রাসেল আহমেদ, প্যারিস, ফ্রান্স থেকে: বাংলাদেশ দূতাবাস, প্যারিস যথাযথ মর্যাদা ও ভাবগাম্ভীর্যের মধ্য দিয়ে ভিন্নধর্মী আয়োজনের মাধ্যমে শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করেছে। এ উপলক্ষ্যে সকালে দূতাবাসের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের উপস্থিতিতে মান্যবর রাষ্ট্রদূত কর্তৃক জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত করার মাধ্যমে দূতাবাসের অনুষ্ঠানের শুরু হয়। এরপর মান্যবর রাষ্ট্রদূত দূতাবাস প্রাঙ্গণে স্থাপিত অস্থায়ী শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। অস্থায়ী শহীদ মিনারের পাদদেশে ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। অনুষ্ঠানের শুরুতে পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত ও অন্যান্য পবিত্র ধর্মগ্রন্থ থেকে পাঠ শেষে ভাষা শহীদদের বিদেহী আত্মার মাগফেরাত এবং দেশ ও জাতির মঙ্গল কামনা করে বিশেষ মোনাজাত করা হয়। দূতাবাসের কর্মকর্তাবৃন্দ শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে মহামান্য রাষ্ট্রপতি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, মাননীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রী এবং মাননীয় পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী কর্তৃক প্রদত্ত বাণী পাঠ করেন। এছাড়া আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে ইউনেস্কো-এর মহাপরিচালক Ms Audrey Azoulay কর্তৃক প্রদত্ত ভিডিও বার্তা প্রদর্শিত হয়। ইউনেস্কো-এর মহাপরিচালক তাঁর বক্তব্যে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশের ঐতিহাসিক অবদানের কথা উল্লেখ করেন এবং একইসাথে মাতৃভাষা ও বহুভাষার প্রসারে বাংলাদেশের গৃহীত কার্যক্রম ও নেতৃত্বের ভূয়সী প্রশংসা করেন। তিনি বঙ্গবন্ধুকে বাংলাদেশের ‘ Independence Hero’ হিসেবে অভিহিত করে বাংলা ও বাঙালি জাতিসত্ত্বার স্বীকৃতি অর্জনে তাঁর অসামান্য অবদানের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করেন। উল্লেখ্য, বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ বলে তিনি মত প্রকাশ করেন।
চলমান কোভিড-১৯ অতিমারীর প্রেক্ষিতে স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করে দূতাবাসের সকল সদস্য এ আয়োজনে অংশগ্রহণ করেন। প্রবাসীদের অংশগ্রহণের লক্ষ্যে দূতাবাস অনুষ্ঠানটি ভার্চুয়াল প্লাটফর্মে আয়োজন করে। ফলে ফ্রান্সে বসবাসরত বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ, রাজনৈতিক, ব্যবসায়ী, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দসহ প্রবাসের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ ও গুণীজন অনলাইনে অংশগ্রহণ করেন। দিবসটি উপলক্ষ্যে আয়োজিত এ অনলাইন অনুষ্ঠানে সংযুক্ত অতিথিবৃন্দের অংশগ্রহণে মহান শহীদ দিবস ও আর্ন্তজাতিক মাতৃভাষা দিবসের উপর আলোচনা করেন। আলোচনা পর্বে বক্তাগণ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিসংগ্রাম এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদ গঠনে ভাষা আন্দোলনের গুরুত্ব ও তাৎপর্য তুলে ধরেন। বক্তাগণ বাঙ্গালি জাতির সংগ্রামের প্রতিটি পর্যায়ে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের অবদানের কথা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন। এছাড়া আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস প্রতিষ্ঠায় দূতাবাসে কর্মরত তৎকালীন রাষ্ট্রদূত ও কর্মকর্তাদের অবদানের কথাও তাঁরা কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করেনও স্মৃতিচারণ করেন। প্রবাসী বাংলাদেশিগণ সকল ক্ষেত্রে বাংলা ভাষার চর্চার প্রতি আরো যত্নবান হওয়ার আহবান জানান এবং প্রবাসে হলেও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের শিশু-কিশোরদের বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির চর্চার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেন।
