আখি সীমা কাওসার: বদলে যাচ্ছে পৃথিবী। শুধু কি বদলাচ্ছে পৃথিবী এবং পৃথিবীর মানুষগুলো? তা কিন্তু নয়, বদলে গেছে ইতিমধ্যে। করোনার প্রাদুর্ভাবে পৃথিবীর অনেক কিছুই বদলেছে, বদলেছে আমাদের মুখের অবয়ব। মেকআপ করে বদলে ফেলা সুন্দর নান্দনিক, চেহারাটি আমরা আর এখন সম্পূর্ণই দেখাতে পারছিনা, কারণ গরু এবং মহিষ, ঘোড়ার সেই খাঁচাটা এখন কিন্তু আমাদের মুখের অর্ধেক অংশ জুড়ে স্থান করে নিয়েছে। বাঁচতে হলে বা অন্যকে বাঁচাতে হলে মুখে এই মাস্ক, গরু ঘোড়ার খাঁচাটি রাখতেই হবে। যখনই আমরা বাহিরে বের হবো, লোকালয়ে যাবো, মার্কেটে যাবো, যেখানেই যাবো উপায় নেই, একেবারেই কোন উপায় নেই, রাখতে হবে, ইচ্ছায় হোক, আর ইচ্ছার বিরুদ্ধে হোক।
একটা জিনিষ ভাবুনতো? আছে কি, কোন শক্তি আমাদের? করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করার? হয়তোবা একটাই হবে করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা, বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার ঘোষণা অনুযায়ী, মুখে মাস্ক লাগানো এবং হাত পরিষ্কার রাখা একটু সতর্ক হয়ে চলা, সেটাই হবে করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা। যতদিন না সঠিকভাবে ভ্যাকসিন আবিষ্কার না হয়। আমরাতো কতভাবে কত দেশের বিরুদ্ধে মানুষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করি।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা তারাও কিন্তু কোনো কূলকিনারা পাচ্ছেনা। হিমশিম খাচ্ছে ভ্যাকসিন আবিষ্কার করতে। পৃথিবীর বড় বড় হসপিটাল, তাদের সিনিয়র বিজ্ঞানী, ডাক্তারদের দিয়ে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। রাতদিন লেভি কাটিয়ে দিচ্ছে ভ্যাকসিন আবিস্কার করার জন্য। পৃথিবীতে বড় বড় স্বাস্থ্য বিজ্ঞানীরা হয়রান, এখনো কোনো সুরাহা বের করতে পারেনাই সঠিকভাবে। যদিও আমরা শুনছি কোন কোন দেশে, খুব শীঘ্রই ভ্যাকসিন আসছে । কিন্তু তাও একেবারেই সঠিকভাবে নয়। একেবারেই এখনো কেউ বলতে পারছে না নির্দিষ্টভাবে যে, আমাদের ভ্যাকসিনটি আমরা করোনার বিরুদ্ধে জনগণের শরীরে প্রয়োগ করতে পারবো? বা করোনার বিরুদ্ধে কাজ করবে? অন-দা টেস্টটে, কিছু কিছু দেশ সিদ্ধান্ত নিয়েছে এই ভ্যাকসিন নিতে যারা আগ্রহ প্রকাশ করবে তাদেরকে শর্তসাপেক্ষে অর্থাৎ পুরস্কৃত করে তাদের শরীরে পুশ করবে। এখন প্রশ্ন কয়জন স্ব-ইচ্ছায় এ ভ্যাকসিন নিজ শরীরে পুশ করবে?
তার মানে কি দাঁড়ালো? যে হয়তোবা পুশকৃত ভ্যাকসিন শরীরে করোনার বিরুদ্ধে কাজ করতে পারে, অথবা মৃত্যর মতো ঘটনাও ঘুরতে পারে। যে শরীরে করোনার ভ্যাকসিন নেবে তার বেলায়।
আমরা সঠিকভাবে এখনো বলতে পারছেনা, আসলেই কি তাদের আবিষ্কৃত ভ্যাকসিন করোনা ভাইরাস ঠেকাতে কার্যকরী কিনা? তদুপরি এখনো অজানাই রয়ে গেল কখন নাগাদ সত্যি সত্যিই ভ্যাকসিন করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবার জন্য আমাদের শরীরে পুশ করবে। তাহলে আমরা কিসের এত বড়াই করি?
