রফিক আহমদ খান, কুয়ালালামপুর, মালয়েশিয়া
চায়নিজ আন্টি রি সিয়ক আমার পাশের দোকানি। আমরা অনেক দিন কুয়ালালামপুরের চায়নাটাউনে পাশাপাশি দোকানদারি করি। আন্টি থাইল্যান্ডের তৈরী কাপড় বিক্রি করেন। আমি লেদার হ্যান্ডব্যাগসহ অন্যান্য জিনিস বিক্রি করি। ২০১১ সাল থেকে আন্টির পাশে আছি, মানে আট বছর চলছে।
১৯৪৭ সালের জানুয়ারিতে জন্ম নেয়া আন্টি রি সিয়ক এর বয়স এখন একাত্তর। ২০১১ সালে আমরা যখন আন্টির পাশে এসে দোকান খুলি তখনও আমার আব্বা পৃথিবীতে ছিলো। আমার আব্বার জন্ম আন্টির আরো এক বছর পরে, মানে ১৯৪৮ সালে। শরীরে অসুখ লালনপালন করে স্বাভাবিক জীবনযাপন করা আব্বা হঠাৎ না ফেরার দেশে চলে গেলেন সেই ২০১৫ সালে। আর আমার পাশের চায়নিজ আন্টি এখনও সুস্থ শরীর নিয়ে প্রতিদিনই ১২ ঘন্টা ডিউটি করে যাচ্ছেন তার দোকানে। শুধু নামমাত্র ডিউটিও নয়, ছোট্ট দোকানটিতে তিনি একাই কাপড় ডিসপ্লে ও বেচাকেনার কাজ করেন। বেচাকেনা করার মত টুকটাক ইংরেজি জানেন, তা দিয়েই তেতাল্লিশ বছর ধরে পৃথিবীর নানান দেশের পর্যটকদের কাছে নানা পণ্য বিক্রি করেন।
কুয়ালালামপুর সিটি কর্পোরেশনের বরাদ্দকৃত দোকানটির লাইসেন্সধারী মালিক এই চায়নিজ আন্টি নিজেই। কিন্তু দোকানটি তিনি ভাড়াতে দিয়েছেন অন্য আরেকজন চায়নিজকে। ভাড়াটিয়া ব্যবসায়ী চায়নিজের কাছেই চাকরি করেন আন্টি। অর্থাৎ মাস শেষে আন্টি দোকান ভাড়া ও বেতন দুটোই ওয়ালেটে ডুকান। আন্টির ছেলেমেয়েরাও আয়রোজগারে আছেন। মোটামুটি স্বচ্ছতা আছে তার সন্তানদের। আন্টি তার আয় থেকে শুধু নিজে চলেন না, তার নাতি-নাতনিদের পড়ালেখার খরচও যোগান দেন। সম্প্রতি আন্টি ছেলের ঘরের এক নাতনিকে উচ্চ শিক্ষার জন্য পাঠিয়েছেন ইংল্যান্ডে। আরেকজনকে পাঠানোর জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
এই একাত্তর বছর বয়সেও আন্টির মুখে কখনও শুনিনি ক্লান্তির কথা। সবচেয়ে বড় কথা গত সাত-আট বছরে কখনও দেখলাম না কোনো অসুখের কারণে আন্টি কাজে না আসতে। গত সাত বছরে একবার ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে আমি দুই সপ্তাহ দোকানে আসতে পারিনি। আমার ছোট ভাই নাছির বেশ কয়েকবার অসুস্থতার কারণে দোকানে আসতে পারেনি। আমাদের সেলসম্যানদেরও এমন হয়েছে। মাঝেমধ্যে অসুস্থ হওয়াটা তো স্বাভাবিক ব্যাপারই। আশ্চর্যের বিষয়ে হচ্ছে আন্টিকে তেমন অসুস্থ হতে দেখিনি। প্রতিদিনই আন্টি আসেন চায়নাটাউনে; যদি না দেশের বাইরে বেড়াতে না যান। হ্যাঁ, দেশের বাইরেই তো! আন্টিকে কখনও শুনিনি আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে বেড়াতে যেতে। সেই সময়ই বা কই তাঁর। তবে বছর দু’বছরে একবার দলবেঁধে বিদেশে বেড়াতে যান আন্টি। ইতিমধ্যে তিনি সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, ব্রুনাই, চীন, হংকং, মঙ্গোলিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া সহ আরো কয়েকটি দেশ ঘুরে দেখেছেন।
