নজরুল ইসলাম টিপু, আবুধাবি, ইউএই
বাংলাদেশের উন্নয়নের চাকা গতিশীল রাখতে প্রবাসীদের রেমিটেন্স বিরাট অবদান রাখে। যে প্রবাসীদের কপালের ঘাম মাটিতে পড়ার আগে শূণ্যেই তা বাষ্পে পরিণত হয়, সে প্রবাসীদের নিয়ে অতীতে বাংলাদেশের সরকারগুলো বরাবরই নিঃস্পৃহ ভাব দেখাতেন। অন্তত প্রবাসীরা যতটুকু সদয় ভাব আশা করতেন তার অর্ধেকও তারা পেতেন না। বিগত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশ সরকার প্রবাসীদের সম্মানার্থে ভিন্ন ধরনের কিছু ভূমিকা রাখছে। অবশ্যই এটা ইতিবাচক কিন্তু যতটুকু দরকার ছিল তা পর্যাপ্ত হয়নি।
দেশের প্রতি প্রবাসীদের অবদান দু’ধরনের। এক. প্রবাসীরা নিজে আয় করে সেটা দেশে পাঠায়; এতে সে নিজেও উপকৃত হয় রাষ্ট্রকেও উপকৃত করে। দুই. এক্ষেত্রে প্রবাসীরা দক্ষ জনশক্তি সৃষ্টির পিছনে কাজ করে। নিজেরা আয় করে এবং দেশের রেমিটেন্সের প্রবাহ বৃদ্ধি করে।
এখানে যে ছবিগুলো দেখা যাচ্ছে, সেটি একটি সুইচ গিয়ার ফ্যাক্টরির ভিতরের দৃশ্য। অভিজ্ঞ ও চৌকশ ইলেকট্রিক্যাল ও ম্যাকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারদের জটিল গাণিতিক ক্যালকুলেশনের মাধ্যমে এ কাজে হাত দিতে হয়। তাদেরকে সহযোগিতা করে একদল দক্ষ কর্মী।
এখানে যারা কাজ করে, তারা সবাই বাংলাদেশি এবং রেমিটেন্সের বাহক। তারা এই দক্ষতা ও সম্মান অর্জনের সুযোগ পেয়েছে এই কারণে যে, প্রতিষ্ঠানের মালিক একজন বাংলাদেশি। নিতান্ত কেউ বিপদে না পড়লে কোন ভিনদেশিকে এ ধরনের কাজে নিয়োগ দেয়া হয়না। অর্থকড়ি থাকলেই কেউ এ ধরনের একটি কোম্পানি খুলে বসতে পারে না। অনেকগুলো ধাপ এবং আন্তর্জাতিক নিয়ম কানুন মেনেই স্বীকৃতি অর্জন করতে হয়।
এই প্রতিষ্ঠানের মালিক জনাব মুহাম্মদ আলী সি.আই.পি। (CIP- Commercial Important Person) প্রবাসীদের জন্য বাংলাদেশ সরকারের দেওয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ সম্মাননা পদক। তিনি একজন সফল ব্যবসায়ী ব্যক্তিত্ব ও দক্ষ অর্গানাইজার। তাঁর অন্যতম গুণ তিনি সর্বদা একজন বন্ধসুলভ ব্যক্তি।
তার প্রতিষ্ঠানের কয়েক শত দক্ষ মানুষ কাজ করে। তাঁদের সবাই নিজ নিজ ক্ষেত্রে অসম্ভব চৌকস। দেশে এই ধরণের চৌকসতা অর্জন করা মূলতই দূরহ। এদেশের স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, শপিং মল, বড় বড় সরকারি প্রতিষ্ঠান তাঁর ফ্যাক্টরির তৈরি প্যানেল দিয়ে আলোকিত হয়। এটা বাংলাদেশের জন্য গর্বের। আমার জানা মতে আরো অনেক বাংলাদেশি উদ্যোক্তার ভিন্ন আঙ্গিকের অত্যাধুনিক কারখানা রয়েছে। সেখানের টেকনিক্যাল ফিল্ডে শত শত মানুষ কাজ করে এবং এসব ইঞ্জিনিয়ারিং প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার বাংলাদেশিরা। কিছু প্রতিষ্ঠানের ব্যাপ্তি দেখে চোখ ধাঁধিয়ে উঠবে। কিন্তু আমাদের দেশে এদের অবদান সম্পর্কে অজানা।
রাজধানী আবুধাবি শহরের নয়নাভিরাম অট্টালিকা সমূহের প্রায় অর্ধেকের মত ভবনের বিদ্যুতের ডিজাইনার কাজ আরেকটি বাংলাদেশি কোম্পানি করা। এটা সত্যিই বিরল, গৌরবের ও সৌভাগ্যের বিষয়। প্রবাসীদের কাজকে স্বীকৃতি দিতে বাংলাদেশ সরকার CIP Award চালু করেছে। যে সব প্রবাসী বড় অংকে দেশে রেমিটেন্স পাঠায়, তাদের মধ্য থেকে সেরাদেরকে এই সম্মাননা পদক দেওয়া হয়। এটাতে সরকারকে সাধুবাদ জানাই কিন্তু যাদের ঘামে অট্টালিকা ভিজে এবং দেশের অর্থনীতির গাঁথুনি মজবুত হয়, তারা এখনও অবহেলা নিয়েই বেঁচে আছে।
উল্লেখ্য, মধ্যপ্রাচ্য ও দূর প্রাচ্যের প্রবাসীদের সাথে পাশ্চাত্য প্রবাসীদের দেশের প্রতি অবদানের দৃশ্যমান তারতম্য আছে। পাশ্চাত্যে যারা যায়, তারা এক পর্যায়ে সে দেশকে নিজের দেশ বানিয়ে নেয়। তাদের সিংহভাগ কোনদিন নিজের দেশে ফিরে আসেন না! এমনও হয় নিজের পৈত্রিক ভিটা-মাটি বিক্রি করেই সে দেশে নিজের বাড়ি-ঘর বানায় এবং পরিশেষে সে দেশেরই নাগরিক বলে গর্ববোধ করে! প্রবাসী হিসেবে তারা যেভাবে রাষ্ট্রীয় কভারেজ ও সম্মান পায়, সে পরিমাণ রেমিটেন্স তারা পাঠায় না। আরবের প্রবাসীরা এমন নয়! তারা উত্তপ্ত বালি আর কঠিন পাথর চিবিয়ে অর্থ উপার্জন করে। নিজের পকেট শূণ্য করে সে অর্থ পাই পাই করে দেশে স্বজনদের কাছে পাঠিয়ে দেয়। এই অর্থ দিয়েই বাংলাদেশের সংসদে দেশের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা করা হয়। সবার কাছে আবেদন, তাদেরকে যেন মূল্যায়ন করা হয়! অশিক্ষিত বলে অবহেলা আর মূর্খ বলে যেন গালি দেওয়া না হয়। তাদের পরিবারের নিরাপত্তার প্রতি যেন সবাই সদয় হয়।