মম মজুমদার, কোলকাতা, ভারত থেকে: রাজা রামমোহন রায়ের দৃপ্ত পদক্ষেপে উদ্ভাসিত আধুনিক বাংলা প্রথমদিকে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের আলোয় উপরতলার কিছু মানুষ আলোকিত হলেও মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত যখন সমাজের রীতির বেড়াজালে আবদ্ধ, ঠিক তখনই এমন একজন ফিলোসফিক্যাল ‘মা’ আমাদের এই বঙ্গের বাঁকুড়া জেলার জয়রামবাটিতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। যিনি বিজ্ঞানসম্মতভবে জীবনটাকে দেখেছিলেন এবং অন্যদেরও দেখাবার আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন। তিনি বায়োলজিক্যালভাবে কারো মা না হয়েও এই জগতের বেশ কিছু মানুষের অত্যন্ত কাছের মা হয়ে উঠেছিলেন। যদি পরমাত্মায় বিশ্বাস করি তবে তিনি আছেন এবং থাকবেন এই সংসারে একান্ত আপন ‘মা’ হিসাবে। তিনি মা ‘সারদা দেবী’।
তিনি অতি আটপৌরে সাধারণ মানুষের সাথে মিশে যাওয়া সহজ সরল এবং বিজ্ঞানমনষ্ক। প্রকৃতিকে অসম্ভব ভালবাসা দিয়ে তিনি অবিনশ্বর হয়ে আছেন আমাদের মাঝে।
তার জন্ম ভিটা বাঁকুড়া জেলার জয়রামবাটিতে কয়েকদিনের জন্য যেতে পেরেছিলাম। যেখানে প্রতিটি ধুলোকনায় তার অস্তিত্ব আজও অনুভব করা যায়। সেই সুন্দর শান্ত পরিবেশে দেখা যায় পুরনো গাছগুলি যা পাখি গানের মূর্ছনায় এখানকার প্রকৃতিকে করেছে অপরূপ। যে পুকুরে মা একসময় স্নান করতেন আজও আছে। ‘মায়ের ঘাট’ নামে পরিচিত সেই পবিত্র জলের জলাশয়।
মানসিকভাবে আধুনিক এই মানুষটি চেয়েছিলেন মেয়েরা স্বনির্ভর এবং কুসংস্কার মুক্ত হোক। তাইতো স্বামীর মৃত্যুর পর অন্যের দেওয়া সাদা থান না পরে নিজেদের কষ্টার্জিত লাল পাড়ের কাপড়ের পাড় ছিড়ে পরে সকলের সামনে দীপ্ত ভঙ্গিতে দাঁড়াতে পেরেছিলেন। যা আজও অনেক শিক্ষিত বাড়িতে কল্পনাও করা যায় না।
তখনকার বিদগ্ধ পণ্ডিতদের বিভিন্ন কুসংস্কার উপেক্ষা করার এমন হিম্মত খুব কম মানুষেরই ছিল। সেই কারণে তাঁর জন্মস্থান এর প্রতিটি ধূলিকণা স্বর্ণরেণু তে ভরা থাকবেএ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না।
কলকাতার হাওড়া স্টেশন থেকে প্রায় ৯০ কিলোমিটার দূরে বাঁকুড়া জেলার জয়রামবাটি অতি প্রসিদ্ধ স্থান। রামকৃষ্ণ মিশন পরিচালিত জয়রামবাটী মা সারদার জন্মভিটে এখনও দেখা যায় বিচুলি ছাওয়া আধুনিক মাটির ঘর। যেখানে মার রান্নাঘর ও আত্মীয়রা থাকতেন। মায়ের মূল বাসস্থান সুন্দর উপাসনালয় তৈরি হয়েছে। সকাল দুপুর সন্ধ্যা তিন বেলা গানে গানে আকাশ বাতাস মুখরিত থাকে। পশুপাখিরা আনন্দে গাছে গাছে ঘুরে বেড়ায়।
মায়ের স্বামীর বাড়ি অর্থাৎ শ্রীরামকৃষ্ণদেবের বাড়ি নিকটে কামারপুকুরে যা হুগলি জেলায় অবস্থিত। অতি মনোরম পরিবেশ চারিদিক সবুজে ঘেরা ঠাকুরের বাড়ির প্রবেশদ্বারে এখনো ঠাকুরের হাতে তৈরি সেই আম গাছটি প্রতিবছর ফলে ভর্তি হয়ে যায়। বিশালাকৃতির এই আমগাছটি এখনো ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের জীবনস্মৃতি বয়ে চলেছে।
