ইসরাত জেবিন
২০০৮ সালে youtube এ ঝড় তোলা গান ছিল Dance ২০০৮ (Where the Hell is Matt?) গানের পুরো ভিডিও জুড়ে দেখা যায় Matt Harding নেচে বেড়াচ্ছেন নানা দেশে, নানা প্রান্তে। সারা বিশ্বে আলোড়ন তোলা এই অসাধারণ ভিডিও প্রকাশ হওয়ার পরপর ভাইরাল হয়ে যায়। ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতি আর মানুষকে এক সুতায় গাঁথা এ ভিডিওটিকে ভাষা দিয়েছিল একটা বাংলা গান, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘প্রাণ’ (Stream of Life)। যার গলায় প্রাণ পেয়েছিল রবীন্দ্রনাথের ‘প্রাণ’ গানটি তিনি বাংলাদেশের পল্বাশা সিদ্দিক। গানের সুরে বিশ্ব মাতালেন তিনি।
১৯৯১ সালে যশোরে জন্ম হয় পল্বাশার। ১০ বছর বয়সে পরিবারের সাথে যুক্তরাষ্ট্রে যান এবং মিনেসোটায় বসবাস শুরু করেন। একেবারে ছোটবেলা থেকেই গানের সাথে আছেন পল্বাশা। মাত্র তিন বছর বয়সে গান শেখা শুরু করেন তিনি। মুঠোফোনে প্রবাস মেলাকে তিনি জানান, যখন কথা বলা শিখেছি তখন আমার মা আমাকে ঢাকায় গানের স্কুলে নিয়ে যেতেন। পরিবারের আর কোন সদস্য গানের সাথে জড়িত না থাকলেও মা এর অনুপ্রেরণায় গানের মাধ্যমে নিজের পছন্দ আর ভালোবাসার জায়গা খুঁজে পান।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে থাকতে ধানমন্ডিতে একটা গানের স্কুলে নিয়মিত যেতেন তিনি। কিছুদিনের মধ্যেই তার মিষ্টি কণ্ঠ সবার নজরে পরে। আট বছর বয়স থেকেই বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখা শুরু করেন।
যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার ৯ মাসের মাথায় MacPhail Centre for Music থেকে স্কলারশিপ পান তিনি। ১১ বছর বয়সে Minnesota Twins game এ তিনি God Bless America গানটি পরিবেশন করেন। De La Salle High School এ পড়াশুনা করার পাশাপাশি বিভিন্ন কনসার্ট আর গানের অনুষ্ঠানেও নিয়মিত অংশগ্রহণ করতেন। তিনি বলেন, ছোটবেলা থেকে ওয়েস্টার্ন গান গাওয়ার আগ্রহ থাকলেও বাংলা গানেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। বিভিন্ন সময় আশেপাশের মানুষের মন রক্ষা করার জন্য বাংলা গান গেয়ে থাকি। একটা সময় বুঝতে পারি আমার কণ্ঠে বাংলা গান একটা নতুন মাত্রা পায়। তবে পাশ্চাত্যের ধারায় ফিউশন করা বাংলা গানের সুর তার কণ্ঠে মধুর থেকে হয়ে উঠে মনোমুগ্ধকর। তারই উদাহরণ হচ্ছে ‘প্রাণ’। ২০০৭ সালে Southwest High School এ ছাত্রী পল্বাশা KFAI রেডিও তে আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে পারফর্ম করেন। তখন তার বয়স মাত্র ১৭ বছর। Minneapolis Radio Station এ গাওয়া তার গানের একটি ভিডিও ক্লিপ youtube এ প্রকাশ পাওয়ার পর তা চোখে পড়ে আমেরিকান ট্রাভেলার ও ভিডিও গেইম ডিজাইনার Matt Harding এর কো প্রোডিউসার Melissa Nixon এর। রবীন্দ্রনাথের কবিতার উপর ভিত্তি করে লেখা বাংলা গান ‘প্রাণ’ এর সুর দেয়ার জন্য সে সময় প্রখ্যাত আমেরিকান মিউজিক কম্পোজার Garry Schyman ঠিক এরকম একজন বাংলা গানের ভোকালিস্ট খুঁজছিলেন। ২০০৮ সালের মধ্য জুনে লস এঞ্জেলস এ ধারণ করা হয় Dance ২০০৮ (Where the Hell is Matt?) এর ব্যাকগ্রাউন্ড সং ‘প্রাণ’। ২০ টি অর্কেস্ট্রার সাথে পুরো গানটি রেকর্ড করতে সময় লেগেছিল প্রায় ছয় ঘণ্টা। গানটি গাওয়ার পর Minneapolis Star-Tribune কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে Schyman বলেছিলেন পেশাদারিত্ব এবং অসাধারণ কণ্ঠের অধিকারী পল্বাশা। তার অল্প বয়সের ছাপ তার কণ্ঠে পড়ে না।
