তপন দেবনাথ, লস এঞ্জেল্স, যুক্তরাষ্ট্র
উপস্থাপিকা সবাইকে আহবান জানাচ্ছেন আপনারা সবাই দয়া করে সিটে বসুন। আপনারা বসলেই আমরা অনুষ্ঠান শুরু করতে পারি। আপনারা বসছেন না বলেই অনুষ্ঠান শুরু করতে পারছি না। দয়া করে সবাই বসুন। সবাই এলোমেলো হাঁটাহাঁটি করছে বলে চেয়ারগুলো খালি পড়ে আছে। দর্শক চেয়ারে না বসলে অনুষ্ঠান সে কার জন্য শুরু করবে। দর্শক ছাড়া তো অনুষ্ঠান শুরু করা যায় না। উপস্থাপিকার কথায় কেউ কোনো গুরুত্ব দিচ্ছে বলে মনে হয় না। যে-যার মতো এলোমেলো হাঁটছে, ঝাঁলমুড়ি-চা খাচ্ছে, খোশ গল্প করছে। অনুষ্ঠান আর শুরু হচ্ছে না।
এখানে মানে লস এঞ্জেল্সে নির্ধারিত সময়ে কোনো অনুষ্ঠান শুরু হয়েছে এমন নজির নেই বললেই চলে। বাঙালির সময় জ্ঞান কিন্তু ঠিকই আছে। কাজ বা অন্য স্থানে সে ঠিকই সময়ের গুরুত্ব দেয় বা দিতে বাধ্য হয়। সমস্যা শুধু কোনো অনুষ্ঠানে। অনুষ্ঠানের সময় যেন খুবই মূল্যহীন। নির্ধারিত সময়ের এক ঘন্টা পরেও যদি কোনো অনুষ্ঠান শুরু হয় তা হলেও ধরে নেয়া যায় যে যথাসময়ে শুরু হয়েছে। কেন এমনটি হয়? দর্শক সময়মতো আসে না নাকি আয়োজকরা যথাসময়ে শুরু করে না বলে দর্শকরা সময় মতো আসে না?
স্কুল মাঠে বিশাল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন। বাংলাদেশ থেকে সিনেমা ও টিভির কয়েকজন নাম করা শিল্পীরা এসেছেন। সন্ধ্যার পর যে মাঠে তিল ধরনের ঠাঁই থাকবে সে কথা নির্দ্বিধায় বলা যায় কিন্তু এখন আসনগুলো ফাঁকা। এখন এখানে গ্রীষ্মকাল। প্রচন্ড গরম পড়েছে গত কয়েকদিন ধরে।
সামনের সারির একটি চেয়ারে বসল পলক। অনুষ্ঠান শুরু না হলেও শুরু হওয়ার আয়োজন চলছে। ২/১ জন করে লোকজন চেয়ারে বসতে শুরু করেছে। সূর্য ডুবতে এখনো অনেক বাকি। সন্ধ্যার পর ছাড়া কোনো অনুষ্ঠানই এখানে তেমন জমে না। এর কারণ অবশ্য কারো জানা নেই। পলকের সামনে দিয়ে একজন মহিলা ৫/৬ বছরের একজন মেয়েকে বেবী ট্রলিতে বসিয়ে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে। এদিক-সেদিক তাকাচ্ছে; সে। মনে হয় পরিচিত কাউকে খুঁজছে। যেহেতু লোকজন তেমন নেই- পলকের চোখে চোখে পড়ল তার। পলক থতমত খেয়ে গেল। মহিলাকে তার খুব চেনা চেনা মনে হয়। আগে কোথায় দেখেছে ঠিক মনে করতে পারছে না। তবে একাধিকবার দেখেছে বলে মনে হয়।
পলককেও মহিলার কেমন যেন চেনা চেনা মনে হয়। গাঢ়চোখে পলকের দিকে তাকিয়ে সে দ্রুত অন্যদিকে চলে গেল। তার দ্রুত স্থান ত্যাগ পলকের মনে সন্দেহের জন্ম দিল।
সব কিছু কেমন যেন এলোমেলো হয়ে গেল পলকের কাছে। মহিলাকে হুবহু পুস্পান্বিতার মতো লাগছে তার কাছে কিন্তু সেটা কি করে সম্ভব? ঢাকা শহরে বা বাংলাদেশের কোথাও হলে সম্ভব বলে ধরে নিতে পারত সে। পুস্পান্বিতা কি করে এদেশে আসবে, কার সাথে আসবে- কোনো উত্তর খুঁজে পায় না পলক।
খোলা আকাশের দিকে তাকালো পলক। বাংলাদেশে এখন শরৎকাল। এমনি বিকেলে শরতের আকাশে সাদা মেঘের ভেলা ভেসে বেড়ায়। কবির বসন্ত শরৎকাল কত মোহনীয় রূপ ধারণ করে। কাশফুলের মেলা বাংলাদেশকে আলাদা রূপ দান করে। অপলক তাকিয়ে আছে পলক আকাশের দিকে। কল্পনার চোখে সে যেন শরতের আকাশকেই দেখছে! রাশি রাশি সাদা মেঘের ভেলা ভেসে যাচ্ছে তার চোখের সামনে দিয়ে।