ঘুষ দূর্নীতি, মানুষের সম্পদ লুটপাট করে, ভেজাল খাদ্য খাইয়ে, ভেজাল ওষুধ আবিষ্কার করে, হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করে কি লাভ? এত সম্পত্তি, টাকার কি কোন মূল্য আছে? অন্যের বিরুদ্ধে আমাদের হুমকি-ধমকি, মানুষের উপর অত্যাচার, রেপ ধর্ষণ, যেন পুরুষ মানুষের আর কোন কিছুই করবার নেই? পুরুষ মানুষ গুলো (অবশ্যই সব পুরুষ নয়) রেপ করবার প্রতিযোগিতায় নেমেছে। আর ঘুষ দূর্নীতিবাজরা ঘুষ-দুর্নীতি করবার প্রতিযোগিতায় নেমেছে, কে কত ঘুষ দূর্নীতি করে টাকার পাহাড় করা যায়।একটিবারও কি ভেবেছে, ভাবছেন যে টাকাটা আপনি ভোগ করতে পারবেন কিনা? কাজেই গরু এবং ঘোড়ার সেই খাঁচা (করোনার দেয়া, গিফট নাম হলো মাস্ক) স্বয়ং আমাদের মুখের অবয়ব ঢাকবার জন্য মাস্ক নামে স্বীকৃতি দিয়েছি, আমাদের নাক-মুখ ঢাকবার জন্য । যেন করোনার জীবাণু, আমার মাধ্যমে অন্যের মধ্যে না ছড়িয়ে যায়, কথা বলার সময়।
করোনার দ্বিতীয় প্রতাপ চলছে, পৃথিবীর অনেক দেশেই, দাবিয়ে বেড়াচ্ছে করোনা। অনেককেই দেখছি অগ্রাহ্য করেছেন করোনাকে, ভাবছেন আমার কি আর হবে? ভুলে যাবেন না গরুর মুখেই যে (কাঁয়ির, নোয়াখালীর ভাষায় গরুর মুখের খাঁচাকে কাঁয়ির বলে) খাঁচা ছিল, সেটা আজ সৃষ্টির সেরা জীব মানুষের মুখে। বদলে যাচ্ছে পৃথিবীর অনেক কিছু, আবহাওয়া বদলেছে, গরমের সময় অনেক গরম হচ্ছে, শীতের সময় কমে গেছে শীত, বাংলাদেশে পৌষ মাসের শীত এখন আর মানুষ অনুভব করে? ছোটবেলায় আমরা দেখেছি নভেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে, মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত, গ্রাম গঞ্জের দূর্বাঘাস কুয়াশাচ্ছন্ন থাকে, পথে ঘাটে, ঘাসে জমে থাকা শিশির কণা, খালি পায়ে হাঁটলে ভিজে যেত।
কনকনে শীতে লেপ, কাঁথা দিয়ে মুড়িয়ে থাকতাম। সকাল বেলায় উঠতে ইচ্ছে করতো না। এখন আর সেই শীত কি বাংলাদেশে লক্ষ্য করা যায়? না যায় না, সেই সকাল, কি এখন আছে? দাদী, নানীরা মাটির একটি পাত্রের মধ্যে ধানের ভুসি দিয়ে, (নোয়াখালীর ভাষায় যাকে তুষ বলে, আগুনের পাত্রকে বলে বশ্বি) উপরে চুলা থেকে কয়লার আগুন রেখে দিত সারারাত, সকাল বেলায় সে আগুনের পাত্র নিয়ে, সবার কি কাড়াকাড়ি। শুধু ঠাণ্ডা হাতটুকু একটু গরম করার জন্য।
ইস কি আনন্দ, আর সুখের সেই মুহূর্তগুলো। এখনতো ডিজিটাল জামানা। শীতের দেশে থাকি। এই শীতের দেশেও বিশ বছর আগের শরীর কাঁপানো শীত এখন নেই। যে শীত সকালবেলায় অনুভব করতাম, ঘরের ভিতরে থেকেও যদি মুখ দিয়ে হা করতাম, মুখ থেকে ধোঁয়া বের হতো । বাচ্চাদের সাথে এক খেলায় মেতে উঠতাম। কে কত ধোঁয়া বের করতে পারে।
জানালা খুলে দেখতে পেতাম বাসা বাড়ির সমস্ত ছাদগুলো সাদা বরফে ঢেকে আছে, গাড়ির উপরে বরফের স্তুপ, আমার হাজব্যান্ডকে দেখতাম মাঝে মধ্যে নিচে নেমে সেই বরফের উপরে আমার নাম, আমার বাচ্চাদের নাম লিখছে।সেগুলো এখন স্মৃতি। আস্তে আস্তে ইউরোপ থেকেও হারিয়ে গেছে নভেম্বর থেকে মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত তুষার বৃষ্টিপাত দেখা দৃশ্য। প্রকৃতির কাছে আমরা এখন চরম অসহায় হয়ে পড়েছি ।
মাঝে মাঝে মনে হয় আসলেই তো প্রকৃতি আমাদের উপর চরম প্রতিশোধ নিচ্ছে । কারণ আমরা বড় নিষ্ঠুর আচরণ করেছি প্রকৃতির সাথে।
