মুহাম্মদ আনোয়ার শাহাদাত হোসেন, রিয়াদ, সৌদি আরব
বছর ঘুরে রহমত, মাগফেরাত আর মুক্তির সওগাত নিয়ে আমাদের মাঝে উপস্থিত পবিত্র রমজান মাস। সমগ্র মুসলিম বিশ্বে অন্য ধরনের এক আবহ সৃষ্টি হয় রমজান এলে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো সৌদি আরবেও রমজান মাসে বিভিন্ন ধরনের প্রস্তুতি চলে সিয়াম সাধনার। চারিদিকে পবিত্রতার আমেজ। এখানে বসবাসরত পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মুসলিমরা পবিত্র রমজান মাসে সিয়াম সাধনার পাশাপাশি রমজানের বিশেষ আনন্দও উপভোগ করে নিজেদের শত কর্মব্যস্ততার মাঝে।
রমজান মাসে অন্যান্য ইবাদতের সাথে সাহরি, ইফতার ও তারাবীর নামাজ সব মিলে অনেকটা পূর্ণ আমেজে পবিত্র এই মাস অতিবাহিত হয়। তবে প্রবাস জীবনের শত প্রতিকূলতার মাঝে এরকম সুযোগ সব প্রবাসীর হয়ে উঠে না। বিশেষ করে তারাবীর নামাজ পড়ার সুযোগ হয়ে উঠেনা অধিকাংশ প্রবাসীর। কারণ রমজান মাসে বেশির ভাগ মার্কেট বা দোকানগুলো খোলা হয় এশার নামাজের পর, তাই যারা দোকানে চাকরি করে বা ব্যবসার সাথে জড়িত তাদের পক্ষে তারাবীর নামাজে অংশগ্রহণ সম্ভব হয়ে উঠে না।
অন্যান্য পেশাজীবিদেরও অনেক সময় কাজ শুরু হয় এশার নামাজের পর তাই তারাবীটা আদায় করা প্রবাসীদের পক্ষে অনেকাংশেই কঠিন হয়ে উঠে। দেশের মতো এখানেও বাংলাদেশি অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে চনা, মুড়ি, পেয়াঁজু, বেগুনি, জিলাপী, হালিম, আলুর চপ সহ সকল বাংলাদেশি ইফতারি পাওয়া যায়। সাথে সৌদি আরবের ট্রেডিশনাল খাবারগুলোতো আছেই। তবে আমরা বাংলাদেশিরা যেন দেশীয় স্বাদের ইফতারি দিয়ে ইফতার না করলে পেট ভরেনা, তাই যথাসম্ভব বাংলাদেশিরা নিজ বাসায় হোক বা দোকানে দু-চারজন মিলে দেশীয় স্বাদের বিভিন্ন আইটেম নিয়ে ইফতার করি।
ইফতারি যে ধরনেরই হোক না কেন এখানে বিভিন্ন ফলের সমাহার থাকে প্রচুর, কেননা সৌদি আরবে প্রচুর পরিমানে বিভিন্ন ধরনের ফল পাওয়া যায় আর সাথে থাকে বাহারি সব শরবত। উল্লেখ্য যে, সৌদি আরবের অধিকাংশ মসজিদে সার্বজনীন ইফতারের ব্যবস্থা করা হয়। প্রায় প্রতিটি মসজিদের বাইরে তাবু টাঙিয়ে ইফতারের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা করা হয়, যেখানে খেজুর, জুস এবং সৌদি আরবের বিভিন্ন সুস্বাদু খাবারের ব্যবস্থা থাকে। বিভিন্ন দেশের হাজার হাজার প্রবাসীরা প্রতি রমজান মাসে এসব মসজিদে পুরো রমজান মাস ফ্রিতে ইফতার করেন।
শুধু যে মসজিদে ইফতারির ব্যবস্থা করা হয় তা নয় এদেশে বিভিন্ন রাস্তায় ট্রাফিক সিগন্যালে ইফতারির সময় অনেক সৌদি নাগরিককে দেখা যায় ইফতারি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পথচারীদের উদ্দেশ্যে। অনেকে আবার ইফতারি নিয়ে গাড়িতে করে ঘুরে বেড়ায় এবং রাস্তায় রাস্তায় ইফতারি বিলি করে। তাই রমজান আসলে দেখা যায় সৌদি সাধারণ জনগণের মনের উদারতা আর পূণ্য কাজ করার প্রতিযোগীতা।
এ ছাড়া পবিত্র দুই নগরী মক্কা শরীফ আর মদিনা শরীফের কথা তো বলা বাহুল্য! প্রতিদিন রমজানে মসজিদুল হারাম মক্কা আর মসজিদে নববী মদিনায় অত্যন্ত সুশৃঙ্খল ও নজিরবিহীন ব্যবস্থাপনায় হাজার হাজার মানুষের ইফতারের ব্যবস্থা হয় যা পৃথিবীতে বিরল!
