জীতা লাহিড়ী, খড়দহ, উত্তর ২৪ পরগনা, ভারত থেকে:
বাইরে তখন প্রচন্ড বৃষ্টির দাপট তার সাথে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে, হসপিটালের কেবিনে জয়তি শুয়ে আছে। শরীরের সাথে সাথে মনটাও ভীষণ খারাপ সে নিজেই শেখরকে আসতে বারণ করেছে আজ। শেখর জয়তীর স্বামী। দীর্ঘ ২৬ বছরের দাম্পত্য তাদের কিন্তু আজও শেখর জয়তিকে সেই প্রথম দিনের মতন ভালোবাসে। হয়তোবা আরো বেশি, হসপিটালটা জয়তীদের বাড়ির সম্পূর্ণ উল্টো দিকে। শেখরকে প্রতিদিন অফিস থেকে বেরিয়ে উল্টো দিকে অনেকটা এসে হসপিটালে উপস্থিত হতে হয়। আজ এত ঝড়-বৃষ্টির প্রকোপ দেখে আগে থেকেই জয়তী শেখরকে আসতে বারণ করেছে। আস্তে আস্তে বয়স হচ্ছে, রোজ রোজ হসপিটালে আসার ধকল সে দিতে চায় না শেখরকে, কিন্তু তার অসুস্থতার সময়ে শেখরই একমাত্র ভিজিটর যে জয়তীকে প্রত্যহ দেখতে আসে। আজ সে আসবে না। তাই একা একা বসে থাকা ছাড়া কোন কাজ নেই। কবে যে ছাড়বে হসপিটাল থেকে এসব সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘড়ির কাঁটা সাতটা ছুয়েছে খেয়ালই করেনি জয়তী। রাতের খাবার দিয়ে গেল নার্স। সবে ফয়েলগুলো সরিয়ে খাবারটা মুখে তুলতে যাবে এমন সময় দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকছে একটা সাদা চুলের মাথা।
ওমা শেখর! মনটা এক ঝলক আনন্দে ভরে গেল এত করে বারণ করলাম মানুষটাকে তবু এসেছে। কপোট রাগ দেখানো জয়তী আসলে মনে মনে ভীষণ খুশি। অপরদিকে দুশ্চিন্তাও হচ্ছে এই ঝড় বৃষ্টিতে কি করে বাড়ি ফিরবে শেখর। এখন সাতটা বাজে, যদিও স্বাভাবিক ভিজিটিং আওয়ার এটা নয়। শেখরের ডাক্তার বন্ধুর হসপিটালে চাকরি করার সুবাদে শেখরের এই অসময়ে আগমন। শেখর প্রথমে ঢুকেই হসপিটালের বেডের পাশে রাখা ফাইল টা খুলে এটা সেটা দেখতে থাকলো আর মাথায় হাত দিয়ে জ্বর আছে কিনা দেখল, খেয়ে নাও, খেয়ে নাও তাড়াতাড়ি খেয়ে নাও। দেরি করো না আমি বসছি- বলতে বলতে শেখর পাশের চেয়ারটাতে বসলো। জয়তীর মনে তখন এক আনন্দের রেশ, তার ২৬ বছরের পুরনো স্বামী। আজ নতুন রূপে জয়তীকে ভালবাসলো, এই ঝড় বৃষ্টি বজ্রবিদ্যুৎ মাথায় করে মাত্র ১৫ মিনিটের জন্য ৩০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে সে এসেছে তার ২৬ বছরের পুরনো স্ত্রীকে হসপিটালের বেডে একটিবার দেখতে পাবার জন্য। পৃথিবীতে কত রকম প্রেম দিবস পালিত হয় কিন্তু এই ছোট ছোট ভালো লাগাগুলো, এই ছোট্ট আনন্দগুলো, ১০০ টা ভালোবাসা দিবস উদযাপনের সমান। যদিও সে শেখরকে বলতে থাকলো, কেন তুমি এসেছো? ফিরবে কি করে? শেখর তার কাঁচাপাকা মোটা গোঁফের ফাঁক দিয়ে এক টুকরো হাসি উপহার দিয়ে বললো, আমি তো জানি তুমি অপেক্ষা করবে। জয়তীর চোখের সামনে তখন হাজার গোলাপের তোড়ার উপহার, লক্ষ্যবাতির আলো- এটাই তো জীবন, এটাই তো দাম্পত্য। ঈশ্বর তার দাম্পত্যকে আগলে রাখুন। সমৃদ্ধ করে রাখুন, চিরসবুজ করে রাখুন- এই প্রার্থনা। শেখর চলে যাবার পর জয়তী বিছানায় চোখ বুঝলো তার চোখের সামনে তখন হাজার ভ্যালেন্টাইন্স ডে উদযাপনের আনন্দ আলো ভাসছে।