ইসরাত জেবিন
বিগত বছরগুলোতে বিশ্ব রাজনীতিতে যে বড় ধরনের পরিবর্তন দেখা গেছে তার মধ্যে অন্যতম একটি উদাহরণ হচ্ছে ফ্রান্সের বর্তমান প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাখোঁ। মাত্র ৩৯ বছর বয়সে মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলোকে পিছনে ফেলে ২০১৭ সালে মে মাসে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন ম্যাখোঁ। প্রবাস মেলার এবারের ফ্যাক্ট এবাউটে ইউরোপীয় ইউনিয়নপন্থী ফ্রান্সের এই প্রেসিডেন্ট এর আদ্যোপান্ত তুলে ধরা হলো-
কে এই এমানুয়েল ম্যাখোঁ: ফ্রান্সের বর্তমান প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাখোঁ। পুরো নাম Emmanuel Jean-Michel Frédéric Macron. জন্ম উত্তর ফ্রান্সের আমিয়েন্স শহরে ১৯৭৭ সালের ২১ ডিসেম্বর। পড়াশোনা করেছেন Paris Nanterre University তে, Sciences Po থেকে Masters of Public Affairs করার পর ২০০৪ সালে École nationale d’administration (ENA) তে ভর্তি হন রাজনীতির শিক্ষাটা একটু ঝালিয়ে নিতে। রাজনীতিতে যোগ দেয়ার আগে তিনি সরকারি চাকরিজীবী হিসেবে ইন্সপেক্টর অফ ফাইনান্স এর দায়িত্ব পালন করেন। তারপর রথচাইল্ড এ ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকার হিসাবে যোগ দেন।
রাজনৈতিক ইতিহাস: সাবেক রাষ্ট্রপতি ফ্রাঁসোয়া ওলাঁদ-এর সময় ম্যাখোঁ উপ মহাসচিব হিসাবে ২০১২ সালে কাজ করেন এবং ২০০৬ থেকে ২০০৯ ফ্রান্সের সোশালিস্ট পার্টিতে ছিলেন। ২০১৪ সালে তিনি অর্থনীতি, ইন্ডাস্ট্রি ও ডিজিটাল এ্যাফেয়ার্স এর মন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। এ সময় ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ তৈরিতে কাজ করলেও তার উদার সংস্কারগুলো সমালোচনার শিকার হয়। সংসদে পিছনের আসনে বসে থাকলেও সরকারের কাজের সমালোচনা করতে ম্যাখোঁ পিছপা হননি। শ্রমিকদের জন্যে সংস্কারে তার নীতিকে তথাকথিত ‘ম্যাখোঁ ল’ হিসেবে উপহাসও করা হয়। কিন্তু এতে দমে যাননি তিনি। নভেম্বর ২০১৬ সালে ম্যাখোঁ ফ্রান্সের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রতিযোগিতা করার জন্য মন্ত্রীর পদ থেক ইস্তফা দেন। ২০১৭ সালের ৭ মে হওয়া নির্বাচনে প্রথমবারের মত জয়লাভ করে প্রেসিডেন্ট হন তিনি। এরপর ২০১৭ সালে জুনে হওয়া সংসদ নির্বাচনে এমানুয়েলের পার্টি La République en marche (LREM) সমমনা অপর দল Democratic Movement (MoDem) এর সাথে মিলিতভাবে জাতীয় সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন লাভ করে।
প্রেসিডেন্ট নির্বাচন: ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রথম পর্ব অনুষ্ঠিত হয় ২৩ এপ্রিল ২০১৭ তে। প্রথম পর্বে ১১ জন প্রার্থীই প্রতিযোগিতায় নামেন। তাঁদের মধ্যে যে দুই প্রার্থী সবচেয়ে বেশি ভোট পান, তাঁদের মধ্যে সরাসরি প্রতিদ্বন্দ্বীতা হয় দ্বিতীয় পর্বে। দ্বিতীয় পর্বের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ৭ মে।
ফ্রান্সের নির্বাচনে আশ্চর্যজনকভাবে মূল স্রোতের বাইরে থেকে উঠে আসে মূল পর্বের দুই প্রতিদ্বন্দ্বী। একজন মাত্র ৩৯ বছর বয়স্ক মধ্যপন্থী প্রার্থী এমানুয়েল ম্যাখোঁ এবং অপরজন চরম দক্ষিণপন্থী ন্যাশানাল ফ্রন্ট দলের নেত্রী মারিন ল্য পেন। জনপ্রিয়তার বিচারে তাদের পরে ছিলেন রক্ষণশীল দলের প্রার্থী ফ্রঁসোয়া ফিয়ঁ। তারপর ব্যাডিকাল বাম প্রার্থী জঁ লুক মেলাঁশোঁ এবং সমর্থনের বিচারে সবচেয়ে পিছিয়ে ছিলেন সমাজতন্ত্রী দলের প্রার্থী বেনোয়া আমোঁ। ৭ মে নির্বাচনে জিতে প্রেসিডেন্ট ফ্রঁসোয়া ওলাঁদ-এর কাছ থেকে কার্যভার গ্রহণ করেন ম্যাখোঁ।