এমন এক দিনে, ঠিক এমন এক শরতের বিকেলে সংসদ ভবনের সামনের খোলা মাঠে সবুজ ঘাসের উপর বসে ছিল তারা দুজন। তাদের সম্পর্কের ব্যাপারটা পলকের পরিবার রাজী থাকলেও পুস্পান্বিতার পরিবার রাজী ছিলনা। পলক ডিভি লটারি বিজয়ী হওয়ার পরই সমস্যাটি প্রকট আকার ধারণ করে। পলকের আবেদনপত্রে পুস্পান্বিতার নাম ছিল না বিধায় ভিসা সাক্ষাতকারের সময় তাকে উপস্থিত করা সম্ভব ছিলনা। পলক একাই ভিসা পেয়েছে। তাদের মধ্যে প্রেম ছিল কিন্তু বিয়ে হয়নি বলে বিয়ের কোনো প্রমাণপত্রও দাখিল করা যায়নি। পলকের ভিসা প্রাপ্তির পর পুস্পান্বিতার সাথে অলিখিত একটি চুক্তি হয় যে- যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পলক বাংলাদেশে ফিরে গিয়ে পুস্পন্বিতাকে বিয়ে করে এখানে নিয়ে আসবে।
পলক চলে আসার আগে সংসদ ভবনের সামনের শেষ দেখার সময় পুস্পান্বিতা অনেক কেঁদেছিল। সে-দিন ছিল শরতের নির্মল আকাশ। পরন্ত বিকেলে আকাশটা মোহনীয় রূপ ধারণ করেছিল। সাদা মেঘের দল আকাশে ভেসে বেড়াচ্ছিল। হঠাৎ সামান্য কালো মেঘ থেকে গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছিল। পুস্পান্বিতা তার ওড়না দিয়ে পলকের মাথা ঢেকে দিয়েছিল। এই ঘটনাটুকু পলকের হৃদয়ে এত দাগ কেটে ছিল সে ইলশে গুঁড়ি, বা গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি হলেই তার মনে হয় কেউ একজন ওড়না দিয়ে তার মাথা ঢেকে দিবে। গত বিশ বছরেও এমনটি ঘটেনি তার পরেও পলকের বিভ্রম কাটেনি।
কয়েকমাস পুস্পান্বিতার সাথে পলকের পত্র যোগাযোগ থাকলেও এক সময় তা বন্ধ হয়ে যায়। একদিন পুস্পান্বিতার চিঠি আসে যে তার বাবা তার বিয়ে ঠিক করে ফেলেছে। পলকের কাছে যখন চিঠি এসে পৌঁছে ততদিনে পুস্পান্বিতার বিয়ে হয়ে গেছে। চিঠি পেয়ে পলক খুব কেঁদেছিল। কান্না করা ছাড়া তার আর কিছুই করার ছিল না। এক ধরনের রাগও হয়েছিল তার। পুস্পান্বিতা কি কোনোভাবেই বাবার মতের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারতনা। নাকি সে সে-রকম কোনো পদক্ষেপই নেয়নি? নিয়তির লিখন বলে সব মেনে নিয়েছিল পলক। এরপর থেকেই পুস্পান্বিততার সাথে পলকের সব ধরনের যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়।
পুস্পান্বিতার সাথে বাহ্যিক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেলেও পলকের মনের যোগাযোগ যেন অব্যাহতই ছিল। কত মেয়েকে দেখে যে পুস্পান্বিতা ভেবে বিভ্রম হয়েছে তার ঠিক নেই। একজনের চেহারার সাথে আর একজনের চেহারার মিল না থাকলেও পুস্পান্বিতার চেহারার কাছাকাছি কাউকে দেখলেই সে আৎকে উঠত। একটি ছায়াসঙ্গী সব সময়ই যেন তাড়া করত তাকে। পুস্পান্বিতার মুখশ্রী তার হৃদয়ে এমনভাবে গেঁথে গিয়েছিল যে স্বপ্নে-জাগরণে সে পুস্পান্বিতাকেই দেখতে পেত।
বিশ বছর আগে দেখা আর আজকের দেখা পুস্পান্বিতা এক হবার কথা নয় কিন্তু চেহারার কোথায় যেন একটা হুবহু মিল দেখতে পেল সে। আমেরিকা তো পৃথিবীর বাইরের কোনো দেশ নয় যে পুস্পান্বিতা এখানে আসতে পারবে না- ভাবল পলক।
ভাবনার আকাশে ছেদ পড়ল পলকের উপস্থাপিকার ঘোষণা শুনে- এখনই আমাদের অনুষ্ঠান শুরু করতে যাচ্ছি।
মা, জোরে মা ডাক শুনে পিছনের দিকে তাকাল পলক। ১৭/১৮ বছরের একজন মেয়ে দর্শক সারির পিছন থেকে তার মাকে ডাকছে। সে ডাক অনুসরণ করে মহিলা দর্শক সারির ডান পাশ দিয়ে মেয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
উঠে গিয়ে মহিলার সাথে আলাপ করতে ইচ্ছে হল পলকের। ২/৩ টি কথা বললেই সে বুঝতে পারবে মহিলা পুস্পান্বিতা কিনা। মহিলার বয়স, তার মেয়ের বয়স, তার চেহারা- কোথায় যেন পুস্পান্বিতার সাথে মিলে যায়।
উঠবে উঠবে করেও উঠছে না পলক। কি বিষয় নিয়ে আলাপ শুরু করবে সে? মহিলার স্বামী যদি এখানে থেকে থাকে তাহলে স্ত্রীকে সন্দেহ করবে সে। ঝগড়া-ঝাটিও হতে পারে। তার চেয়ে ভালো আলাপ না করা। যদি পুস্পান্বিতাই হয়ে থাকে তাহলে নিজেকে কীভাবে সামলাবে পলক?
