স্কটল্যান্ডের পার্লামেন্টে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত প্রথম আইনপ্রণেতা ফয়ছল চৌধুরী এমবিই। গত বছরের ৬ মে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে স্কটল্যান্ডের রাজধানী এডিনবরার একটি আসন, যা লোদিয়ান নামে পরিচিত, সেখান থেকে স্কটিশ লেবার পার্টির প্রার্থী হিসাবে জয়ী হন ফয়ছল। তার এই জয় গ্রেট ব্রিটেনে মূলধারার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে স্থানীয় বাংলাদেশি কমিউনিটিকে আরও দৃঢ়ভাবে সম্পৃক্ত করতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখবে বলে মনে করা হচ্ছে। প্রবাস মেলার চলতি সংখ্যায় বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত স্কটিশ এই পার্লামেন্টারিয়ানের আদ্যেপান্ত পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো। লেখা তৈরি ও সম্পাদনা করেছেন মো: মোস্তফা কামাল মিন্টু।

জন্ম ও পরিচয়
ফয়ছল হোসেন চৌধুরীর জন্ম বাংলাদেশের হবিগঞ্জ জেলার নবিগঞ্জ থানার বদরদি গ্রামে। তার বাবার নাম গোলাম রব্বানী চৌধুরী এবং মাতার নাম রোকেয়া চৌধুরী। ফয়ছল হোসেন মা বাবার সাথে তরুণ বয়সে যুক্তরাজ্যে পাড়ি জমান। পরিবারের সাথে প্রথমে ম্যানচেস্টার এবং পরে স্কটল্যান্ডের রাজধানী এডিনবরায় বসবাস শুরু করেন। তিনি এডিনবরা শহরের নিউ টাউন এলাকায় বেড়ে ওঠেন। এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় বাবা শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়লে বড় ছেলে হিসেবে তরুণ বয়সেই পরিবারের হাল ধরেন ফয়ছল চৌধুরী। তখন থেকেই যুক্ত রয়েছেন পারিবারিক ক্যাটারিং ব্যবসায়।

রাজনীতিবিদ ও কমিউনিটি নেতা
ব্যবসার পাশাপাশি পারিবারিক ঐতিহ্য অনুযায়ী তরুণ বয়সেই শুরু করেন স্বেচ্ছাসেবী কার্যক্রম। ২০১৭ সালে ব্রিটেনের জাতীয় নির্বাচনে লেবার পার্টির হয়ে এডিনবরা সাউথ ইস্ট আসনে লড়াই করেন ফয়ছল চৌধুরী। এর আগে যুক্তরাজ্য থেকে স্বাধীন হওয়ার প্রশ্নে ২০১৪ সালে স্কটল্যান্ডে গণভোটের সময় ‘বাংলাদেশিজ ফর বেটার টুগেদার ক্যাম্পেইন’ এর সমন্বয়কারী ছিলেন ফয়সাল। মূলধারার রাজনীতিতে স্থানীয় বাংলাদেশিদের যুক্ত করতে তার উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে।

মামা ড. ওয়ালী তসর উদ্দিনের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে কমিউনিটি ওয়ার্কের হাতেখড়ি হয় ফয়ছলের। দীর্ঘদিন ধরে এডিনবরা অ্যান্ড লোদিয়ান রিজিওন্যাল ইকুয়ালিটি কাউন্সিলের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। বাংলাদেশি কমিউনিটি ছাড়াও বিভিন্ন সংখ্যালঘু কমিউনিটির মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক উন্নয়নেও ভূমিকা রয়েছে তার।

করোনা মহামারিতে এডিনবরায় বসবাসরত অভাবগ্রস্ত এথনিক মাইনরিটি পরিবারগুলোর মধ্যে খাদ্যদ্রব্য বিতরণের এক ব্যতিক্রমধর্মী উদ্যোগ হাতে নেন ফয়ছল চৌধুরী। তার প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণে এলরেক এর উদ্যোগে ‘ফুড সাপোর্ট’ প্রকল্পের আওতায় প্রতি সপ্তাহে ৩০টি অসহায় পরিবারকে জরুরি খাবার পৌঁছে দেয়া হয়। তার এই কাজ স্থানীয় কমিউনিটিতে ব্যাপক প্রশংসিত হয়।
স্কটিশ পার্লামেন্টে ফয়ছল চৌধুরী
গত বছরের ৬ মে প্রথমবারের মতো স্কটল্যান্ডের পার্লামেন্টে জয়ী হন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ফয়ছল চৌধুরী। স্কটল্যান্ডের রাজধানী এডিনবরার একটি আসন থেকে স্কটিশ লেবার পার্টির প্রার্থী হিসাবে জয়ী হন ফয়ছল। এই নির্বাচনে ক্ষমতাসীন এসএনপি পায় ৬৪টি আসন, কনজারভেটিভ পার্টি দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৩১টি আসন এবং ২২টি আসন পেয়ে নির্বাচনে তৃতীয় স্থান লাভ করেছে ফয়ছল চৌধুরীর দল স্কটিশ লেবার পার্টি।
২০০০ সালে চালু হওয়া এই পার্লামেন্টে মূলত-স্কটিশ জনগণের স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও ট্রান্সপোর্ট সংক্রান্ত বিষয়ে চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। তাছাড়া কয়েক প্রকার পাবলিক বেনিফিট এবং ট্যাক্স সংক্রান্ত নীতিমালা প্রণয়ন করার ক্ষমতাও রয়েছে স্কটিশ পার্লামেন্টের। প্রতি চার বছর পর পর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ১২৯ জন এমএসপি (মেম্বার অব স্কটিশ পার্লামেন্ট) নির্বাচিত হন।

