মনির আহমদ, সিঙ্গাপুর সিটি, সিঙ্গাপুর
পদ্মায় ভেঙে যাচ্ছে প্রিয় গ্রাম, চেনা শহর মুহূর্তেই বিলীন হয়ে যাচ্ছে লাখো মানুষের শেষ সম্বল। প্রবাসে বসে ফেসবুকের পাতা খুললে আমার শরীয়তপুরের নড়িয়া ও জাজিরা উপজেলার মানুষের আহাজারি ভেসে আসে।
প্রতিটি ভাঙন কবলিত বাড়িকে মনে হয় আমার শৈশব। ২০০২ সালের এপ্রিল মাসে আমরাও আমাদের দাদাসূত্রে পাওয়া শেষ সম্বলটুকু হারিয়ে রাস্তায় বসেছিলাম। তখন আমি ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র। বলা যায় ১৯৯৮ এর বন্যার সময় থেকে শুরু করে আমাদের বাড়ি কয়েকবার নদীতে ভেঙেছে।
দক্ষিণে চাপতে চাপতে শেষ পর্যন্ত হারাতে হয়েছিল শেষ জমিটুকুও। এখন কিছুটা নিরাপদ স্থানে ছোট্ট একটু জায়াগায় বসতী স্থাপন করলেও ব্যথিত হই যখন দেখি প্রিয় গ্রাম পাঁচগাঁও-এর পশ্চিমাংশ বিলীন হয়ে যাচ্ছে, বিলীন হচ্ছে সুরেশ্বর, সাধুর বাজার, চর জুজিরা, চর নড়িয়া, মোক্তারের চর, খাজুরতলাসহ জাজিরার বিভিন্ন অঞ্চল।
পদ্মাপারের মানুষের বেড়িবাঁধের দাবি দুই এক বছরের নয়, নব্বই দশকের গোড়ার থেকে এই দাবি বারবার প্রতিধ্বনিত হয়েছে। সুরেশ্বর প্রকল্প, সুরেশ্বর পাইলট প্রকল্পসহ অসংখ্য প্রকল্প বাস্তবায়ন হবে বলে আমাদের আশ্বস্ত করা হলেও কোন প্রকল্পই আলোর মুখ দেখেনি। সম্ভবত ২০০৯ কিংবা ১১ সালে তৎকালীন ডেপুটি স্পিকার আমাদের সাংসদ কর্ণেল অবসরপ্রাপ্ত শওকত আলী সাহেব সুরেশ্বর মাজার কেন্দ্রিক এরিয়াতে একটি বেড়িবাঁধ প্রকল্পের উদ্বোধন করেন। এই অনুষ্ঠানে আমারও উপস্থিত থাকার সৌভাগ্য হয়েছিল। পর্যায়ক্রমে কয়েক বছরে এর সামান্য কিছু কাজ হলেও অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগও ছিল প্রচুর।
এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে ৫০ দিনের ছুটিতে আমি সিঙ্গাপুর থেকে দেশে গিয়েছিলাম, পদ্মাপাড় ঘুরেফিরে দেখলাম। ৩ বছর আগে দেখে যাওয়া অনেক কিছুই আর বিদ্যমান নেই। বেরিবাঁধের অন্তর্ভুক্ত সুরেশ্বর হাসান হোসাইন মাদ্রাসা সরিয়ে নেয়া হয়েছে, মধ্য সুরেশ্বর মসজিদের অংশের বেশকিছু জায়গা বেড়িবাঁধসহ নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। অনেকাংশ তলিয়ে যাওয়ার অবস্থায় রয়েছে। সুরেশ্বর স্কুল মাঠে খেলেছিলাম দেশী বনাম প্রবাসীদের মাঝে প্রীতি ক্রিকেট ম্যাচ। সুরেশ্বর স্কুল ভবনের পশ্চিমে শহীদ মিনার, তার পেছনে হা করে তাকিয়ে আছে পদ্মা নদী। মনে হয়েছিল ভবনটির সাথে এই দেখাই শেষ দেখা। শোনলাম, ভবনের পেছনে নদীর দূরত্ব রয়েছে ১০ মিটারের মতো, এই বন্যায় বাঁচা মরার মধ্যস্থানে দাঁড়িয়ে আছে সুরেশ্বর স্কুল।