বাংলা গানের জগতে ভিন্ন ধারা আনতে পারায় উচ্ছসিত পল্বাশা এরপর এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “এ গানটি গাওয়ার পর বুঝতে পারি যে আমি ভিন্ন ধারায় বাংলা গান গাইতে পারি। ‘প্রাণ’ তারই প্রমাণ; এটা বাংলা ক্লাসিক আর পপ এর মিশ্রণ।” পল্বাশা বলেন, কিছুটা ভিন্নভাবে গাওয়ার কারণে অনেকেই প্রথমে বেশ অবাক হয়েছিলেন এবং বুঝতেই পারেনি এটা বাংলা গান এবং রবীন্দ্রনাথের ক্লাসিক।
২০০৮ সালে Dance ২০০৮ প্রকাশ পাওয়ার পর কয়েকদিনের মধ্যেই Youtubes greatest hit এর তালিকায় জায়গা করে নেয় গানটি। প্রকাশ হওয়ার কয়েকদিনের মধ্যেই ৩১ মিলিয়ন ভিউ হয়। পল্বাশার গান, তার কণ্ঠ আর সেই সাথে অসাধারণ দৃশ্যায়ন জয় করে নেয় আমেরিকান বিখ্যাত সঙ্গীতশিল্পী বিয়নস নোয়েলস এবং তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার মনও। গানটি প্রকাশ পাওয়ার সাথে সাথে তারকাখ্যাতি পেয়ে যান ১৭ বছরের পল্বাশা। অসংখ্য ভক্ত নানাভাবে শুভেচ্ছা জানায় তাকে। সেই সাথে Amayon.com Gi top-10 এ জায়গা করে নেয় গানটি। দুই সপ্তাহের মধ্যেই Madonna আর Mariah Carey এর মত সঙ্গীতশিল্পীদের পিছনে ফেলে নাম্বার ওয়ানে উঠে আসে ট্র্যাকটি।
২০০৮ সালের ওই ট্র্যাকটি দিয়েই থেমে যাননি পল্বাশা। ২০১১ সালে প্রকাশিত হয় তার প্রথম একক অ্যালবাম ‘ভালোবাসি তাই’। এছাড়াও বেশ কয়েকটি মিশ্র অ্যালবামেও গান গেয়েছেন তিনি। মিশ্র অ্যালবামের তালিকায় রয়েছে ২০১১ সালে শিহরণ, ২০১২ সালে নারী, ২০১৩ সালে সমন্বয় আর ২০১৩ সালে ৩৬০।
পল্বাশার একক গানের তালিকায় রয়েছে In loss of all hopes (২০০৯), নিজেতে ফিরে (২০১০), নেশা- The Addiction (২০১০), Mumbasa TV series title song (২০১০), তোলপাড় (২০১৫)।
তার কভার করা গানের তালিকাও বেশ সমৃদ্ধ। এর মধ্যে রয়েছে ২০০৮ সালে প্রকাশিত গান প্রাণ (মডার্ন রবীন্দ্র সঙ্গীত)। এছাড়া ২০১০ সালে কাভার করেন Kelly Clarkson এর Beautiful Disaster, Journey-ও Don’t Stop Believin’ এবং The Beatles এর Blackbird। ২০১২ তে কভার করেন Adele এর Someone like you। ২০১৩ তে সেই তালিকায় যুক্ত হয় Maroon ৫ এর Payphone ও, Lana Del Rey এর Young and Beautiful। ২০১৪ সালে তিনি কভার করেন John Legend এর All of Me.
২০০৮ সালে ‘প্রাণ’ গান গেয়ে জনপ্রিয়তা পাওয়া সেসময়ের ১৭ বছরের কিশোরী পল্বাশা আজ ২৭ বছরের তরুণী। আজও ‘প্রাণ’ গানটি দর্শক- শ্রোতাদের মন জয় করে চলেছে। বর্তমানে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সিয়াটলে বসবাস করছেন। নিজের স্বপ্নের জগতে এখনো হেঁটে চলেছেন। এক প্রশ্নের জবাবে পল্বাশা জানান, বর্তমানে তিনি পেশাগতভাবে স্টারবাকস হেড কোয়ার্টাসে বিজনেস এনালিস্ট হিসেবে কাজ করছেন। পাশাপাশি বিভিন্ন ‘শো’তে গান করেন জনপ্রিয় এই শিল্পী। তিনি জানান, যদিও ‘প্রাণ’ গানটি আমার স্বপ্নকে বাস্তব রূপ দেয়ার অনুপ্রেরণা হয়ে এসেছিল, তবুও আমি বাংলাদেশকে ভালোবাসি, বাংলা গানকে ভালোবাসি। এই অনুপ্রেরণা নিয়ে আজীবন বেঁচে থাকতে চাই।