিনোদন হিসেবে বাংলাদেশি সিনেমা নাটক দেখেন। এজন্য তাদের প্রতি আমরা শিল্পীরা কৃতজ্ঞ। এত কিছুর মাঝেও যখন শুনি এই সব রেমিটেন্স যোদ্ধাদের সাথে বিমানবন্দরে খুব বাজে আচরণ করা হয়, তাদের কষ্টার্জিত মালামালের বিষয়ে অযথা হয়রানি করা হয় তখন খুব কষ্ট লাগে। আরেকটি বিষয় নারীকর্মী হিসেবে যারা বিভিন্ন দেশে যাচ্ছে তারা সেখানে নানা ধরনের শারীরিক, মানসিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছে বলে আমরা মিডিয়ার মাধ্যমে জানছি, প্রতক্ষদর্শীদের মতে পরিস্থিতি আরও মর্মান্তিক। আমি সরকারসহ সংশ্লিষ্ট মহলের কাছে জোর দাবি জানাব যেন অনতিবিলম্বে এই সকল প্রবাসীদের জন্য বিহীত ব্যবস্থা করা হয়। এটা সময়ের জরুরী দাবি। আর নতুন যারা বিদেশে যেতে চাচ্ছেন তাদের উদ্দেশ্যে বলবো, আপনারা যে যেকোন কাজে প্রশিক্ষণ নিয়ে সবকিছু ভালোভাবে জেনে বুঝে তারপর বিদেশে যান। প্রবাসীরা আপনারা যেখানেই থাকুন ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন।
প্রবাস মেলা: মূল্যবান সময় দেয়ার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
নূতন: প্রবাস মেলা পরিবারকেও ধন্যবাদ।
(সাক্ষাতকারটি লিখেছেন শহীদ রাজু)