এই বিদেশ ভ্রমণের আর্থিক সামর্থ্য ও পাসপোর্টের মান নিয়ে একটা বিষয় দীর্ঘদিন ধরে লিখব লিখব করে লেখা হয়নি। আজ বলছি একটু, ‘আন্টি ও তার বান্ধবীরা মালয়েশিয়ান, আর আমি বাংলাদেশি। ওনারা হয়ত আমাদের চেয়ে কম টাকা আয় করেও বিদেশ ভ্রমণ করতে পারেন, আমরা সহজে পারিনা। পরিচিত এক চায়নিজ তরুণী যে মাত্র আড়াই হাজার রিঙ্গিত (পঞ্চাশ হাজার টাকা) বেতনে চাকরি করেন পাশের দোকানে। সে তরুণীও গতবছর অস্ট্রেলিয়া ঘুরে এসেছে। আগে পাশ্ববর্তী আরো কয়েকটি দেশেও ঘুরতে গিয়েছিল। অথচ তার কয়েকগুণ বেশি টাকা আয় করলেও অস্ট্রেলিয়া ঘুরতে যাওয়াটা আমাদের জন্য বিশাল ব্যাপার।’ এই লেখার মূল বিষয় যেহেতু আন্টিকে নিয়ে, তাই বিদেশ ভ্রমণ কেনো করতে পারিনা সে ভাবনার কথা না হয় পরে কোন এক সময় লিখব।
আন্টিকে কিছুদিন পরপর প্রশ্ন করি, আন্টি কেন কাজ থেকে অবসর নেননা। আন্টি বলেন, ‘অবসর নিলে ঘরে বসে থাকতে হবে। ঘরে বসে থাকাটা বড় বিরক্তিকর ব্যাপার। ঘরে বসে থাকলে শরীর অসুস্থ হয়ে যাবে। কাজ করলেই শরীর সুস্থ থাকে। ‘আন্টি তার শারীরিক সামর্থের কথা জানানোর জন্য মাঝেমাঝে বলেন, সে দ্রুত হাটতে পারেন। তা তো দেখিই রোজ, রাত সাড়ে নয়টায় আন্টি যখন বাসায় যাওয়ার বাস ধরার জন্য পাচার চেনি বাসস্ট্যান্ডের দিকে যান, তখন খুব দ্রুত হাঁটেন। সারাদিনের ক্লান্ত শরীর, তাই আস্তে আস্তে হাঁটবেন সে রকম কখনও দেখিনি। আন্টি পড়ালেখা তেমন করেননি। শুধু চায়নিজ ভাষা পড়তে পারেন। তাতেই তিনি রোজ চায়নিজ খবরের কাগজ কিনে পড়েন।
নয় ভাই বোনের মধ্যে দ্বিতীয় আন্টি জীবনের প্রথম দিকে কাজ করেন সিঙ্গাপুরে। পরে প্রায় তেতাল্লিশ বছর ধরে আন্টি আছেন কুয়ালালামপুরের চায়নাটাউনে। তিনি ছাড়া বাকি সব ভাইবোন কুয়ালালামপুর থেকে দূরের নিজ গ্রামেই বাস করেন। বিয়ের পর থেকে আন্টি স্বামীর সাথে শহরমুখী হন। জীবনযাপনের জন্য সেই আটাশ বছর বয়সের টগবগে তরুণী যে শুরু করেছিল চায়নাটাউনে বেচাকেনার কাজ, আজ একাত্তর বছর বয়সেও সচল আছেন তিনি সমানতালে। শুধু আমাদের এই আন্টি নয়, আরো বহু চায়নিজ বয়স্ক নারীপুরুষ আছেন মালয়েশিয়ার ঐতিহ্যবাহী চায়নাটাউনে। যারা প্রতিদিন সকাল থেকে রাত দশটা-এগার পর্যন্ত ডিউটি করেন। তাদের কেউ নিজে ব্যবসা করেন, কেউ কেউ চাকরী করেন। তাদের কারো চোখেমুখে বয়সের কারণে ক্লান্তির ভাব দেখা যায়না। যতদিন জীবন ততদিন কাজ, কাজেই শান্তি, কাজেই আনন্দ, কাজের অপরনামই জীবন; অন্তত কুয়ালালামপুর চায়নাটাউনে দেখা এই চায়নিজদের কাছে।
বাংলাদেশে আমাদের মুরুব্বীরা কাজ না করে ঘরে বসে বসে খান, তা কিন্তু নয়। তারাও ব্যস্ততায় দিন কাটান ঘরের এই কাজ, সেই কাজ নিয়ে। আমার মাকে দেখি কোন কাজ না করতে শতবার বারণ করলেও তিনি ঘরের নানান কাজে ব্যস্ত থাকেন সারাদিন। ঘরে ওনার কাজের অভাব নেই। ছেলের বউয়েরা কোনো কাজ খুঁজে না পেলেও মা ঠিকই কাজ খুঁজে বের করেন; তবে ছেলের বউদের জন্য নয়, নিজে করার জন্য। প্রধান ব্যতিক্রম একটাই, চায়নাটাউনের চায়নিজ মুরুব্বীরা সুস্থ্যতার সাথে জীবনযাপন করছেন, আর আমাদের মুরুব্বীরা সুস্থ্য থাকেন কম। এর প্রধান কারণ আমাদের মুরুব্বীরা ডাক্তারের পরামর্শ মেনে চলেন না। অসুস্থ্য হয়ে ডাক্তার দেখিয়ে দুদিন ওষুধ খেয়ে একটু সুস্থ হয়ে উঠলেই ডাক্তারের পরামর্শ মানেন না আর। আমাদের মুরুব্বীরা যদি সুস্থ থাকেন আমরা যে যেখানে থাকি, টেনশন মুক্ত থাকি। পরিবারের সদস্যদের সুস্থতায়, যে কোনো মানুষ চলার পথে স্বস্তি পায়।