হাকিকুল ইসলাম খোকন, নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র প্রতিনিধি: কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, “যে ব্যক্তি নিজের ঘরকে অস্বীকার করে, কখনোই বিশ্ব তার ঘরে আতিথ্য গ্রহণ করতে আসেনা।” সেই প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে এ দেশে বেড়ে ওঠা নতুন প্রজন্মের মনে, আমাদের দেশীয় সংস্কৃতি-প্রকৃতির রূপ রেখা, শুভ বার্তা কিছুটা হলেও যেন জন্মে, সে প্রয়াস চালাতেই কাজ করে যাওয়া বাংলাদেশ একাডেমি অব ফাইন আর্টস (বাফা) এর আয়োজনে গত ২৪শে নভেম্বর সন্ধ্যা ৭টায় কুইন্স এর ফ্লাশিং মেডো পার্কে অবস্থিত কুইন্স থিয়েটারে মঞ্চস্থ হলো কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাঁকুরের গীতি নৃত্য নাট্য ‘চিত্রাঙ্গদা’। বৈরী আবহাওয়ার মধ্যেও বিশাল অডিটোরিয়ামটিতে প্রবেশ করতেই চোখে পড়লো কানায় কানায় পরিপূর্ণ চারিদিক। খানিক চোখ বুলিয়ে বুঝতে পারলাম, অনুষ্ঠানটি উপভোগ করার জন্য, সাংবাদিক, লেখক, নাট্য কর্মী-শিল্পীসহ নানা পেশার মানুষের সমাবেশ ঘটেছে। অনুষ্ঠানের শুরুতেই একদল শিশুশিল্পী ‘এক টুকরো বাংলাদেশ’ এই বিষয়বস্তু নিয়ে কয়েকটি নৃত্য পরিবেশন করে। তাদের অপূর্ব নৃত্য পরিবেশনা দর্শকদের আমোদিত করে।
এখানে যারা নৃত্যে অংশগ্রহণ করেছে তারা হলো নির্ঝা, মায়া, অদিতি, চৈতন্য, পারমিতা, অমৃতা, অংকিত, আবৃত্তি, আদৃতা, সংহিতা, তুলসী, রিয়া, তিশা, নাসিমা, জারা, দিবা, সারাফ, নোরা, অপ্সরা এবং কথা । এর পরের অতিথি ছিল কনসাল জেনারেল সাদিয়া ফয়জুন্নেসা, জাতিসংঘের বাংলাদেশ স্থায়ী মিশনের সহকারী রিপ্রেজেন্টেটিভ তারেক মোহাম্মদ আরিফুল ইসলাম এবং কৌশিক আহমেদকে। কনসাল জেনারেল প্রথমেই উচ্ছসিত ভাবে ধন্যবাদ জানান বাফার ক্ষুদে শিল্পী, অভিভাবক এবং সংশ্লিষ্ট সকলকে, বিশেষ করে বাফার প্রেসিডেন্ট ফরিদা ইয়াসমিনকে। তিনি বলেন, এই শিশুরাই আমাদের বাংলাদেশকে, বাঙালিকে, কবি গুরুর বাণীকে ছড়িয়ে দিচ্ছে দেশের বাহিরে। চিত্রাঙ্গদা প্রসঙ্গে বলেন, চিত্রাঙ্গদা হচ্ছে তাঁর মনের কথা, অনেক মেয়ে বা নারীর মনের কথা এমনকি অনেক পুরুষেরও মনের কথা। তিনি মনে করেন ১৩০ বছর আগে রচিত চিত্রাঙ্গদার যে বাণী কালের বিবর্তনে তা হারিয়ে যায়নি বরং প্রখর হয়েছে। This is more than women empowerment, তাঁর মতে এটি নারীর স্বকীয়তা, নারীর সত্তা, নারীর প্রজ্ঞা, নারী যে বিজ্ঞ সেটিকে প্রমান করেছেন কবি গুরু l তাঁর প্রত্যাশা, যেন আমরা চিত্রাঙ্গদাকে আমেরিকান মেইন স্ট্রিমে পৌঁছে দিতে পারি । জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি মাসুদ বিন মোমেনের পক্ষে শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন জাতি সংঘের বাংলাদেশ স্থায়ী মিশনের সহকারী রিপ্রেজেন্টেটিভ তারেক মোহাম্মদ আরিফুল ইসলাম । বাঙালি পত্রিকার সম্পাদক কৌশিক আহমেদ বাফাকে ধন্যবাদ জানাতে গিয়ে বলেন, বাফাকে দু’টো বিষয়ে ধন্যবাদ দিতে চাই; একটি হলো এর আগে তারা রবীন্দ্রনাথের দু’টি গীতি নৃত্যনাট্য মঞ্চায়িত করেছেন; চণ্ডালিকা ও মায়ার খেলা। এবার তারা করছে চিত্রাঙ্গদা। বীন্দ্রনাথের নৃত্যনাট্যগুলো তারা যে ধারাবাহিক ভাবে করে যাচ্ছে এটা আমাদের জন্য বিশাল কাজ। নিউ ইয়র্কে অন্য আবহে আমরা যারা রবীন্দ্র নৃত্যনাট্যগুলোকে ভুলতে বসেছিলাম বাফা নতুন করে তা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। তিনি বলেন অন্য কাজটি হচ্ছে ছোট ছোট ছেলেমেয়ে যারা পারফর্ম