অনেক পশুপাখি নিরাপদ আশ্রয় স্থল এই গাছটি। সেই পুকুরটি যেখানে মা সারদার স্নান করতে যেতেন, আছে সেই রাহা বাড়ি যারা ঠাকুর রামকৃষ্ণদেবের বিয়ের সময় মা সারদাকে গয়না দিয়ে সাজিয়েছিলেন। আছে সেই পাঠশালাটি যেখানে ঠাকুর রামকৃষ্ণদেব প্রথম পাঠ নিয়েছিলেন ‘যত মত তত পথ’ আজও দাইমা বাড়িটি দেখা যায়। যেখান থেকে ঠাকুর রামকৃষ্ণদেব শিখেছিলেন জাত নয় মানবধর্ম আসল ধর্ম।
এখনকার উচ্চশিক্ষিত আধুনিক মায়েদের তুলনায় আমার মনে হয় অনেক বেশি আধুনিক মা সারদা দেবী। তিনি সর্বদা জগত কল্যাণের কথা ভাবতেন ছোট ছোট কাজের মাধ্যমে।
তিনি বলতেন খাবারের অবশিষ্ট অংশ নষ্ট না করে জীবদের দিয়ে দাও। এতে যেমন প্রকৃতির পূজা হবে তেমনি প্রকৃতিতে সমতা বজায় থাকবে। বৈজ্ঞানিক ভাষা যা ইকোসিস্টেমের ব্যালেন্স বোঝায়।
বাঁকুড়া জেলা ইতিহাসের পাতায় উজ্জ্বল একটি নক্ষত্র। খ্রিস্টীয় সপ্তম শতাব্দী থেকে বিংশ শতাব্দি পর্যন্ত বাঁকুড়ার ইতিহাসের ইতিহাস রচনা হয়েছে।
খ্রিস্টীয় সপ্তম শতকের শেষে বৃন্দাবন এর কাছে জয়নগর রাজ্যের রাজা সস্ত্রীক তীর্থে যাত্রা সময় কোতুলপুর এর কাছে এক ব্রাহ্মণবাড়িতে স্ত্রী এবং পুত্রকে রেখে যেতে বাধ্য হয়। সেই ব্রাহ্মণ সদ্যোজাত সন্তানকে অস্ত্রশাস্ত্র, শাস্ত্র বিদ্যা, মল্লযুদ্ধে পারদর্শী করে তোলেন এবং স্থানীয় রাজ সিংহাসনে বসার ব্যবস্থা করেন। তার পুত্র পাঠানদের সাথে মোগলদের সহযোগিতায় দীর্ঘ লড়াই করেন। এবং রাজত্বকে সুষ্ঠু শাসন ব্যবস্থা দিয়েছিলেন। তিনি একাধিক টেরাকোটা মন্দির ও বাঁধ নির্মাণ করেছিলেন।
মন্দিরগুলির শিল্পকলায় মুসলিম স্থাপত্যের বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। পুরাতন এই মন্দিরগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য মদন মোহন মন্দির, জোড়া মন্দির। এসব মন্দিরের গায়ে রামায়ণ-মহাভারতের অনেক কাহিনী সুন্দরভাবে চিত্র আঁকা আছে। সঙ্গে আছে বিভিন্ন সামাজিক চিত্র।
পোড়ামাটির পরিচিত এই শিল্পের পীঠস্থান হল বাঁকুড়া। সুবিশাল জয়পুর জঙ্গল পুরুলিয়ায় গিয়ে শেষ হয়েছে এক বিশাল অক্সিজেন ভাণ্ডার জয়পুর ফরেস্ট দিনের বেলায় ঝিঁঝিঁর ডাক আকাশ বাতাসকে ভরিয়ে রাখে। এছাড়াও আছে বুনো হাতি, হনুমান, শুকর এবং হরিণ। ভাগ্য সুপ্রসন্ন থাকলে জন্তুদের সামনাসামনি দেখা যায়। তবে তাদের পায়ে চলার রাস্তা নিদর্শন বুঝিয়ে দেয় এই জঙ্গলের বাসিন্দাদের।
আছে আদিবাসী গ্রাম যাদের প্রধান ভরসাস্থল জঙ্গলের শাল পাতা। আদিবাসী ছেলেমেয়েরা সামনে স্কুলে পড়াশুনো করে। আছে বিদ্যুৎ এবং পানীয় জলের ব্যবস্থা। সঙ্গে আছে সারা দুনিয়ার সাথে যোগাযোগ করার মাধ্যম টেলিভিশন, স্মার্ট ফোন যা আদিবাসী ছেলে মেয়েরা এখন সহজেই চালাতে পারে।
আধুনিকতার ছোঁয়া আজ তাদের ঘরে ঘরে শাল পাতা তৈরি থালা বাটি শহরের অভিজাত সম্প্রদায় বাড়িতে আসে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে। যদিও বর্তমানে প্লাস্টিকের পরিমাণ বেড়ে গেছে তবে অনেক নস্টালজিক মানুষ আজও শালপাতা খোঁজে। আদিবাসীদের প্রধান পেশা জঙ্গল থেকে শালপাতার সংগ্রহ করা। মা সারদা দিনের পর দিন এখানকার গরীব মহিলাদের সাথে চলেছেন।