অগ্রগামী সময়ের হাত ধরে, বুকে অজস্র স্বপ্ন ধারণ করে বিশ্বেরর দেশে দেশে, নগরে নগরে বাংলাদেশিরা বসতি গড়ে তুলেছেন। অনেকেই চাকরি, ব্যবসা বাণিজ্য, সমাজসেবা ও উন্নয়ন ভাবনায় আকাশ ছোঁয়া সাফল্য দেখিয়েছেন। তেমনি একজন যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী জসিম উদ্দিন। সম্প্রতি তিনি মাতৃভূমি বাংলাদেশ সফরে এসে ‘প্রবাস মেলা’ কার্যালয় পরিদর্শন করেন। ‘প্রবাস মেলা’ পরিবারের সদস্যদের সাথে আলোচনায় উঠে আসে তার প্রবাস জীবনের নানা কথা। সেসবের চুম্বক অংশ তুলে ধরছেন প্রবাস মেলা’র সম্পাদক শরীফ মুহম্মদ রাশেদ।
জসিম উদ্দিনের জন্ম পর্যটন শহর কক্সবাজার জেলায়। তিনি কক্সবাজার জেলা স্কুল থেকে এসএসসি, চট্টগ্রাম কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করেন। পরে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসা শিক্ষা অনুষদে। অনার্সে পড়াকালিন সময়ে উচ্চ শিক্ষার জন্য পাড়ি জমান যুক্তরাষ্ট্রের জর্জিয়া স্টেটে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এইচএসসি পাশ করে মনস্থির করলাম বিদেশের কোন নামকরা বিশ^বিদ্যালয় থেকে আমি উচ্চ শিক্ষা অর্জন করবো। এরই মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম। পাশাপাশি আমেরিকায় উচ্চ শিক্ষার জন্য এ্যাপ্লাই করলাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বৎসর পড়া শেষে যুক্তরাষ্ট্রের জর্জিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটিতে আমার ভর্তি কনফার্ম হলো। তাই ১৯৮৭ সালে আমি আমার উচ্চ শিক্ষার স্বপ্ন পূরণের জন্য আমেরিকা চলে যাই এবং ঐ ইউনিভার্সিটি থেকে ফিন্যান্স এ্যান্ড রিস্ক ম্যানেজমেন্টের উপর গ্র্যাজুয়েট ডিগ্রি অর্জন করি। বর্তমানে আপনি কি করছেন জানতে চাইলে কৃতি এ প্রবাসী বলেন, বর্তমানে আমি ব্যবসা করছি। আমার প্রতিষ্ঠানের নাম USA Envestment & Financial Group. এটি মূলত ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠান পর্যায়ে ইন্সুরেন্স কাভারেজ, কনসালটেন্সি সহ নানা ধরণের সার্ভিস অরিয়েন্টেড কাজ করে থাকে। আমি এই প্রতিষ্ঠানের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি।
জসিম উদ্দিন পেশাগতভাবে ব্যবসা বাণিজ্যে নিয়োজিত থাকলেও তিনি আমেরিকার বাংলাদেশি কমিউনিটির একজন উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব। শত ব্যস্ততার মাঝেও কমিউনিটির নানা সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডেও তিনি সদা তৎপর রয়েছেন। বর্তমানে তিনি Bangladesh Association in Geogiaর প্রেসিডেন্ট। এছাড়া তিনি আমেরিকা তথা বিশ্বে প্রবাসী বাংলাদেশিদের সবচাইতে প্রভাবশালী সংগঠন Fedaration Of Bangladesh Association in North America (FOBANA) ফোবানা’র একজন সক্রিয় গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। বিভিন্ন সময় তিনি এ সংগঠনের বহু দায়িত্বশীল পদে নিয়োজিত থেকে প্রবাসীদের সার্বিক কল্যাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। ২০০৬ সালে তিনি ফোবানার কনভেনর, ২০০৭ সালে এক্সিকিউটিভ সেক্রেটারি, ২০১২ সালে চেয়ারম্যান, ২০১৩ সালে হোস্ট প্রেসিডেন্ট-এর পদ অলংকৃত করেছেন। এছাড়া চলতি বছর জুলাইতে অনুষ্ঠিতব্য ফোবানা সম্মেলনের তিনি হোস্ট কনভেনর হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। সুতরাং বলা যায় ফোবানার সাথে তার আত্মিক সম্পর্ক রয়েছে। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ফোবানা আমাদের প্রাণের সংগঠন। ‘উত্তর আমেরিকার বাংলাদেশি বাঙালি কমিউনিটিকে ঐক্যবদ্ধভাবে সংগঠিত করে স্বীয় সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের বিকাশের পাশাপাশি উত্তর আমেরিকার মূলধারায় রাজনৈতিক এবং সামাজিক অবস্থান সৃষ্টি করার লক্ষ্যে ১৯৮৭ সালে ওয়াশিংটনে সম্মেলনের মধ্য দিয়ে ফেডারেশন অব বাংলাদেশি এসোশিয়েশনস অব নর্থ আমেরিকা তথা ফোবানার জন্ম হয়।’ এটি একচুয়েলি আমব্রেলা অর্গানাইজেশন অব অল বাংলাদেশি এসোসিয়েশন। এই মুহূর্তে পুরো আমেরিকার বিভিন্ন স্টেট থেকে আমাদের সাথে ৮৮টি অর্গানাইজেশন আছে। প্রতিবছরই আমরা একটা কনভেনশন করে থাকি সেটা অলমোস্ট মিলনমেলার মত। এই সংগঠনে আমাদের ১৮টি কমিটি আছে সেগুলোকে বলে স্ট্যান্ডিং কমিটি। সেখানে মেইনস্ট্রিম কমিটি আছে, যারা মেইনস্ট্রিম সিনেটের কংগ্রেসম্যান হাউজ অব রিপ্রেজেন্টিটিভ তাদের সাথে ওয়ার্ক করে। বাংলাদেশের ইন্টারেস্ট নিয়ে তারা সজাগ থাকেন, যে কোন ইস্যুতে ওই মেইনস্ট্রিম কমিটি বিভিন্ন স্টেটে নিজস্ব কংগ্রেসম্যান সিনেটরদের সাথে যোগাযোগ রাখে।
জসিম উদ্দিন বলেন, ফোবানা এর ২০১৮ সালের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে জর্জিয়া ওয়ার্ল্ড কংগ্রেস সেন্টারে। ২৭, ২৮ ও ২৯ জুলাই তিন দিনব্যাপী ফোবানা সম্মেলনের আয়োজনে রয়েছে জর্জিয়ার, বাংলাদেশি আমেরিকান অ্যাসোসিয়েশন অব জর্জিয়া। এর আগে ১৯৯৯, ২০০৬ ও ২০১৩ সালে আটলান্টায় এ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ‘জর্জিয়া অন মাই মাইন্ড’ স্লোগান সামনে দীর্ঘ পাঁচ বছর পর চতুর্থবারের মতো সম্মেলনটি এবারও আটলান্টায় অনুষ্ঠিত হবে। দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতাগুলো কাজে লাগিয়ে এবারে সফল ও সুন্দর সম্মেলন করার প্রত্যাশা রয়েছে। এ ছাড়া এবারের সম্মেলনে অতীতের সব ভুলভ্রান্তিও শোধরানো হবে বলে আশা করছেন তিনি। শুধু উত্তর আমেরিকাই নয়, স্বদেশের প্রতিও ফোবানার দায়বদ্ধতা রয়েছে। সেই চেতনাকে ধারণ করেই প্রবাসের মাটিতে এই সুদীর্ঘ সময় ধরে বাংলার সংস্কৃতি ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে সমুন্নত রাখতে কাজ করছে ফোবানা। এবার আরও কতগুলো বিষয়ের দিকে আমাদের লক্ষ্য আছে। ফোবানা শুরু হয়েছিল সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক ভিশন নিয়ে সেখান থেকে ফোবানা বিভিন্নভাবে এগিয়ে এসেছে। আর এখন ফোবানা সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক এর সাথে বিজনেস ইনভেস্টমেন্ট এবং নিউ জেনারেশন ইন আমেরিকা- আমাদের ছেলেমেয়েরা যারা আছে তাদের দিকেও আমরা ফোকাস করছি। ওমেন এমপাওয়ারমেন্টেও কাজ করছে ফোবানা। এর সাথে আরেকটি জিনিস অ্যাড করে- বিজনেসম্যানদের কথা বললেন। যেমন, গত বছর বিজনেসম্যানদের নিয়ে আমাদের একটা প্রোগ্রাম হয় সেখানে আমরা ওই টিপিক্যাল মেইনস্ট্রিম বিজনেস ম্যানদের নিয়ে আসি। মেইনস্ট্রিম পলিটিশিয়ানদের নিয়ে আসি। বাংলাদেশ থেকে অনেক বিজনেসম্যান গিয়েছেন। তারা সেমিনারে কথা বলেছেন এন্ড দে এক্সচেঞ্জ দ্যা আইডিয়াস। এই সেতু বন্ধনটা আমরা তৈরী করছি ফোবানার মাধ্যমে।
বাংলাদেশি কমিউনিটির প্রাণপুরুষ জসিম উদ্দিন আমেরিকার মেইনস্ট্রীম পলিটিক্স-এর সাথেও নিজেকে সংযুক্ত রেখেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের রিপাবলিকান পার্টির সদস্য প্রাজ্ঞ এই প্রবাসী বলেন, আমি রিপাবলিকান পার্টির সদস্য হলেও অন্ধ নই। আমি যেটাকে সঠিক মনে করি, দেশের জন্য, ইমিগ্র্যান্টদের জন্য যা উপকারী হবে সেটা বিবেচনা করে ভোট দিই এবং অন্যদের ভোট দেয়ার জন্য উৎসাহিত করি। আমাদের বাংলাদেশে হয়তো এটা সম্ভব নয়- কিন্তু আমেরিকাতে এই নীতিতে চলা সম্ভব।