গত কয়েক বছরে বিলীন হয়ে গেছে সাধুর বাজারের উত্তরের এক সুপ্রসন্ন গ্রাম, দেওয়ান বাড়ি বিলীনের মুখে। আমাদের সাংসদ কর্ণেল অবসরপ্রাপ্ত শওকত আলীর শ্বশুর বাড়িও এবার বিলীন হয়েছে, ছাত্রনেতা মিতুল মোল্লার বাবা অনেক স্বপ্ন নিয়ে বাড়িতে বিল্ডিং এর কাজ শুরু করেছিলেন শেষ করার আগেই তার ডাক পরে যায় না ফেরার দেশে, ফলে বিল্ডিং বাড়িটিও ভেঙে ফেলা হচ্ছে। ফেসবুকের ভেসে আসছে অসংখ্য ভিডিও, দেখা যাচ্ছে পদ্মার প্রবল স্রোতের মুখে বাড়িঘর সরিয়ে নেয়ার আগেই নদীতে বিলীন হয়ে যাচ্ছে, তলিয়ে যাচ্ছে জমিজমা। এরকম কয়েক হাজার মানুষ নদী ভাঙার কারণে এই বছর পথে বসেছে। প্রবাসে বসে এসব দেখে যাওয়া ছাড়া কিছুই করার নেই আমাদের।
নড়িয়া, জাজিরা উপজেলায় পদ্মানদীর ডানতীর রক্ষা বাঁধ প্রকল্প নামে একটি বিল একনেকে পাশ হয়ে অর্থ বরাদ্দ হলেও ঠিকাদারি পদ্ধতি পরিবর্তনের ফলে আটকে গেছে এই বেড়িবাঁধের কাজ। পাউবো শরীয়তপুর জানিয়েছে এই বছরের অক্টোবরেই কাজ শুরু হতে পারে। কাজটি এবার সত্যি সত্যি শুরু হওয়ার পথে থাকলেও এই প্রবাদ, এই প্রতিশ্রুতিতে আর মন ভরে না নড়িয়া, জাজিরার মানুষের।
২৫ বছর ধরে নড়িয়া জাজিরাবাসীর ভিটেমাটি হারানোর হাহাকার কেউ দূর করতে পারেনি। শুধু একঝাঁক স্বপ্ন দেখিয়েছে কান্ডারিগণ। শরীয়ত উল্লাহ্’র শরীয়তপুরে কারও মাঝেই আজ শরীয়ত উল্লাহ্’র আদর্শ নেই। বিপ্লবী পুলিশ বিহারী দাস, বিপ্লবী সর্দার নগেন্দ্রশেখর চক্রবর্তী, কিংবা ভাষা সৈনিক গোলাম মাওলাও ফের জন্মেনি এখানে। বিপ্লবের জন্য রক্ত দিতে হয়, জীবন দিতে হয়, আমরা ভুলে গেছি। এই শরীয়তপুরের মাটিতে বিপ্লবী কেদার রায় তার সর্বশক্তি দিয়ে যুদ্ধ করেছেন।
আমরা এসব ইতিহাস ভুলে বিপ্লবের স্বপ্ন দেখেছি সরকারের আস্থা ও ভালোবাসা নিয়ে, প্রশাসনের অনুমতি নিয়ে। সহায় সম্বল হারিয়ে এবার আমাদের দেয়ালে পিঠ ঠেকেছে। আমরা বলতে শিখেছি, লিখতে শিখেছি দেশে ও প্রবাসে হচ্ছে প্রতিবাদ। সংসদ নির্বাচন প্রত্যাশিদের ব্যর্থতা তুলে ধরে আসন্ন সংসদ নির্বাচন বন্ধের দাবি জানিয়েছি।
একজন প্রবাসী হয়ে, নদীতে ভিটেমাটি হারানো ভুক্তভোগী হয়ে নড়িয়া, জাজিরাবাসীর মতো আমিও জোর দাবি জানাই আর কোন ছলচাতুরী নয়, কোন আশ্বাস, প্রতিশ্রুতি নয়, বেড়িবাঁধ বাস্তবায়ণ করুন আমরা ভোট দিতে কেন্দ্রে যাবো।
প্রধানমন্ত্রীর কাছে আকুল আবেদন, ভাঙন কবলিত অর্ধলক্ষ মানুষের পাশে দাঁড়ান। বেড়িবাঁধ বাস্তবায়ণের আগ পর্যন্ত শরীয়তপুর-১ ও ২ আসনের নির্বাচন স্থগিত করুন। নতুবা আপনাকে ভালোবাসা, শ্রদ্ধা করা এই অবহেলিত মানুষগুলো হয়তো ভোট কেন্দ্রে যাবে না।
একটি কবিতা দিয়ে লেখা শেষ করলাম…
ভিটা নাই, মাটি নাই
খাওনের বাটি নাই
পরনের জামা নাই
ভোট দিয়ে কী হবে?
ভোট দিয়ে কী হবে?