ঘাড় ঘুড়িয়ে মা মেয়ের মিলন দৃশ্য দেখল পলক। মহিলা যদি পুস্পান্বিতা হয়- যদি তার সাথে আমার বিয়ে হতো তাহলে এ মেয়েটি আমার হতে পারতো। লোকজন ইতোমধ্যে বেড়েছে। অনেকে চেয়ারে বসেছে। কেউ কেউ হাঁটাহাঁটি করছে। অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেছে। মঞ্চে শিল্পী গাইছেন- ‘প্রেম একবারই এসেছিল নিরবে . . .।’
গানের প্রথম কলিটি পলকের হৃদয়কে বিদর্ঢু করে যেন বের হয়ে গেল। ভারাক্রান্ত হল সে। এত বছর পর পুস্পান্বিতার জন্য তার এভাবে মন খারাপ হবার কোনো কারণ নেই তবু তার মন খারাপ হলো। ভীষণভাবে মন খারাপ হলো। নিজের অজান্তে দুফোঁটা অশ্রুও গড়িয়ে পড়ল সবার অলক্ষ্যে।
ভালো লাগছে না পলকের। বাসায় চলে যেতে ইচ্ছে করল তার। উঠে দাঁড়াল সে। পিছন থেকে একজন দর্শক ডাক দিল- এই যে ভাই বসুন। পলক বসল। শিল্পী এবার গাইছেন- ‘সখি, ভালোবাসা কাহারে কয় . . .।’ প্রায় ডুকরে কেঁদে দিয়েছিল পলক। নিজেকে আবার সামলে নিল সে। নিরবে অশ্রু বিষর্জন দেওয়া ছাড়া ভালোবাসা কাহারে কয় আমি জানি না। মনের গোপন কুটিরে বিশ বছর ধরে যে ভালোবাসা লালন করে এসেছি- আজ তার বিস্ফোরণ ঘটল। যাই, তাকে জিজ্ঞাসা করি সে পুস্পান্বিতা কিনা। কি-ই বা সে আর মনে করবে যদি সে পুস্পান্বিতা নাও হয়? একটা বোকামি প্রকাশ পাবে- এই তো? জীবন খাতার হিসাবের পাতায় আর একটি বোকামি না হয় যোগ হল-এই যা।
চেয়ার ছেড়ে উঠল পলক। খুঁজতে লাগল মহিলাকে। বেশি বেগ পেতে হয়নি তাকে। ঝাল-মুড়ির স্টলের সামনে দাঁড়িয়ে মা-মেয়ে ঝাল মুড়ি খাচ্ছে। ছোট মেয়েটা মায়ের শাড়ির আঁচল ধরে টানাটানি করছে। তাদের কাছাকাছি চলে এলো পলক। তাকাল মহিলার দিকে। পুস্পান্বিতা এভাবেই ফুসকা খেত। মাঝে মাঝে সে পলকের মুখে ঢুকিয়ে দিত।
আকাশের দিকে তাকাল পলক। সন্ধ্যা নেমেছে। আকাশে সে যেন দেখতে পাচ্ছে সাদা মেঘের ভেলা দক্ষিণ দিক থেকে উত্তর দিকে ভেসে যাচ্ছে। সামান্য কালো মেঘ থেকে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছে। ঝালমুড়ির বাটি মেয়ের হাতে দিয়ে পুস্পান্বিতা এসে যেন ধমকের সুরে বলছে- ভিজছো কেন? পুস্পান্বিতা শাড়ির আঁচল দিয়ে তার মাথা ঢেকে দিল।