আরও যেসব কাজে সম্পৃক্ত ফয়ছল চৌধুরী
গ্রেট ব্রিটেনে মূলধারার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে স্থানীয় বাংলাদেশি কমিউনিটিকে যুক্ত করতে ফয়ছল চৌধুরী অবিরাম কাজ করে যাচ্ছেন। বর্তমানে তিনি স্কটিশ মূলধারার নানাবিধ কর্মকাণ্ডে সক্রিয়ভাবে যুক্ত রয়েছেন। তিনি ক্লাইমেট ইমার্জেন্সি স্কটল্যান্ডের চেয়ার, এডিনবরা স্লেভারি অ্যান্ড কলোনিয়াল লেগাসী রিভিউ গ্রুপের সদস্য, মিউজিয়াম অ্যান্ড গ্যালারিস স্কটল্যান্ডের বোর্ড মেম্বার, ইএসএমএসের ইকুয়ালিটি অ্যান্ড ডাইভার্সিটি টাস্ক ফোর্সের অ্যাডভাইজার এবং ড্রামন্ড হাই স্কুল প্যারেন্ট কাউন্সিলের সদস্য হিসাবে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন।

স্কটল্যান্ডের বৃহত্তম মাল্টিকালচারাল আয়োজন ‘এডিনবরা মেলা’র প্রতিষ্ঠাকালীন ও বর্তমান ডিরেক্টর ফয়ছল চৌধুরী গিল্ড অব বাংলাদেশি রেস্টুরেন্টার ইন স্কটল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট, বাংলাদেশ সমিতি এডিনবরার চেয়ারম্যান, কাউন্সিল অব বাংলাদেশিজ ইন স্কটল্যান্ডের (সিবিএস) সাধারণ সম্পাদক এবং যুক্তরাজ্য নবীগঞ্জ এডুকেশন ট্রাস্টের ট্রাস্টি মেম্বার হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছেন। ১৯৯১ সালে বাংলাদেশ সাইক্লোন আপিল এবং ২০০৮ সালে বাংলাদেশ সাইক্লোন সিডর আপিলে তিনি তহবিল সংগ্রহ ছাড়াও দাতব্য প্রতিষ্ঠান ‘সেন্ট কলম্বাস হসপাইস’, লিউকেমিয়া ও ক্যান্সার আপিলসহ ‘ব্রিটিশ হার্ট ফাউন্ডেশন’ এর জন্য তহবিল সংগ্রহ করেছেন ফয়ছল।

বাংলাদেশের ভাবমূর্তি
স্কটিশ মূলধারায় বাংলাদেশি কমিউনিটির ভাবমূর্তি তুলে ধরতে ফয়ছল চৌধুরী সব সময় সদা তৎপর থাকেন। তার নেতৃত্বে ২০০৯ সালে প্রথমবারের মত স্কটল্যান্ডে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদযাপিত হয়, যার পৃষ্ঠপোষকতায় ছিল সিটি অব এডিনবরা কাউন্সিল। এ উপলক্ষ্যে সেদিন স্কটিশ পার্লামেন্টে একটি পার্লামেন্টারি মোশনও উত্থাপন করা হয়। এছাড়া বাংলাদেশ সমিতির উদ্যোগে ২০১২ সালে স্কটিশ পার্লামেন্টে সর্বপ্রথম বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস উদযাপিত হয়।
পুরস্কার ও সম্মাননা
বিভিন্ন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক উন্নয়নে অবদান রাখার জন্য ২০০৪ সালে ব্রিটেনের রাণী কর্তৃক সম্মানসূচক ‘মেম্বার অব ব্রিটিশ এম্পায়ার’ (এমবিই) খেতাবে ভূষিত হন ফয়ছল চৌধুরী। এছাড়া ২০০৬ সালে ব্রিটিশ বাংলাদেশি টেলিভিশন ‘চ্যানেল এস’ কর্তৃক ‘কমিউনিটি অ্যাওয়ার্ড’সহ নানা পুরস্কার রয়েছে তার ঝুলিতে।