জসিম উদ্দিন সুদূর যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করলেও নিজের মাতৃভূমি বাংলাদেশ নিয়েও বেশ চিন্তা করেন। বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে বিনিয়োগের মাধ্যমে কিভাবে ভূমিকা রাখা যায় তা নিয়ে তিনি খোলামেলা কথা বলেন। তিনি বলেন, বিনিয়োগ একটা চলমান প্রক্রিয়া। বাংলাদেশে আমাদের নিজেদের বিনিয়োগ, আমেরিকার দেশীয় বিনিয়োগসহ রাজনৈতিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক বিনিয়োগ প্রতিনিয়তই বাড়ছে। আমরা সব সময়ই বাংলাদেশের সাথে কানেক্টেড। বিদেশে থেকে সবসময়ই আমরা দেশের সাথে কাজ করি। সমৃদ্ধ বাংলাদেশ এবং সমৃদ্ধ নিরাপদ বিশ্ব নিশ্চিত করতে সবাইকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে উদ্যোগ, ভূমিকা এবং কাজ করে যেতে হবে।’ তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ বিনিয়োগের জন্য একটি ভালো জায়গা এবং প্রবাসীরাও চায় বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে। বেশ কিছু ক্ষেত্রে তারা করেছেও। কিন্তু বিনিয়োগের সুরক্ষার জন সরকারের পক্ষ থেকে আরো সুদৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন। তিনি বলেন, ফোবানা সম্মেলনের মাধ্যমে আমরা আমেরিকা এবং বাংলাদেশের ব্যবসায়ী এবং অন্যান্য গ্রুপের সাথে মতবিনিময়ের সুযোগ করে দিচ্ছি, যাতে দু’দেশের ব্যবসায়ীরা পারস্পরিক স্বার্থ বজায় রেখে বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে পারে। তবে প্রবাসী বাংলাদেশিরা হোক বা মেইনস্ট্রীম আমেরিকান হোক যারাই বাংলাদেশে বিনিয়োগ করবে তারা যেন তাদের বিনিয়োগ থেকে রিটার্ন পায় এমন পরিবেশে এদেশের সরকারকেই নিশ্চিত করতে হবে।
বিদেশে জনশক্তি রপ্তানী প্রসঙ্গে কৃতি এই প্রবাসী বলেন, বাংলাদেশ থেকে মধ্যপ্রাচ্যসহ অন্যান্য দেশে যে জনশক্তি রপ্তানী করা হয় তারা মূলত কায়িক শ্রমিক। তাদের বেশীরভাগই মূলত লেবার হিসেবে পরিচিত। তাদেরকে খাটো করে দেখছিনা। আমি মনে করি তারা আমাদের মতো আমেরিকা ইউরোপে যারা থাকি তাদের চেয়ে বড় দেশপ্রেমিক। কারণ তাদের উপার্জিত অর্থের প্রায় পুরোটাই তারা দেশে পাঠিয়ে দেয় এতে দেশের রিজার্ভ বৃদ্ধি পায়। এতে দেশের অর্থনীতির চাকা সচল থাকে। এ ধরণের প্রবাসী আয় বৃদ্ধির জন্য আপনার কোন পরামর্শ আছে কিনা জানতে চাইলে- দেশপ্রেমিক জসিম উদ্দিন বলেন, সরকার যদি বেকার ইয়াং জেনারেশনকে যুগোপযুগী টেকনিক্যাল শিক্ষায় শিক্ষিত করে বিদেশে পাঠায় তাহলে তারা বেশী আয় করে দেশে পাঠাবে। এভাবে দেশে রেমিটেন্স প্রবাহের গতি বৃদ্ধি পাবে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও বাড়বে।
বাংলাদেশে প্রবাসী বাংলাদেশিদের নিয়ে ‘প্রবাস মেলা’ নামে একটি পাক্ষিক ম্যাগাজিন নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে জসিম উদ্দিন বলেন, এটি একটি ভালো উদ্যোগ। এ পত্রিকার মাধ্যমে প্রবাসীদের সুখ-দুঃখ, সাফল্য-ব্যর্থতা এবং প্রবাসীদের জীবনযাত্রার বিভিন্ন খবরাখবর নিয়মিত তুলে ধরা হচ্ছে। আমি এ পত্রিকার সমৃদ্ধি কামনা করি।
উল্লেখ্য, ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনে স্ত্রী ফারজানা জাফরীন উদ্দীন, দুই মেয়ে নুসাইবা যাফীরাহ উদ্দীন ও যাহ্রা নারমীন উদ্দীনকে নিয়ে রয়েছে জসিম উদ্দিনের সুখের সংসার। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের জর্জিয়া স্টেটে তারা বসবাস করছেন।