ছাত্রাবস্থায় তিনি পাকিস্তানী শাসন শোষণের বিরুদ্ধে রাজপথে আন্দোলন করেছেন। যুদ্ধ শুরু হলে ডেমরা এলাকায় কামরুল আলম খসরুর অধীনে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। প্রগতিশীল ছাত্রসংগঠনের সাথে সম্পৃক্ত থেকে ছাত্র আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন। কর্মজীবনে দেশে বিসিএস এ শিক্ষা ক্যাডারে শিক্ষকতা পেশা শুরু করলেও ৮০’র দশকের শেষ দিকে আমেরিকায় পাড়ি জমান। সেখানে নামকরা একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করার পাশাপাশি বেশ কিছু সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনের সাথে থেকে প্রবাসীদের অধিকার, এদেশের বৈষম্যমূলক শিক্ষা ব্যবস্থা পরিবর্তনে কাজ করে যাচ্ছেন। তিনি হলেন যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়া বসবাসকারী লুত্ফা হাসীন রোজী। সম্প্রতি তার বাবার মৃত্যুতে দেশে আসেন। এক বিকেলে ঘুরে গেলেন প্রবাস মেলা কার্যালয়ে, আলাপচারিতায় তার আদ্যোপান্ত জানাচ্ছেন মো: মোস্তফা কামাল মিন্টু।
লুত্ফা হাসীন রোজী একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা, যুদ্ধের আগে ছাত্র অন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন। ছয় দফা আন্দোলন থেকে ছাত্ররাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। তিনি ১৯৭৬/৭৭ সালে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাহিত্য সম্পাদক হিসেবে কাজ করেছেন। যুক্তরাষ্ট্র যাওয়ার আগে জাসদের অফিস সেক্রেটারি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
মুক্তিযোদ্ধা লুত্ফা হাসীন রোজী ১৯৭০ সালে দেশব্যাপী ‘পাকিস্তান দেশ ও কৃষ্টি’ বইটি বাতিলের আন্দোলনে ডাকসুর তত্বাবধানে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক হিসেবে নেতৃত্ব দিয়েছেন, মহিলা জয় বাংলা বাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছাড়াও ৬৯’র গণঅভ্যুত্থানে অংশগ্রহণ করেন। তিনি ডেমরা এলাকায় কামরুল আলম খসরুর অধীনে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। এ সম্পর্কে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, যে স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলাম, সেই স্বপ্ন প্রতিষ্ঠার জন্য যুদ্ধ করেছিলাম। আমি মুক্তিযুদ্ধের কোন সার্টিফিকেট নেইনি, কারণ যুদ্ধ করেছি দেশ স্বাধীন হওয়ার জন্য। কিন্তু এখন যখন প্রায় সময় শুনি রাজাকাররা মুক্তিযুদ্ধের সার্টিফিকেট নিচ্ছে তখন এ কষ্টের আর শেষ থাকেনা। সরকারের কাছে দাবি জানাব ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার বিষয়ে তড়িত ব্যবস্থা নিতে।
লুত্ফা হাসীন রোজী কুমিল্লা জেলার হোমনা থানার শ্যামনগর গ্রামে নানার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। পড়ালেখা শুরু ময়মনসিংহে, তবে ঢাকায় আজিমপুর গার্লস হাইস্কুল ম্যাট্রিক, বদরুন্নেসা মহিলা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাশ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিত বিষয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর করেন। এরপর ১৯৮২ সালে ১ম বিসিএস এ শিক্ষা ক্যাডারে ঢাকা কলেজে গণিত বিভাগে যোগদান করেন।