ফ্রান্সে নিযুক্ত বাংলাদেশের মান্যবর রাষ্ট্রদূত জনাব কাজী ইমতিয়াজ হোসেন তাঁর বক্তব্যের শুরুতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও ভাষা আন্দোলনের শহীদদের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। তিনি বঙ্গবন্ধুর দূরদর্শী নেতৃত্বের কথা উল্লেখ করে বলেন, বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতার দাবীতে সোচ্চার হতে অনুপ্রাণিত করেছেন, উজ্জীবিত করেছেন, দিকনির্দেশনা প্রদান করেছেন। তিনি ইউনেস্কো কর্তৃক এই দিবসটি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণাকে ২১ শে ফেব্রুয়ারির আন্তর্জাতিকীকরণ বলে অভিহিত করেন এবং এর সাথে সংশ্লিষ্ট সকলকে ধন্যবাদ জানান। তিনি প্রবাসে বসবাসরত বাংলাদেশিদের তাঁদের পরবর্তী প্রজন্মের মাঝে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির চর্চা নিশ্চিতকরণের প্রতি গুরুত্বারোপ করেন। অনুষ্ঠানের শেষার্ধে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্তৃক নির্মিত বিশেষ প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শিত হয়।
এছাড়া ইউনেস্কোতে বাংলাদেশের স্থায়ী মিশনের সার্বিক তত্ত্বাবধানে ও ইউনেস্কো-এর ২৮ টি সদস্য রাষ্ট্রের অংশগ্রহণে ভার্চুয়াল প্লাটফর্মে ভাষা প্রদর্শনী ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের এক ভিন্নধর্মী আয়োজন অনুষ্ঠিত হয়। প্রায় ২ ঘন্টাব্যাপী আয়োজিত এ অনুষ্ঠানটি বিশেষায়িত একটি ওয়েবসাইট (www.eventsbangladeshinparis.fr)ও দূতাবাসের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ হতে একইসাথে সম্প্রসারিত হয়। ভার্চুয়াল ভাষা প্রদর্শনীতে ২১টি দেশের ব্যানার , পোস্টার বহুভাষা ও সংস্কৃতির এক মিলনস্থলে পরিণত হয়।
এছাড়া ২০টি দেশের অংশগ্রহণে বিশ্ব সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের এক আয়োজন সম্প্রচারিত হয়। উক্ত অনুষ্ঠানে মান্যবর রাষ্ট্রদূত ও ইউনেস্কোতে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি ছাড়াও ইউনেস্কোর উপ-মহাপরিচালক (শিক্ষা) Ms Stefania Giannini, ইউনেস্কো-এর ৬টি ইলেক্টোরাল গ্রুপের সভাপতিগণ পৃথক পৃথক বক্তব্য প্রদান করেন। ইউনেস্কোর উপ-মহাপরিচালক (শিক্ষা) তাঁর বক্তব্যে মাতৃভাষা তথা ভাষাতাত্ত্বিক বৈচিত্রের বিশ্বময় প্রসারে বাংলাদেশ নেতৃত্বের ভূমিকায় আসীন। এছাড়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীতে তিনি বাংলা ভাষার স্বীকৃতি আদায়ে বঙ্গবন্ধুর সাহসী ও নিরলস প্রচেষ্টা ও সংগ্রামের কথা বিশেষভাবে তুলে ধরেন। মান্যবর রাষ্ট্রদূত তাঁর বক্তব্যে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস আয়োজনে ইউনেস্কো ঘোষিত প্রতিপাদ্য “Fostering Multilingualism for inclusion in education and society” – কে অত্যন্ত সময়োপযোগী ও কার্যকর বলে উল্লেখ করেন। রাষ্ট্রদূত বলেন, মা ও মাতৃভাষা যে কোনো ব্যক্তির নিজস্ব সত্ত্বা তৈরিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ইউনেস্কো ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণার মাধ্যমে বিশ্বের সকল ভাষাভাষী মানুষের মায়ের ভাষায় কথা বলার