মুহম্মদ শামসুল হক, নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র:
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি এবং প্রাকৃতিক প্রাচুর্যে ভরা সমৃদ্ধ বাংলাদেশ স্মরণাতীতকাল থেকে প্রকৃতির রূপসী কন্যা হিসেবে বিশ্ব পরিমন্ডলে পরিচিত। অসংখ্য খাল-বিল-নদী-নালা বাংলাদেশের বুক চিরে প্রবাহিত হয়েছে। এ সকল খাল-বিল-নদী-নালা জলাশয় বাংলাকে জালিকার মত চারদিক থেকে ঘিরে রেখেছে। প্রাকৃতিক অবদানের উপর নির্ভরশীল বাংলাদেশের জন্য এ সকল খাল-বিল-নদী-নালা বর্ষার মৌসুমে ভয়াল আকার ধারণ করে সমগ্র দেশকে তলিয়ে দেয়। আবার ঘূর্ণিঝড়, টর্নেডো, জলোচ্ছ্বাসের মত প্রাকৃতিক দুর্যোগের সাথে বাংলাদেশের রয়েছে রাহুর মিতালী। তদুপরি বাংলাদেশ বিশ্বের সর্বাপেক্ষা ঘন বসতিপূর্ণ দেশ হওয়ায় অনেক সময় প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়লে দেশবাসীকে অনাহারে ও অভুক্ত অবস্থায় দিন কাটাতে হত। ক্ষুধা-দারিদ্র্যের নির্মম কষাঘাতে জর্জরিত এবং প্রকৃতির নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে লড়াকু সৈনিক বাংলাদেশিরা এক পর্যায়ে বহির্গমণে বাধ্য হয়। খানিকটা চর্বিত চর্বণ মনে হলেও বলতে হচ্ছে: নেসেসিটি ইজ দ্য মাদার অব ইনভেনশন (প্রয়োজন আবিষ্কারের প্রসূতি)। প্রকৃতি নির্ভর চাষাবাদ ব্যবস্থা পুরোপুরি মার খাওয়ায় প্রয়োজনের তাগিদেই অদৃষ্ট নির্ভর বাঙালিরা ১৯৬০ এবং সত্তরের দশকে যাবতীয় ঘাত-প্রতিঘাতকে হাসিমুখে বরণ করে নিয়ে বহ্নিমুখ পতঙ্গের মত নিরুদ্দেশ যাত্রা শুরু করেছিল। আবার কিছু সংখ্যক শিপ জাম্পারও অপরিসীম সাহসে ভর করে আটলান্টিকের অপর পাড়ে মাথা গোঁজার ঠাই নিয়েছিল। অনেক ভাগ্যান্বেষী ও দুঃসাহসী যুবক বিভিন্ন দেশ পাড়ি দিয়ে শেষ পর্যন্ত অপার সম্ভাবনা এবং অঢেল প্রাচুর্যের দেশ আমেরিকায় যায়। ফলে বিশ্ব অভিবাসীর দেশ হিসেবে পরিচিত আমেরিকায় বিভিন্ন জনগোষ্ঠী ও দেশত্যাগীদের মত বাঙালিদের সংখ্যাও মোটামুটি ধর্তব্যের পর্যায়ে উপনীত হয়। অন্যদিকে স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে ভিসা লাভ সহজসাধ্য হওয়ায় পেশাগত প্রশিক্ষণ ও উন্নত শিক্ষা-দীক্ষা লাভের উদ্দেশ্যে কিছু সংখ্যক পেশাজীবী এবং প্রতিশ্রুতিশীল শিক্ষার্থীর আগমন ঘটে আমেরিকায়। বিশেষত নব্বইয়ের দশকে ওপি এবং ডিভি লটারী প্রবর্তনের সুবাদে বিশ্বের অপরাপর দেশের বাসিন্দাদের মত বহু সংখ্যক বাংলাদেশিরও যুক্তরাষ্ট্রে আগমন ঘটে। আবার পারিবারিক ভিসা এবং চাকরি ভিসায় আগত সবমিলিয়ে আমেরিকায় বাংলাদেশি প্রবাসীর সংখ্যা আশাতীত