১৯৮৭ সালে সেপ্টেম্বর মাসে বিয়ে করার পর নভেম্বর মাসে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান। সেখানে তিনি William & Mary Universitiy থেকে Operations Research and Math এবং Virginia Commonwealth University থেকে Computer Science এ মাস্টার ডিগ্রি করেন। এরপর তিনি Siebe HVAC ( Heating, Ventilation and Air Condition) কোম্পানিতে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কিছুদিন কাজ করেন। তারপর ভার্জিনিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটি এবং ভার্জিনিয়া কমনওয়েলথ ইউনিভার্সিটিতে কিছুদিন শিক্ষকতা করেন। বর্তমানে তিনি ইসিপিআই (ECPI) ইউনিভার্সিটিতে গণিত, পরিসংখ্যান এবং কম্পিউটার সাইন্সের শিক্ষক হিসেবে কর্মরত আছেন। শিক্ষা জীবনে জাসদ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেত্রী লুত্ফা হাসীন রোজী যুক্তরাষ্ট্রে শিক্ষকতার পাশাপাশি বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও গবেষণামূলক কাজে সক্রিয় রয়েছেন। ২০০৭ সালে তারা কয়েকজন মিলে প্রতিষ্ঠা করেন ইউএস বাংলাদেশ সোশ্যাল অর্গানাইজেশন (USBSO) নামে একটি সামজিক সংগঠন। এই সংগঠনটি সম্পর্কে তিনি জানান, এটি মূলত এনজিও ভিত্তিক নন প্র্রফিট সামাজিক সংগঠন। এর মাধ্যমে আমরা বিদেশে বসবাসরত বাঙালিরা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে মিলিত হই। যেমন, ২১ ফেব্রুয়ারি, ২৬ মার্চ, ১ বৈশাখ, ১৬ ডিসেম্বর, ঈদ পুনর্মিলনীসহ নানা অনুষ্ঠানে আমরা এ দেশের সংস্কৃতিকে লালন করার মাধ্যমে বিদেশে তুলে ধরি। বলা যায় এসব অনুষ্ঠান বাংলাদেশিদের মিলনমেলায় পরিণত হয়। এই সংগঠনের অধীনে একটি স্কুল রয়েছে বলেও জানান লুত্ফা হাসীন রোজী।
এছাড়াও ICER ( Institute of Culture Education and Research) নামে আরেকটি এনজিও সংগঠন লুত্ফা হাসীন রোজী প্রতিষ্ঠা করেছেন। এই সংগঠনটি কি ধরনের কাজ করে থাকে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এর মূল লক্ষ্য হল দেশের উন্নয়নে কাজ করা। তিনি বলেন, ব্রিটিশ আমলের শিক্ষা ব্যবস্থাই জোড়াতালি দিয়ে পাকিস্তানে চলেছে, এখন বাংলাদেশেও চলছে। বাংলাদেশে এখন তিন ধারার শিক্ষা ব্যবস্থা চালু রয়েছে যা সমাজকে শুরুতেই ত্রিধা বিভক্ত করছে এবং বৈষম্যের ধারাকে লালন করছে। আমরা দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত অবৈতনিক এবং বাধ্যতামূলক শিক্ষা ব্যবস্থা চালুর প্রস্তাব করেছি।
প্রবাসীদের অধিকার আদায়ের প্ল্যাটফর্মে প্রতিষ্ঠিত কানেক্ট বাংলাদেশের সাথেও লুত্ফা হাসীন রোজী সক্রিয়ভাবে কাজ করছেন। তিনি সংগঠনটির কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক হিসেবে প্রবাসীদের অধিকার আদায়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, কানেক্ট বাংলাদেশের মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হল, বাংলাদেশের উন্নয়ন ও প্রবাসীদের অধিকার। এর মূল দাবির মধ্যে রয়েছে, প্রবাসীদের ন্যাশনাল আইডি কার্ড প্রদান, তাদের ভোটের অধিকার, ওয়ান স্টপ সার্ভিস, দূতাবাসের মাধ্যমে প্রবাসী ওয়ার্ক ফোর্সের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা প্রভৃতি।
পারিবারিক জীবনে লুত্ফা হাসীন রোজী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক রেজিষ্ট্রার ও বিশিষ্ট ভাষা সৈনিক আবু জায়েদ সিকদারের মেয়ে। ১৯৮৭ সালে মোহাম্মদ মিফতাহুল আমিন এর সাথে লুত্ফা হাসীন রোজী বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তাদের সংসারে রয়েছে অনন্ত জ্যোতি আমিন নামে এক পুত্র সন্তান। সে যুক্তরাষ্ট্রে বিবিএ কমপ্লিট করে একটি ব্যাংকে ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকার হিসেবে কর্মরত আছেন।