করলো যারা আমেরিকান সংস্কৃতিতে বড় হয়ে উঠছে, যাদেরকে বাঙালি করে গড়ে তোলা আমাদের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব। বাফা এ দায়িত্ব নিষ্ঠার সাথে পালন করে যাচ্ছে। তিনি সকলকে বাফার পাশে দাঁড়াতে অনুরোধ জানান। এরপরই মঞ্চে আসেন বাফার নৃত্যগুরু অনুপ কুমার দাস। তিনি বলেন, এর আগে আরও দু’টি প্রতিষ্ঠানের জন্য এ কাজটি করেছি কিন্তু আমার মনে হয় এইবার তৃতীয়বারে এসে আমার সর্বোচ্চ চেষ্টাটুকু দিতে পেরেছি। আশা করি সবার ভালো লাগবে । বক্তব্য পর্বের পরেই এলো সেই কাঙ্খিত মাহেন্দ্রক্ষণ ! চোখের সম্মুখে উদ্ভাসিত হলো পৌরাণিক যুগের কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাঁকুরের চিত্রাঙ্গদা। এই চিত্রাঙ্গদাকে তিনি মহাভারত থেকে এনে আধুনিক মানুষিকতায় রূপান্তরিত করেছেন। শিবে বর পাওয়া মনিপুর রাজ্যে যেখানে কেবল পুত্রই জন্মানোর কথা, সেখানে রাজকুলে বিস্ময়ে জন্ম নেয়া স্বামীর চরণাগত, সহমরণে উদ্যত পৌরাণিক চিত্রাঙ্গদাকে গড়ে তুলেছিলেন, ধনুবিদ্যা, যুদ্ধবিদ্যা, রাজদণ্ডনীতি, পুরুষের সমকক্ষ করে, মোটকথা আত্মমর্যাদা পরায়ণ এক নারী হিসাবে। যে কিনা তার রূপ দিয়ে পুরুষ সঙ্গীকে ভোলাতে চায়নি। চায়নি দেবী হয়ে পূজার আসনে বসতে। সে চেয়েছে পুরুষ প্রেমিকের সমকক্ষ ও সহচর হয়ে কাজ করতে।
প্রায় এক ঘন্টারও বেশি সময় ধরে এই কথাগুলো কাব্য, সংগীত, নৃত্য আর মুদ্রার তালে, বর্ণচ্ছটার সমবায়ে সমস্ত কিছুর ভিতর দিয়ে অপরূপ সৌন্দর্যের উৎকর্ষতা ও অভিবাক্তিতে মন্ত্র মুগ্ধের মতো করে পরিবেশন করেছেন বাফার শিল্পীবৃন্দ। পিনপতন নীরবতায় দর্শক যেন বিমোহিত হয়ে এই শিল্পীদের অপূর্ব নৃত্যকলা এবং সঙ্গীতে একাত্ম হয়ে উপভোগ করেছেন রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিকে ! সত্যি…শনিবারের সন্ধ্যায় দর্শক সারিতে বসে থাকা সকলের অন্তরকে উন্মামনায় মুগ্ধ করে দিয়েছিলো বাফার এই শিল্পীরা! আলো আঁধারীর ভিতরে মুহুর্মুহু করতালিতে সকলেই যেন ছিল মুগ্ধতায় উদ্বেলিত ! এতে যারা অংশ গ্রহণ করেন; মার্জিয়া স্মৃতি, অন্তরা সাহা, ঈশানি চৌধুরী, নির্মা গোলদার, মিথুন দেব, মৃদুলা আলম, নুজহাত ফাইজা, সানজিদা ইসলাম, আনিকা কাউসার, আনিকা সাহা, কৃষ্ণা, ঈশা, তিশা, আর্পিতা, নৈরিত, নির্ঝা, দিবা, চৈতন্য, মায়া, রিয়া এবং কথা ।
নৃত্যনাট্যের সমাপ্তির পরপর মঞ্চে আসেন বাফার প্রেসিডেন্ট ফরিদা ইয়াসমিন। সবাইকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে তিনি দর্শকদের পক্ষ থেকে প্রতিক্রিয়া জানতে শিল্পী ও মুক্তিযোদ্ধা তাজুল ইমামকে অনুরোধ জানান।
তাজুল ইমাম বলেন “অভিনন্দন নয় সবাইকে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাই। শতবর্ষ-পরে শত যোজন দূরে আমাদের প্রজন্ম তুলে ধরেছে রবি ঠাঁকুরের চিত্রাঙ্গদা। চল্লিশ বছর প্রবাস জীবনে অনেক অনুষ্ঠান আমি দেখেছি, দেখেছি সংস্কৃতির ফিউশন, বদলে যেতে দেখেছি অনেক কিছু কিন্তু বাফার এই পরিবেশনায় কোন ভুল দেখতে পাইনি। এঁরা আমাকে মুগ্ধ করেছে।” তিনি বাফার আরও সাফল্য কামনা করেন । চিত্রাঙ্গদার নৃত্য পরিচালনা, কস্টিউম ডিজাইন এবং কোরিওগ্রাফিতে ছিলেন অনুপ কুমার দাস।
নৃত্য নাট্যটির সংক্ষিপ্ত কাহিনী বাংলা এবং ইংরেজিতে পড়ে শোনান আনোয়ারুল হক লাভলু এবং মার্জিয়া স্মৃতি। অনুষ্ঠানটির গ্রন্থনা এবং উপস্থাপনায় ছিলেন শামীম আরা বেগম ও গোলাম মোস্তফা l এবং পুরো পরিবেশনার সার্বিক তত্ত্বাবধানে ছিলেন ফারজানা ইয়াসমিন।