বৃদ্ধি পায়। এ পর্যায়ে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক প্রবাসী বাংলাদেশি প্রবাসের বৈরী ও প্রতিকূল আবহাওয়ার বিরুদ্ধে নিরলস সংগ্রাম করে এ দেশের মাটিতে ভাগ্যলক্ষ্মীকে ঘরে তুলতে সক্ষম হন। অনেকেই বাড়ি-ঘর এবং ছোট-খাট বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের মালিক হন। আবার এদেশে জন্ম নেয়া প্রবাসী বাংলাদেশিদের নতুন প্রজন্ম লেখা-পড়ায় কৃতিত্ব ও ব্যতিক্রমী প্রতিভার পরিচয় দিয়ে নিজেদের সহজাত সুপ্ত প্রতিভার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। তাদের অনেকে উচ্চ পেশায় নিয়োগ লাভ করে এবং কর্মক্ষেত্রে বিশেষ সুনামও অর্জন করে। এককথায় প্রবাস জীবনে সামগ্রিক বিচারে আটলান্টিকের এপারে প্রবাসী বাংলাদেশিরা যথেষ্ট যুতসই অবস্থান তৈরি করেছে।

নিউইয়র্কের জ্যাকসন হাইটস, ব্রুকলীনের চার্চ ম্যাকডোনাল্ড, হিলসাইডসহ সমগ্র আমেরিকার বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে প্রবাসী বাংলাদেশি অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে গড়ে উঠেছে প্রবাসী বাঙালিদের নিজস্ব নানা ধরনের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান, সংস্কৃতি চর্চার কেন্দ্র ও উপাসনালয়। মিশ্র সংস্কৃতি এবং বিচিত্র ভাষাভাষি আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশি গ্রোসারী, বিচিত্র নাম ও ধরণের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, চিকিৎসক, আইনজীবী, রিয়্যাল এস্টেট ব্যবসাসহ বিভিন্ন পেশাজীবী ভিত্তিক অফিস আদালত ও মসজিদ-মক্তব প্রবাসী বাংলাদেশিদের সাফল্যের গৌরবোজ্জ্বল প্রমাণ বহন করে। এ সকল প্রতিষ্ঠান ও উপসনালয়ের মাধ্যমে অপরাপর দেশের প্রবাসীরা বাংলাদেশ এবং বাংলার কৃষ্টি-সংস্কৃতি ধর্মীয় ও পারিবারিক মূল্যবোধ সম্পর্কে জানার সুযোগ লাভ করে। নব্বই দশকের সূচনালগ্নে সাবেক সাংসদ এম এম শাহীন নিজ পরিবারের সদস্যদের সার্বিক সহযোগিতা ও পৃষ্ঠপোষকতায় দেশের সাথে প্রবাসের সেতুবন্ধ রচনার বৃহত্তর স্বার্থে নিয়মিত সাময়িকী প্রকাশের ঝুঁকি নেন বলে জানা যায়। পরবর্তীতে জনাব শাহীনের পদাঙ্ক অনুসরণ করে আরও কয়েকজন তরুণ প্রবাসী নিউইয়র্ক থেকে বাংলা ভাষার সাপ্তাহিকী প্রকাশের উদ্যোগ নেন। বর্তমানে দেড় ডজনাধিক প্রিন্ট মিডিয়া এবং প্রায় অর্ধ ডজন ইলেকট্রনিক মিডিয়াও প্রবাসী বাংলাদেশিদের সাফল্যের গৌরবগাঁথা এতদিন প্রকাশ ও প্রচার করে আসছিল জোরে-সোরে। প্রবাসী বাঙালিদের সংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে রাতারাতি ব্যাঙের ছাতার মত গজে উঠেছিল শত শত রাজনৈতিক, অরাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় ও আঞ্চলিক সংগঠন। তবে বর্তমানে অধিকাংশ সংগঠনই আদর্শচ্যুত হয়ে পড়েছে বলে পত্রিকান্তরে প্রকাশ। আবার আটলান্টিকের এ পাড়ে প্রবাসী বাংলাদেশির সংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে বাঙালির সহ¯্র বছরের ঐতিহ্য, কৃষ্টি, মূল্যবোধ ও সংস্কৃতিতে আমূল পরিবর্তন সূচিত হয়েছে। পারস্পরিক সম্প্রীতির বন্ধনে ফাটল ধরেছে। পরচর্চা-পরশ্রীকাতরতা এবং রাজনৈতিক বিষোদগার প্রবাসী বাংলাদেশিদের চিরায়ত ভ্রাতৃত্ববোধ ও সহমর্মিতার অনুভূতির সমূল উৎপাটন করেছে। ভিন্ন মতাবলম্বী এবং প্রতিপক্ষীয় রাজনৈতিক আদর্শের বিশ্বাসীদের বিপদ-আপদে খোঁজ-খবর নিতেও সিংহভাগ প্রবাসী বাংলাদেশিদের মন এখন আর আগের মত সাড়া দেয়না। এককথায়, অন্ধ রাজনৈতিক মনস্কতা ও বাতিক প্রবাসী বাঙালিদের স্মরণাতীতকালের স্নেহ-মমতার বন্ধন ও মনুষ্যত্ব বোধের ভিতকে পুরোপুরি নড়বড়ে করে তুলেছে।
সন্দেহাতীতভাবে বলা যায়, আমেরিকা প্রবাসী প্রত্যেক বাংলাদেশির অন্তরেই স্বদেশ প্রেমের শাশ্বত ফল্গুধারা নিরন্তর প্রবাহিত হয় অহর্নিশ। প্রবাসের সহস্র ব্যস্ততা এবং প্রতিকূলতার মাঝেও স্বদেশে ফেলে আসা স্বজনদের স্নেহকাতর মুখচ্ছবি সারাক্ষণ তাদের মানসপট জুড়ে থাকে। তাই আত্মসুখ বিসর্জন দিয়ে হলেও উদয়াস্ত হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম ও জীবনঝুঁকি নিয়ে অর্জিত অর্থের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ তারা স্বদেশে প্রেরণ করেন মন ও বিবেকের তাড়নায়। করোনাভাইরাসের সর্বগ্রাসী থাবা উপেক্ষা করে এবারও পবিত্র ঈদুল ফেতরের আগে নিউইয়র্ক প্রবাসী বাংলাদেশিরা স্বদেশে অর্থ প্রেরণের ভয়ানক ঝুঁকি নিয়েছিলেন স্বদেশের স্বজনদের মুখে এক টুকরো হাসি ফোটানো ও তাদের দুর্দশা লাঘবের আশায়। বাংলাদেশ সরকার এবং বাংলাদেশে বসবাসকারী স্বজনরা চরম অনিশ্চয়তার মাঝে বসবাসকারী যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসীদের এই ত্যাগকে কতটুকু মূল্যায়ন করবেন তা ভবিতব্যের বিচার্য।
শ্রুতিকটু শোনালেও বাস্তবতার তাগিদে বলতে বাধ্য হচ্ছি, বাংলাদেশের রাজনৈতিক উচ্ছিষ্টভোগী তথাকথিত হোমরা-চোমরা ও লুটেরাদের দৃষ্টিতে প্রবাসী বাংলাদেশিরা বাস্তুহারা বা বাস্তুত্যাগী বা তৃতীয় শ্রেণীর নাগরিক। স্বদেশে নিজেদের প্রভূত সহায়-সম্পদ থাকা সত্ত্বেও রাজনৈতিক আদর্শচ্যুত ও উচ্ছিষ্টভোগীদের ভাষায় প্রবাসীদের অবস্থান না ঘরকা না ঘাটকা। রাজনীতির নামে এ শ্রেণীর ফায়দা ভোগীরা যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী বাংলাদেশিদের স্বদেশে রেখে আসা স্থাবর-অস্থাবর সহায় সম্পদ কুক্ষিগত করার জন্য সর্বদা ওঁৎ পেতে থাকে এবং প্রবাসীদের সহায়-সম্পদের অলিখিত দাবিদার মনে করে থাকে। তাই- প্রবাসীদের জান-মাল নিয়ে যথেচ্ছা খেলার অধিকারও ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের রয়েছে বলে তারা মনে মনে ধারণা পোষণ করে। নানা অজুহাতে তারা প্রবাসীদের সহায়-সম্পদ কুক্ষিগত করার লক্ষে ঊর্ণনাভের মত সর্বদা ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করতে থাকে। নানা অছিলায় হয়রানি এবং চাঁদা আদায়ের প্রসঙ্গ উত্থাপন করলে রচনার কলেবর দীর্ঘায়িত হতে বাধ্য। আবার আমেরিকার সংবিধান অনুসারে ন্যাচারালাইজড সিটিজেনরা বাংলাদেশি- আমেরিকান। এদেশে জন্ম নেয়া ছাড়া বাংলাদেশের কোন অভিবাসী বৈধভাবে সারা জীবন আমেরিকায় কাটিয়ে দিলেও তিনি বাংলাদেশি-আমেরিকান হিসেবেই পরিগণিত হবেন।
উপসংহার: ৭০ এবং আশির দশকের গোড়ার দিকে জীবনঝুঁকি নিয়ে আমেরিকায় পাড়ি জমানো বাংলাদেশিদের বেশির ভাগের বয়স এখন যাটের উর্ধ্বে। বার্ধক্যজনিত রোগ-ব্যাধি ছাড়াও অনেকের শরীরে বাসা বেধেছে নানা জটিল রোগ-ব্যাধি। তাদের বেশির ভাগ অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দুশ্চিন্তায় ইতোমধ্যেই দিগি¦দিকজ্ঞানশূন্যের মত হতাশার সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছেন। অতীত অভিজ্ঞতার আলোকে বলা যায়, স্বদেশ প্রবাসীদের কষ্টার্জিত ডলারকে স্বাগত জানালেও বয়োবৃদ্ধ-অসহায়-জ্বরাগ্রস্ত আমেরিকা প্রবাসীদের প্রতি ন্যূনতম সহানুভূতি প্রদর্শন করবে তেমন আশা করা দুরাশার সামিল। তাই নিজেদের বহু কষ্টার্জিত অর্থ দেশে পাঠিয়ে যে সকল প্রবাসী এতদিন পর্যন্ত বাংলাদেশের অর্থনীতির ঘূর্ণায়মান অচল চাকায় দু/চার বিন্দু তেল যুগিয়েছেন বর্তমানের চরম যুগসন্ধিক্ষণে স্বদেশে তাদের আশ্রয় লাভ কতটুকু নিশ্চিত তা প্রশ্নাতীত নয়। খনার বচন অনুসারে, স্বদেশের জন্য যারা ত্যাগ স্বীকার করেন তারা স্বদেশের কাছ থেকে তেমন কিছুই পান না কিংবা প্রত্যাশা করতে পারেন না। কারণ স্বার্থান্বেষী লুটেরা গোষ্ঠীই স্বদেশ এবং স্বদেশবাসীর সহায়-সম্পদ লুটে-পুটে খায় এবং সর্বদা গাছেরও খায় তলারও কুড়ায়। এমনতর বাস্তবতায় বয়োবৃদ্ধ ও শারীরিক, মানসিক ও আর্থিকভাবে জ্বরাজীর্ণ প্রবাসীদের আহ্বানে সাড়া দেয়ার জন্য স্বদেশে কেউ আছেন কি-না তা জানার প্রবল তাগিদ বোধ করছি।
(সহযোগী সম্পাদক, ঠিকানা, নিউইয়র্ক)।