প্রেসিডেন্ট ম্যাখোঁ: বিপ্লবোত্তর ফ্রান্সের কনিষ্ঠতম প্রেসিডেন্ট ৩৯ বছর বয়সী ম্যাখোঁ যখন ফ্রান্সের ক্ষমতায় আসেন তখন ফ্রান্সের অর্থনীতি নানা সমস্যায় জর্জরিত। জয়ের পর এমানুয়েল ম্যাখোঁ ফ্রান্সের সমাজে তীব্র বিভাজনের কথাও স্বীকার করে নেন। তিনি বলেন, তিনি মানুষের ক্রোধ, উৎকণ্ঠা, সংশয় সম্পর্কে সচেতন। তিনি মন দিয়ে সেই কণ্ঠ শুনবেন বলে কথা দেন এবং ইউরোপের নাগরিক ও ইউরোপের মধ্যে সংযোগ আবার গড়ে তোলায় সচেষ্ট হবেন বলেও জানান। শূন্য থেকে শুরু করা তার রাজনৈতিক দল সংসদে এখন সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং নতুন সরকার ইতিমধ্যেই জনগণের উন্নয়নের জন্য কাজ করছেন। ক্ষমতায় এসেই ম্যাখোঁ জনগণকে দেখানো স্বপ্ন বাস্তবায়নে কাজ করা শুরু করেন। ফ্রান্সের অর্থনীতিকে আরও শক্তিশালী এবং ডায়নামিক করে তোলার জন্য অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং বেকারত্ব কমিয়ে আনায় সচেষ্ট হন।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের সমর্থক: ফ্রান্সের পাশাপাশি পুরো ইউরোপকে শক্তিশালী করে তোলার যে মন্ত্র তিনি সবাইকে শুনিয়েছেন তা তার এই চেষ্টায় নতুন প্রাণ সঞ্চার করেছে। অভিবাসন, জলবায়ু পরিবর্তন, সন্ত্রাস, প্রযুক্তির ব্যবহার আজকের পৃথিবীতে সবকিছু আরও কঠিন করে তুলেছে। কিন্তু এসব মোকাবেলায় ম্যাখোঁ যে পদক্ষেপ নিয়েছেন তাতে তিনি সফলভাবেই এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে পারবেন বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন।
ব্যক্তিগত জীবন: এমানুয়েল ম্যাখোঁর ব্যক্তিগত জীবনের ঘটনাও এসব বৈচিত্র্যপূর্ণ। তার স্ত্রী ব্রিজিত তোনিয়ো তার থেকে ২৫ বছরের বড়। বর্তমানে ব্রিজিতের বয়স ৬৪ বছর। ব্রিজিত তনিয়ো ছিলেন ম্যাখোঁনের স্কুলের শিক্ষিকা। মাত্র ১৬ বছর বয়সে ৪১ বছরের ব্রিজিতেরর প্রেমে পরেন ম্যাখোঁ। ধীরে ধীরে তার মন জয় করে নেন ম্যাখোঁ। এরপর নানা প্রতিকূলতা ফেরিয়ে ২০০৭ সালে তিন সন্তানের জননী ব্রিজিথকে বিয়ে করেন ম্যাখোঁ। তাদের দু’জনের বয়সের ব্যবধান নিয়ে অনেক কথা শুনতে হয়েছে তাদের। মাঝেমধ্যে এসব সমালোচনার জবাবও দিয়েছেন এমানুয়েল।
একবার তিনি বলেছিলেন, “বয়সের ব্যবধানটা যদি উল্টো হতো অর্থাৎ আমি যদি আমার স্ত্রীর চেয়ে ২৪ বছরের বড় হতাম, তাহলে বিষয়টিকে কেউ অস্বাভাবিক বলতো না। মানুষ ভিন্ন কিছু দেখে অভ্যস্ত নয়।”
অনেকেই মনে করেন ম্যাখোঁনের প্রেম এবং বিয়ে তাঁর জীবনে ‘আত্মবিশ্বাস’ তৈরিতে একটি প্রভাব ফেলেছে। ফরাসি একজন সাংবাদিক সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, মি: ম্যাখোঁ যদি তার চেয়ে ২৪ বছরের বড় এবং তিন সন্তানের এক জননীকে আকর্ষণ করতে পারেন, তাহলে একই উপায়ে তিনি ফ্রান্সকেও জয় করতে পারবেন।
সম্পূর্ণ শূন্য থেকে আজকের ফ্রান্সের সর্বসেরা হয়ে উঠা এমানুয়েল ম্যাখোঁ এক অসাধারণ ব্যক্তিই বটে। নিজের রাজনৈতিক এবং ব্যক্তিগত জীবনে যে সফলতার চিহ্ন তিনি রেখেছেন তাতে তাকে “The boy Wonder” বললেও ভুল কিছু বলা হবে না।
সাম্প্রতিক সরকারবিরোধী বিক্ষোভ: ফ্রান্সের অর্থনৈতিক সংকট ও জ্বালানীর উপর ব্যয় বাড়ানোর প্রতিবাদে ১৭ নভেম্বর থেকে সরকারবিরোধী আন্দোলন ধীরে ধীরে পুঁজিবাদ বিরোধী ‘হলুদ জ্যাকেট’ আন্দোলনে রূপ নেয়। এতে বেশ কিছু লোক নিহত ও শত শত লোক আহত হয়। শেষ পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট ম্যাখোঁ নিম্ন আয়ের মানুষের বেতন বাড়ানোর পাশাপাশি সামাজিক ও অর্থনৈতিক খাতে জরুরী সংস্কারের ঘোষণা দিয়ে আন্দোলনের ইতি ঘটাতে সক্ষম হন।