পৃথিবীতে গ্রীণ হাউজ অনেক বেড়ে গেছে, আমরা যারা ইউরোপ-আমেরিকায় কানাডায় থাকি তারা কিন্তু হিটার দিয়ে ঘর গরম করে স্থানীয় পর্যায়ে তাপমাত্রা করে রাখি । কিন্তু সে আমেজ টুকু আর পাইনা। আগুনের পাত্রের উপর হাত গরম করার আমেজ। আহারে পৃথিবী থেকে কত সুন্দর সুন্দর আবহাওয়া, কত সুন্দর স্মৃতি, দিন হারিয়ে গেল। হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের চলাফেরার উন্মুক্ত দৃশ্য। সামনে কত কঠিন সময় পার করবে আমাদের প্রজন্ম। আমরা আসলেই অনেক ভাগ্যবান, ভাগ্যবান আমাদের মা চাচীরা। যখন বৃষ্টি হবার কথা তখন বৃষ্টি হচ্ছে না, যখন সুন্দর সুন্দর আবহাওয়া উপভোগ করবার কথা কথা তখন আবার সেটা হচ্ছে না। অর্থাৎ প্রকৃতি যেমন বদলে গেছে আমাদের কারণে, পৃথিবীর অনেক দেশে প্রাকৃতিক দূর্যোগ বেশি বেশি হচ্ছে ।
আগুনে ঝলসে যাচ্ছে আমাজনের মত বনাঞ্চল। হিমালয়ের বরফ গলে যাচ্ছে।সূর্যের তাপ প্রতিবছর অনেক বেশি গুণ বাড়ছে, অসহনীয় গরম অনুভব করছে পৃথিবীর মানুষ। এতকিছু বদলানোর পরেও মানুষ হিসেবে আমাদের চরিত্র একটু বদলায়নি। প্রকৃতি বদলে যাচ্ছে, এটার জন্য দায়ী আমরা মানুষেরা। আমরা মানুষেরা অন্যায় অবিচার করেই যাচ্ছি একের পর এক। ধর্ষক পুরুষেরা নারীকে ধর্ষণ করে সেই ভিডিও প্রচার করছে সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে, নারী হয়ে বড় লজ্জা পাচ্ছি কষ্টে বুকটা ফেটে যাচ্ছে। মানুষ কত বদলে গেছে নিকৃষ্টভাবে? কত হায়েনার নিষ্ঠুর, জংলি জানোয়ার, পশুর থেকেও বদলে গেছে এই ধর্ষক পুরুষ মানুষ গুলো (আমি ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি, আমি সব পুরুষকে এক ভাবছিনা। এমনও পুরুষ আমার চোখে আছে, যাদেরকে মাথা নত করে শ্রদ্ধা করতে ইচ্ছে করে) অথচ বদলানো উচিত ছিল নিজেকে নিজের চরিত্রকে। তাইতো আজ নির্মল সুন্দর এই পৃথিবীর প্রকৃতি প্রতিশোধ নিচ্ছে আমাদের উপর। ২০১৯ এর পৃথিবী, আর ফিরে পাবো কিনা জানি না?
তবে এটুকু শিওর পৃথিবী বদলাতে হবে আমাদেরকে, বদলাতে হবে আমাদের মন-মানসিকতাকে। যে অত্যাচার প্রকৃতির উপর করেছে মানুষ, যে অত্যাচার আমরা মানুষ হয়ে মানুষের উপর করেছি, বিধাতা, বিধাতার ধৈর্য সীমার বাইরে চলে গেছে, তাইতো বিধাতা আজকে দুনিয়ার মানুষের মুখে গরু এবং ঘোড়ার ঐ খাঁচা মানুষের মুখে আ’জনমের জন্য তুলে দিয়েছে। কারো বাপের সাধ্য নেই, কারো সাধ্য নেই, এই খাঁচা মুখে না লাগিয়ে জনসমাগমে মার্কেটে কিংবা কোন ফাংশনে চলে।
সুন্দর একটি পৃথিবী পাবার জন্য দুই হাত তুলে ফরিয়াদ করি একমাত্র মালিক আমাদের আল্লাহর কাছে। তিনি আমাদের সকলকে ক্ষমা করে দেন, আর আমাদের সকলকে ফিরিয়ে দেন সেই আগের সুন্দর নির্মল পৃথিবী।পৃথিবীর সৃষ্টি কর্তা তিনি। তিনি যদি কোনদিন মানুষের উপর খুশি হন, হয়তোবা এই কঠিন ভাইরাস, করোনা ভাইরাস পৃথিবী থেকে নির্মূল করবেন। সেটা একমাত্র মানুষের অ্যাটিটিউড এবং মানুষে চারিত্রিক বদলানোর উপর নির্ভর করবে। আসুন বদলে গেছে পৃথিবী আমরাও বদলাই। আমাদের মন-মানসিকতা, আমাদের চরিত্র যেটুকু যত নোংরা আছে, তা বদলে ফেলি। আমরা সুন্দর একটা পৃথিবী পাবার জন্য চেষ্টা করি সম্মিলিতভাবে।
সুন্দর একটি পৃথিবী পাবার প্রত্যাশায়।
লেখক: ইতালি প্রবাসী, সাংবাদিক।