রমজানে আমাদের দেশে নিত্য প্রয়োজনীয় সকল জিনিসের দাম বৃদ্ধি পেলেও সৌদি আরবের সব মার্কেটগুলোতে রমজান উপলক্ষে বিশেষ ছাড় দেয়া হয় যা আমাদের দেশের ব্যবসায়ীদের জন্য অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হতে পারে। রমজান উপলক্ষে কর্মঘন্টাও হ্রাস করা হয়। সরকারি-বেসরকারি সব চাকরিজীবিদের কর্মঘন্টা আট ঘন্টা থেকে কমিয়ে করা হয় ছয় ঘন্টা। তবে কষ্ট হয় যারা বাইরে কাজ করে যেমন নির্মাণ শ্রমিক এবং পরিচ্ছন্নতার কাজে নিয়োজিত শ্রমিক। রোজা রেখে এই তীব্র গরমে কাজ করা সত্যিই দূরহ কিন্তু যত কষ্টই হোক পরিবার পরিজনের মুখে দুমুঠো অন্ন তুলে দিতে এসব শ্রমিকরা সেহরি খেয়ে না ঘুমিয়ে কাজে চলে যায় যাতে করে গরমের তীব্রতায় তাদেরকে কাবু করার আগেই কাজ সেরে চলে আসতে পারে।
পুরো রমজান মাসব্যাপী বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতি সংগঠনের উদ্যোগে থাকে ইফতার পার্টি। খাবার হোটেলগুলোর হল রুমে পুরো রমজান মাস চলে ইফতার পার্টি। এত কিছুর পরেও প্রবাসের মাটিতে প্রতিটি নিঃশ্বাসে প্রবাসীরা আপনজনদের শূণ্যতা অনুভব করে। দেশের মাটিতে ইফতারের যে আনন্দ আর আমেজ তা কি প্রবাসের মাটিতে খুঁজে পাওয়া সম্ভব!
মা-বাবা, ভাই-বোন আর পরিবার-পরিজন নিয়ে ইফতার করা বা সেহেরি খাওয়া, সেহেরির জন্য একজন আরেকজনকে ডাকা, দল বেঁধে তারাবী পড়তে যাওয়া, তারাবীর পর আবার একটু বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেয়া বা একটু চা খাওয়া এসব জীবনঘনিষ্ঠ সুখানুভূতি তো প্রবাসের জটিল সমীকরণে মিলানো খুবই কঠিন!
তারপরও পৃথিবীর অন্যান্য দেশের চাইতে সৌদি আরবে পবিত্র রমজান মাসে প্রবাসীরা মোটামুটি ভালোই থাকেন। প্রবাসে রমজানে মনে হয় সকল পূর্ণতার মাঝেও কী যেন অপূর্ণ রয়ে যায়। দেশের অনেক কিছুই হয়তো বিদেশে আনা যায় কিন্তু স্বদেশকে তো আর বিদেশে আনা য়ায় না!